২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

হিন্দুত্বের ‘নতুন ল্যাবে’ই বিজেপি কোণঠাসা, আশাবাদী কংগ্রেস

কর্নাটকে একটি রাজনৈতিক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী মোদী ও মুখ্যমন্ত্রী বোম্মাই - ছবি : বিবিসি

ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপি দেশের যে রাজ্যটিকে তাদের ‘হিন্দুত্ব এক্সপেরিমেন্টে’র নতুন পরীক্ষাগার বা ল্যাবরেটরি করে তুলেছিল, সেটি হল দাক্ষিণাত্যের কর্নাটক। আজ পর্যন্ত দক্ষিণ ভারতের শুধু এই একটি রাজ্যেই বিজেপি ক্ষমতায় যেতে পেরেছে।

কর্নাটকে বাসবরাজ বোম্মাইয়ের নেতৃত্বে বিজেপি সরকার সাম্প্রতিককালে যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে, পর্যবেক্ষকরা মনে করেন তার অনেকগুলোই রাজ্যে সাম্প্রদায়িক বিভাজন বা পোলারাইজেশনের লক্ষ্যে নেয়া।

যেমন, রাজ্যের স্কুল-কলেজে মুসলিম ছাত্রীদের হিজাব বা হেডস্কার্ফ পরা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ইসলামসম্মত ‘হালাল’ গোশত বাজারে বিক্রির ওপরেও বিধিনিষেধ আনা হয়েছে। মহীশূরের সাবেক শাসক টিপু সুলতানকে হিন্দুবিদ্বেষী হিসেবে তুলে ধরতে নতুন করে ইতিহাস লেখার চেষ্টাও বাদ যায়নি।

রাজ্যে বিধানসভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে আগামী সপ্তাহেই (১০ মে)। তার অল্প কিছুদিন আগে কর্নাটক সরকার রাজ্যের পশ্চাৎপদ মুসলিমদের জন্য চার শতাংশ সংরক্ষণের (কোটা) ব্যবস্থাও বাতিল ঘোষণা করেছে।

এত কিছুর পরেও কর্নাটকে এই হিন্দুত্বের রাজনীতি বিজেপিকে আদৌ কোনো নির্বাচনী ফায়দা দিচ্ছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন না। ভোটের যখন আর মাত্র কয়েকদিন বাকি, বিজেপিও এই শেষ মুহূর্তে হিন্দুত্বের রাস্তা ছেড়ে নির্বাচনী প্রচারে শুধু উন্নয়ন আর অবকাঠামোর কথাই বলছে। পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী নিজেও ভোটের প্রচারে কর্নাটক চষে ফেলছেন।

কর্নাটকে তাদের প্রধান প্রতিপক্ষ কংগ্রেস উল্টোদিকে খুবই উজ্জীবিত প্রচার চালাচ্ছে। দলের রাজ্য নেতৃত্বে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব থাকলেও আপাতত সে সব ভুলে ক্ষমতায় ফেরার জন্য কংগ্রেস নেতারা ঝাঁপিয়ে পড়েছেন।

সম্প্রতি রাহুল গান্ধীর 'ভারত জোড়ো' যাত্রা কংগ্রেসের পালে অনেকটাই হাওয়া ফিরিয়ে এনেছে বলে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা একমত। এই পটভূমিতে আগামী বছর দেশে সাধারণ নির্বাচনের আগে বিজেপিকে একটা বড় ধাক্কা দেয়ার জন্য কর্নাটকের ভোটকেই বিরাট সুযোগ হিসেবে দেখছেন কংগ্রেস নেতারা।

হিন্দুত্বের পরীক্ষা-নিরীক্ষা
কর্নাটকের রাজনীতি মূলত রাজ্যের হিন্দুদের দুটি প্রধান সম্প্রদায় লিঙ্গায়েত ও ভোক্কালিগাদের মধ্যে দ্বন্দ্বের রাজনীতি। বিজেপি বরাবরই লিঙ্গায়েতদের সমর্থন পেয়ে এলেও ভোক্কালিগাদের মধ্যে তাদের জনসমর্থন বেশ কম।

কংগ্রেসে আবার বেশ কয়েকজন বড় মাপের ভোক্কালিগা নেতা আছেন, ফলে ভোক্কালিগা ভোট মূলত কংগ্রেস আর জনতা দল (সেকুলার)-এর ঝুলিতেই যায়।

পর্যবেক্ষকেরা বলছেন, কর্নাটকের এই নিজস্ব হিন্দু ‘জাতপাতের রাজনীতি’ খতম করতেই বিজেপি চেয়েছিল হিন্দু-মুসলিম ভোট ভাগের রাজনীতি। যাতে মুসলিম-বিরোধিতার আবেগে লিঙ্গায়েত ও ভোক্কালিগারা এককাট্টা হয়ে তাদের সব হিন্দু ভোট বিজেপিকেই দেয়।

কর্নাটকের জনসংখ্যার প্রায় ১৫ শতাংশ মুসলিম। ওদিকে উত্তরপ্রদেশে মুসলিম জনসংখ্যা প্রায় ২০ শতাংশ। সেখানে বিজেপির এই ফর্মুলা অতীতে দারুণ কাজে এসেছে।

ব্যাঙ্গালোরের প্রবীণ রাজনৈতিক বিশ্লেষক সুগত শ্রীনিবাসারাজু বিবিসিকে বলছিলেন, ‘ঠিক একই ধরনের লক্ষ্য নিয়েই রাজ্যের বোম্মাই সরকার গত দু-তিন বছরে একের পর এক মুসলিম-বিরোধী পদক্ষেপ নিয়ে হিন্দুত্ব এজেন্ডার বাস্তবায়ন করে গেছে।’

এই হিন্দুত্ব এজেন্ডার সবচেয়ে বড় উদাহরণ হল দক্ষিণ কর্নাটকে গত বছরের হিজাব-বিরোধী আন্দোলন। বছর দেড়েক আগে থেকেই সেখানকার সব স্কুল-কলেজের সামনে বিভিন্ন হিন্দুত্ববাদী সংগঠন মুসলিম মেয়েদের হিজাব পরে আসার বিরুদ্ধে জমায়েত করে স্লোগান দিতে শুরু করে। যার পরিণতিতে একটা পর্যায়ে ছাত্রীদের হিজাব পরা নিষিদ্ধ করা হয়, আদালতও তাতে সায় দেয়।

কর্নাটকে হালাল গোশত বিক্রি নিষিদ্ধ করার দাবি নিয়েও গত বছর থেকে সরব হয় শ্রীরাম সেনা ও বজরং দলের মতো নানা গোষ্ঠী। এরপর সেই দাবি অনেকটা মেনে নিয়ে রাজ্য বিধানসভায় একটি বিল আনারো প্রস্তুতি নেয় বোম্মাই সরকার।

বিজেপির কর্নাটক শাখার আর একটি বিতর্কিত পদক্ষেপ ছিল উরি ও নানজে গৌড়ার কাহিনী প্রচার করা।

ইতিহাসের এই দুই ভোক্কালিগা বীরই আসলে টিপু সুলতানকে হত্যা করেছিলেন। শ্রীরঙ্গপত্তনমের যুদ্ধে ব্রিটিশদের হাতে তার মৃত্যু হয়নি। ভোটের মাসকয়েক আগে থেকে বিজেপি এই প্রচারণাও শুরু করে।

তবে এই দাবিতে যে কোনো ঐতিহাসিক সত্যতা নেই। বরং এটা স্রেফ ভোক্কালিগা ভোট টানার চেষ্টা। কর্নাটকের পর্যবেক্ষকরা সবাই প্রায় এ বিষয়ে একমত।

বোম্মাই সরকারের শেষ হিন্দুত্ববাদী পদক্ষেপ ছিল রাজ্যে চার শতাংশ মুসলিম কোটা বাতিল করা। সুপ্রিম কোর্টের ভর্ৎসনার পরও তারা যে অবস্থানে অনড় রয়েছে।

‘কর্নাটক সাম্প্রদায়িক নয়’
বাস্তবতা হল, কর্নাটকে একটার পর একটা হিন্দুত্ববাদী পদক্ষেপ নিলেও ভোটের আগে তা বিজেপিকে বাড়তি কোনো অক্সিজেন জোগাতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। দিনসাতেক আগে ভারতের একটি জাতীয় টিভি চ্যানেলের অ্যাঙ্কর মুখ্যমন্ত্রী বাসবরাজ বোম্মাইয়ের লাইভ সাক্ষাৎকার নেয়ার সময় বিজেপির এই হিন্দুত্ব এজেন্ডা নিয়ে একটি প্রশ্ন করেন।

দৃশ্যতই বিরক্ত বোম্মাই জবাব দেন, ‘হিজাব আর হালাল ছাড়া আপনারা কি কোনো সাক্ষাৎকার নিতে পারেন না? মানুষ এখন ওসব নিয়ে আর কথা বলছে না।’

কর্নাটকের রাজনৈতিক বিশ্লেষকরাও বলছেন, রাজ্যের ভোট যে হিন্দুত্ব নয় বরং উন্নয়ন আর অবকাঠোমোর প্রশ্নেই আবর্তিত হচ্ছে। এটা বুঝেই বিজেপিও এখন তাদের বিভাজনের রাজনীতির রাস্তা থেকে সরে আসার চেষ্টা করছে।

সুগত শ্রীনিবাসারাজুর কথায়, ‘হিন্দুত্ব যে এখানে আর কোনো ডিভিডেন্ড দিচ্ছে না সেটা বিজেপিও উপলব্ধি করেছে।’

তিনি বলেন, ‘মূলত রাজ্যের যে ওল্ড মাইসোর এলাকায় বিজেপি এই রাজনীতিটা শুরু করেছিল, সেখানে সাধারণ মানুষের অনেক বেশি মাথাব্যথা ডিজেলের দাম কিংবা কৃষিপণ্যের সঠিক মূল্য পাওয়া নিয়ে।’

ইউনিভার্সিটি অব মাইসোরের রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মুজফফর আসাদিও মনে করেন, কর্নাটকের মাটিতে বিজেপির এই সাম্প্রদায়িকতার রাজনীতি কাজ করবে এটা ভাবাটাই ভুল ছিল।

তিনি বলছিলেন, ‘মূলত কর্নাটকের ডিএনএতেই এই সাম্প্রদায়িকতা জিনিসটা নেই। এই রাজ্যে হিন্দু-মুসলিম পাশাপাশি শান্তিতে বাস করছে বহু বহু কাল ধরে, এমন কী কর্নাটকে তেমন কোনো বড় দাঙ্গার ইতিহাসও নেই।’

অধ্যাপক আসাদি বলছিলেন, ‘এখানে যদি বলাও হয় টিপু সুলতান হিন্দুবিদ্বেষী ছিলেন মানুষ সেটা বিশ্বাস করবে না। মহীশূরের লোকজন তাকে চিরকাল একজন পরধর্মসহিষ্ণু শাসক হিসেবেই জেনে এসেছেন।’

ঘুরে দাঁড়াচ্ছে কংগ্রেস?
বিজেপির হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি রাজ্যে সাড়া ফেলতে ব্যর্থ হয়েছে এবং মানুষ বোম্মাই সরকারের দুর্নীতিতে বীতশ্রদ্ধ। এটা বুঝেই নতুন উদ্যমে কর্নাটক দখলের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছে রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস। বোম্মাই সরকার প্রতিটি কাজের জন্য শতকরা চল্লিশ ভাগ ‘কমিশন’ বা ঘুষ নিয়ে থাকে। এই দাবি করে প্রতিটি জনসভায় রাজ্য সরকারকে ‘ফর্টি পার্সেন্ট গভর্নমেন্ট’ বলে লাগাতার আক্রমণ করে চলেছেন কংগ্রেস নেতারা।

কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধীর আপাত-সফল 'ভারত জোড়ো' যাত্রার পর এই প্রথম দেশের কোনো বড় রাজ্যে ভোট অনুষ্ঠিত হচ্ছে। সেটাও নিচুতলার কংগ্রেস কর্মীদের উজ্জীবিত করে রেখেছে। বস্তুত ভারত জোড়ো যাত্রার একটা বড় অংশ কর্নাটকের ওপর দিয়েই পাড়ি দিয়েছিল।

দিল্লিতে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ঈশাদৃতা লাহিড়ীর কথায়, ‘রাহুল গান্ধী, বোন প্রিয়াঙ্কা গান্ধী বা নতুন কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট মল্লিকার্জুন খাড়গে একটানা প্রচারে কর্নাটক চষে ফেলছেন। ডিকে শিবকুমার বা সিদ্ধারামাইয়ার মতো স্থানীয় নেতারা তো আছেনই।’

তিনি বলছিলেন, ‘বলা যেতে পারে কংগ্রেস প্রায় কার্পেট বম্বিংয়ের ধাঁচে প্রচার চালাচ্ছে। আর একটা জিনিস হল, আদানির মতো বিষয়ে নয়, তারা জোর দিচ্ছেন একেবারে কর্নাটকের স্থানীয় ইস্যুতে। যেগুলোর সাথে মানুষ সহজেই রিলেট করতে পারবেন।’

বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে ‘অ্যান্টি-ইনকামবেন্সি’, অর্থাৎ ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে সেন্টিমেন্টটা খুব শক্তিশালী। এটা বুঝেই বিরোধী দলগুলো এই কৌশল নিয়েছে বলে পর্যবেক্ষকরা ধারণা করছেন।

কংগ্রেস নেতারা প্রকাশ্যেই দাবি করছেন, ২২৪ আসনের কর্নাটক বিধানসভায় তারা এবার অনায়াসেই ১৪০ বা তারো বেশি আসন পাবেন।

কংগ্রেসের আত্মবিশ্বাস এতটাই তুঙ্গে যে দলটি আরো বলছে, গরিষ্ঠতা পাওয়ার জন্য তাদের এবার জনতা দল (সেকুলার)-এর মতো অন্য বিরোধী দলগুলোর ভরসাতেও থাকতে হবে না।

১০ মে এক দিনে গোটা রাজ্যে ভোটগ্রহণের পর তিন দিন বাদে ১৩ মে কর্নাটকে ভোটগণনা। ওই দিনই নিশ্চিতভাবে জানা যাবে কর্নাটক বিজেপির হাতছাড়া হচ্ছে কি না।

সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement