একে তো সুতা ও অন্যান্য দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি, অপর দিকে করোনা ঠেকাতে সরকার ঘোষিত লকডাউন, সবমিলিয়ে খুবই নাজেহাল অবস্থা সিরাজগঞ্জের তাঁতশ্রমিক ও তাঁতমালিকদের। করোনার কারণে গত বছরের মতো ঈদুল ফিতরকে সামনে রেখে থমকে দাঁড়িয়েছে তাঁতপণ্য উৎপাদন। বেসামাল হয়ে পড়েছেন তাঁতমালিক ও তাঁত ব্যবসায় জড়িতরা। লকডাউন তাদের জন্য মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এতে ঈদের অঅগে বেকার হয়ে পড়েছেন হাজার হাজার তাঁতশ্রমিক। করোনা, লকডাউন ও কাজ হারিয়ে দিশেহারা তাঁতশ্রমিক পরিবারগুলো। রমজান ও ঈদে ব্যবসায় অনিশ্চয়তার ছাপ দেখে দুশ্চিন্তায় জীবন কাটছে তাদের।
তাঁতসমৃদ্ধ সিরাজগঞ্জের বেলকুচি, চৌহালী, এনায়েতপুর, শাহজাদপুর, কামারখন্দ, কাজীপুর, সিরাজগঞ্জ সদর, রায়গঞ্জ, তাড়াশ ও উল্লাপাড়ার তাঁতপল্লীগুলো থেকে প্রায় হারিয়ে যাচ্ছে তাঁত বুননের খটখট শব্দ। কারণ হিসেবে তাঁতিরা বলছেন, সুতার দাম তিন মাস আগে যা ছিল, বর্তমানে তার দ্বিগুণেরও বেশি হয়েছে। পক্ষান্তরে উৎপাদিত কাপড়ের মূল্য বৃদ্ধি করতে পারছেন না তারা। ফলে তাঁতিরা পুঁজি হারিয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে পড়ছেন। স্থানীয় সুতার মিলের মালিকরা দফায় দফায় ইচ্ছামাফিক সুতার মূল্য বৃদ্ধি করছেন। কারণ হিসেবে তুলার মূল্য বৃদ্ধির কথা বলছেন তারা। রঙ ও ক্যামিক্যালের মূল্যও কয়েক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে তাঁতিদের কল্যাণে কোনো পদক্ষেপ না নিলে তাঁতশিল্প ধ্বংস হয়ে যাবে। মাত্র তিন মাসের ব্যাবধানে সুতা, রঙ ও রাসয়নিক দ্রব্যের দাম দ্বিগুণ বৃদ্ধি পাওয়ায় লোকসান গুনতে হচ্ছে তাঁতমালিকদের।
তিন মাস আগে যে কাপড় তৈরি করতে ৪০০ টাকা খরচ পড়ত, সে কাপড় তৈরি করতে এখন ৮০০ টাকা খরচ পড়ছে। কিন্তু উৎপাদিত কাপড় বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে না। লোকসানে লোকসানে তঁাঁতপল্লীগুলোর তাঁত বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। তাঁতমালিকরা বাধ্য হয়ে বন্ধ করে দিচ্ছেন তাদের কারখানাগুলো। এ পর্যন্ত ৩০ ভাগ তাঁত বন্ধ হয়ে গেছে। এতে লক্ষাধিক তাঁতশ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছেন।
এ বিষয়ে জাতীয় তাঁতি সমিতির সভাপতি মনোয়ার হোসেন বলেন, বাংলাদেশ তাঁত বোর্ড করোনাকালীন ও ঈদুল ফিতরের আগ মুহূর্তে সুতা, রঙ ও কেমিক্যালের ঊর্ধ্বমূল্যের বিষয়ে এ যাবৎ কোনো সহযোগিতা বা তাঁতিদের কল্যাণে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। তাত বোর্ড গঠনের উদ্দেশ্যই হলো তাঁতিদের কল্যাণ করা বা তাঁতিদের সমস্যার সমাধান করা; কিন্তু তার সামান্যতম পদক্ষেপও পরিলক্ষিত হচ্ছে না, যা অত্যন্ত দুঃখজনক।
সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার কালিদাসগাঁতি গ্রামের তাঁতমালিক হাজী আব্দুর রাজ্জাক, এনায়েতপুর থানার গোপালপুর গ্রামের তাঁতমালিক রুহুল আমিন, শাহজাদপুর উপজেলার খুকনী গ্রামের তাঁতমালিক অনিক আহমেদ ও বেলকুচি উপজেলার সোহাগপুর গ্রামের তাঁতমালিক সফিকুল জানান, রঙ-সুতা ও তাঁত সরঞ্জামের দাম বাড়ছে। এভাবে চলতে থাকলে তাঁতশিল্প টিকিয়ে রাখা কষ্টকর হবে।
তাঁতিদের সমস্যা সমাধানে বা তাঁতশিল্পের উন্নয়নে তাঁত বোর্ড থাকলেও তাঁতিদের জন্য তাঁত বোর্ড কোনো কাজেই আসছে না। সোহাগপুর, শাহজাদপুুর, এনায়েতপুর ও চৌহালী এলাকা ঘুরে সাধারণ তাঁতিদের সাথে কথা বলে জানা যায়, নিয়মনীতি থাকলেও বাংলাদেশ তাঁত বোর্ড গত দু’বছরে তাঁতিদের কোনো সুপারিশ গ্রহণ করছে না। তারা তাঁতঋণ পাচ্ছে না, এমনকি করোনাকালীন কোনো প্রণোদনাও পাননি। বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডে আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে তাঁতশিল্পের উন্নয়নে সিদ্ধান্তগুলো মাসের পর মাস ঝুলিয়ে রাখা হচ্ছে। এতে তাঁতিরা চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডের চেয়ারম্যানের সাথে ফোনে যোগাযোগ করেও তাকে পাওয়া যায়নি।
এ দিকে সরকারের সঠিক নজরদারি থাকলেই তাঁতশিল্পকে সমৃদ্ধ করা সম্ভব বলে মনে করেন সিরাজগঞ্জ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির পরিচালক একরামুল হক রিজভী। তিনি বলেন, রঙ ও সুতার বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য একটি মনিটরিং টিম গঠন করা দরকার। এর পাশাপাশি এই শিল্পের সাথে যারা জড়িত তাদেরকে সরকারিভাবে পৃষ্ঠপোষকতা দিলে তাঁতশিল্পের হারানো ঐতিহ্য ফিরে আসবে।
বেলকুচি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আনিসুর রহমান বলেন, তাঁতশিল্পের সব সমস্যা সমাধানে কাজ চলছে। এ বিষয়ে জেলা প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানানো হয়েছে।
তাঁতসমৃদ্ধ সিরাজগঞ্জের বেলকুচি, চৌহালী, শাহজাদপুর, এনায়েতপুর, কামারখন্দ, কাজীপুর, সদর, রায়গঞ্জ, তাড়াশ ও উল্লাপাড়া উপজেলায় পাঁচ লক্ষাধিক (বিদ্যুৎচালিত ও হস্তচালিত) তাঁত রয়েছে। এসব তাঁতে শাড়ি-লুঙ্গি উৎপাদনের জন্য কাজ করছেন প্রায় ১২ লাখ তাঁতশ্রমিক। এসব তাঁত বন্ধ হয়ে গেলে ১২ লাখ তাঁতশ্রমিক বেকার হয়ে পড়বেন। ইতোমধ্যে ৩০ ভাগ তাঁত বন্ধ হয়ে গেছে। তাতে লক্ষাধিক তাঁতশ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছেন।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা