২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

আরবি শিক্ষার্থীদের জন্য চমৎকার একটি গল্প ‘বর্ণচোরার দণ্ড’

- প্রতীকী ছবি

বর্ণ মানে রং। বর্ণিল মানে রঙিন। বর্ণচোরা মানে রং চোর, ক্ষণে ক্ষণে রং বদলায় যে। ছদ্মবেশী বা বহুরূপী। আবার বর্ণ মানে অক্ষর। যেমন, বর্ণমালা, স্বরবর্ণ, ব্যঞ্জনবর্ণ ইত্যাদি। এ অর্থে বর্ণচোরা মানে অক্ষর চোর। যে অন্যের অক্ষর চুরি করে। নিচের ঘটনাটি দ্বিতীয় অর্থে বর্ণচোরার। তো চলো দেখি, ঘটনা কী!

ওসমানী সাম্রাজ্যের একজন প্রভাবশালী মন্ত্রী। নাম দাউদ পাশা। তার মনে জাগলো আরবি ভাষা শেখার আগ্রহ। তাই তিনি একজন আরবি ভাষা ও গ্রামার বিশারদকে দরবারে হাজির করে তার কাছ থেকে দীর্ঘকাল যাবৎ নিরবিচ্ছিন্নভাবে আরবি ভাষার পাঠ গ্রহণ করেন। তার শিক্ষার ফলাফল এই দাঁড়াল যে, তিনি একদিন স্বীয় উস্তাদকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমর কী এমন অপরাধ করেছে যে, যায়েদ প্রতিদিন তাকে প্রহার করে, বারংবার হত্যাচেষ্টা করে এবং তার ওপর বেদনাদায়ক নির্যাতন চালিয়ে ভবলীলা সাঙ্গ করার উপক্রম করে?’ আমর কী এতই দুর্বল ও অক্ষম হয়ে গেল যে, প্রতিরোধ বা প্রতিশোধ কোনোটাই সে করতে পারছে না? মারনেওয়ালা তাকে মেরেই চলেছে আর সে মুখ বুজে সব সহ্য করে যাচ্ছে! এই প্রশ্ন করার সময় মন্ত্রী সাহেব রাগে জ্বলছিলেন এবং ক্রোধে জমিনে পদাঘাত করছিলেন।

প্রশ্ন শুনে শিক্ষক উত্তর দিলেন- ‘প্রহারকারী বা প্রহৃত বিষয়টি বাস্তব কিছু না। কায়দা বা নিয়মগুলো বোঝানোর স্বার্থে ব্যকরণবিদগণ উদাহরণস্বরূপ বাক্যগুলো উল্লেখ করে থাকেন।’ এ উত্তর মন্ত্রী মহোদয়কে তুষ্ট করতে পারেনি। ফলে মন্ত্রী খুব ক্রুদ্ধ হলেন। শাস্তিস্বরূপ স্বীয় উস্তাদকে কারারূদ্ধ করার নির্দেশ দিলেন। এরপর অন্য একজন ব্যাকরণবিদকে নিয়ে আসতে বললেন। তিনিও একই উত্তর দিলেন। মন্ত্রী তাকেও বন্দীর নির্দেশ দিলেন।

এভাবে একের পর এক নাহুবিদদের তলব করতে থাকেন, আর একই ধরনের ভুল (!) উত্তরের দায়ে সবাইকে জেলে পুরতে লাগলেন। এক পর্যায়ে কারাগারগুলো ভরে গেল আলেম বন্দী দিয়ে। প্রতিষ্ঠানগুলো হয়ে গেল শিক্ষকশূন্য। এ অশুভ বিষয়টি মন্ত্রীর একমাত্র ব্যস্ততায় পরিণত হওয়ায় রাষ্ট্রের অন্য সব সমস্যার সমাধান ও কল্যাণমূলক কাজ থমকে গেল। এ বিষয়টির সুরাহা মন্ত্রীর কাছে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠলো।

এরপর মন্ত্রী ভাবলেন- বাগদাদের আলেমদেরও তলব করা দরকার। ভাবনা অনুযায়ী তিনি তাদেরকেও ডেকে পাঠলেন। বাগদাদের আলেমরা ইতোমধ্যেই জরুরি তলবের কারণ জানতে পেরেছিলেন। বাগদাদের ওলামা দলের প্রধান ছিলেন অত্যন্ত বিচক্ষণ, বুদ্ধিমান ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন আলেম। যিনি সকল বিষয় উৎস ও তাৎপর্যসহ জানতেন।

ওলামায়ে কেরামের কাফেলা রাজ দরবারে উপস্থিত হলে মন্ত্রী সাহেব তাদেরকেও উপর্যুক্ত প্রশ্নটি করলেন। দলনায়ক সেই বুদ্ধিমান আলেম উত্তরে বললেন, ‘হুজুর, আমর যে অপরাধ করেছে, তার জন্য এর চেয়েও কঠিন শাস্তি পাওয়ার যোগ্য সে।’ উত্তর শুনে মন্ত্রী কিছুটা খুশি হলেন। তার চেহারায় উজ্জ্বলতা ফুটে উঠল। উৎসাহী হয়ে প্রসঙ্গে ফিরে এসে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী সেই অপরাধ আমরের?’ তিনি বললেন, সে আমাদের মহামান্য মন্ত্রীর নামের ওপর আক্রমণ করে সেখান থেকে একটি ওয়াও ছিনিয়ে নিয়েছে। এ ঔদ্ধত্যের শাস্তিস্বরূপ প্রতিদিন প্রহার করার জন্য ব্যাকরণবিদগণ যায়েদকে আমরের ওপর নিযুক্ত করেছেন।

(এ কথা বলে তিনি দাউদ (داوود) শব্দের মাঝে একটি ওয়াও কম লেখা এবং আমর (عمر) শব্দের শেষে একটি ওয়াও অতিরিক্ত লেখার নিয়মের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। অর্থাৎ উচ্চারণের সময় দুই ওয়াও উচ্চারণ হলেও লেখার ক্ষেত্রে داوود না লিখে লিপিরীতি অনুসারে লিখতে হয় داود। আমর শব্দের মাঝে ওয়াও হরফটি উচ্চারিত না হলেও عمر না লিখে লিখতে হয় عمرو।)

উত্তর শুনে মন্ত্রী খুবই মুগ্ধ হলেন। তিনি বিজ্ঞ আলেমকে বললেন, ‘আমার রাজ্যে আপনি সবচে বড় জ্ঞানী। আমি আপনাকে পুরস্কৃত করতে চাই। বলুন, কী চান আপনি? তিনি কেবল বন্দী আলেমদের মুক্তি দাবি করলেন। মন্ত্রী এই প্রজ্ঞাবান আলেমের সুপারিশে বন্দী আলেমদের মুক্ত করে দেন। পাশাপাশি বাগদাদের আলেমদের পুরস্কৃত করে সসম্মানে ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা করেন।

লেখক বলেন, দাউদ পাশা প্রথম কাজটি ঠিক করেছিলেন। তবে দ্বিতীয়টিতে তিনি ভুল করেছেন। তার জায়গায় আমি হলে, ব্যাকরণবিদদের মুক্তি দেয়ার আগে অবশ্যই এই প্রতিশ্রুতি নিতাম যে, তারা এই পুরোনো উদাহরণগুলো বাদ দিয়ে এমন নতুন নতুন আকর্ষণীয় ও জীবনঘনিষ্ট উদাহরণ পেশ করবেন, যা শিক্ষার্থীদের মনে মমতাবোধ জাগিয়ে তুলবে। হিংস্রতা ও রূঢ়তা দূর করবে এবং যায়েদ-আমর এবং খালেদ-বকর এর রক্তারক্তির দৃশ্যপট থেকে তাদেরকে নিষ্কৃতি দেবে।

একজন শিক্ষার্থী তার অর্জিত বিদ্যা থেকে কেবল তখনই উপকার পাবে যখন সে তা প্রয়োগে সক্ষম হবে এবং প্রয়োজনীয় মূহুর্তে এর যথাযথ ব্যবহারে পারদর্শী হবে। আর এ যোগ্যতা তার মাঝে তখনই আসবে যখন উস্তাদ তাদের সামনে কায়দা অনুযায়ী বেশি বেশি উদাহরণ ও উপমা পেশ করবেন। উদাহরণ উপস্থাপনে বৈচিত্র এনে বিষয়টিকে তাদের মস্তিষ্কে এমনভাবে বদ্ধমূল করে দেবেন, যেন মুখস্থ করা কায়দা ও সেগুলোর প্রয়োগের মধ্যকার সম্পর্ক ছাত্রদের মস্তিষ্কে বসে যায়।

বর্তমানে মাদরাসার বেশিরভাগ শিক্ষার্থী প্রায়োগিক বিদ্যা থেকে অনেক দূরে। কারণ তারা প্রতিটি বিষয় জানার ক্ষেত্রে কেবল একটি উদাহরণের মাঝেই ক্ষান্ত থাকে। কোনো একজন শিক্ষার্থীকে যদি বলা হয় যে, সে ইলমে মানতেকে حيوان ناطق, ইলমে নাহুতে ضرب زيد عمرا ইলমে বালাগাতে زيد كالأسد ইলমুছ ছরফে فعلل- افعوعل ছাড়া অন্য কয়েকটি উদাহরণ দিক, দেখা যাবে যে, বিষয়টা তার কাছে খুবই কঠিন ও জটিল বলে মনে হচ্ছে, যবান তার অড়ষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তখন কিতাব-কলম, ভাষা ও গ্রামারের মাঝখানে কাটানো তাদের নিষ্ফল দীর্ঘ বছরগুলোর জন্য খুবই দুঃখ লাগে। আফসোস হয় এই ভেবে যে, জ্ঞানার্জনের এত দীর্ঘ পথ পাড়ি দেয়ার পরও তাদের অর্জনের খাতা শূন্যই রয়ে গেল।

একজন শিক্ষার্থী যদি যেকোনো আরবি কিতাব বা সংবাদপত্র বিশুদ্ধভাবে পড়তে না পারে তবে তার নাহু-সরফ পড়ে কী লাভ? বালাগাত শিখে কী লাভ যদি সে বাক্যের রহস্য/ভেদ এবং এর অলংকারিক দিকগুলো না বোঝে? বিচিত্র বাগরীতি থেকে উদ্দেশ্য বুঝতে এবং বিশুদ্ধ ও অলংকারপূর্ণ ভাষায় যদি নিজের মনের ভাব প্রকাশ করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে ইলমুল বালাগাত শিখে ফায়দা কী? ইলমে মানতেক শিখে কী হবে যদি মাউযু إنسان এবং মাহমুল حيوان ناطق না হয়ে অন্য কিছু হলে قضية صحيحة ও قضية فاسدة এর মাঝে পার্থক্য করতে না পারে?

আশ্চর্যের ব্যাপার কী জানো? একজন অক্ষরজ্ঞানহীণ মূর্খ কারিগরও একথা জানে যে, বাস্তব ক্ষেত্রে কাজে লাগানোর উদ্দেশ্যেই বিদ্যা অর্জন করতে হয়। দরজা, সিন্দুক ও কাঠমাল তৈরির উদ্দেশ্যেই কেবল একজন ব্যক্তি ছুতোর কাজ শিখে। তালা-চাবি তৈরি এবং লৌহকর্ম সম্পাদনের জন্যই একজন লোক কামার বিদ্যা শেখে। অথচ একজন শিক্ষার্থী হয়ে এই অত্যাবশ্যকীয় জ্ঞাতব্য বিষয়টি বোঝে না! ফলে জ্ঞান অর্জনের পথে প্রচুর তথ্য ও নিয়ম-কানুন জানার মাঝেই তার আগ্রহ সীমাবদ্ধ থাকে। বাস্তব জীবনে উপযুক্ত ক্ষেত্রে তা থেকে উপকৃত হওয়ার বিষয়টি তার কাছে তেমন গুরুত্ব পায় না।

যতদিন পর্যন্ত মাদরাসাগুলোতে পাঠদানের এই বন্ধা পদ্ধতি বহাল থাকবে, ভবিষ্যতের জন্য এসকল প্রতিষ্ঠান এমন বিশেষজ্ঞ ব্যক্তি তৈরি করতে ব্যর্থ হবে যাদের দ্বারা বিশ্বব্যাপী উম্মাহ প্রজন্মের পর প্রজন্ম উপকৃত হতে পারে। যা হবে ইলম ও আলেম উভয়ের জন্য ধ্বংসাত্মক ব্যাপার।

-মোস্তফা লুতফি মানফালুতির লেখা থেকে অনূদিত (পরিমার্জিত)

 


আরো সংবাদ



premium cement