০৪ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`


রোমের স্মৃতিচিহ্ন কলোসিয়াম

-

রোম সাম্রাজ্যের কালজয়ী নিদর্শন কলোসিয়াম ইতালির রোম শহরে অবস্থিত একটি ঐতিহাসিক স্থাপনা। পঞ্চাশ হাজার দর্শক ধারণক্ষমতা সম্পন্ন উপবৃত্তাকার ছাদবিহীন এই মঞ্চটির নির্মাণ কাজ শুরু হয় ৭০ থেকে ৭২ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যবর্তী কোন এক সময়ে সম্রাট ভেসপাসিয়ানের রাজত্বকালে। বিখ্যাত রোমান সম্রাট নিরোর শাসনামলের অবসান ঘটলে রোম সাম্রাজ্যের দায়িত্ব গ্রহণ করেন ফ্লেবিয়ন সাম্রাজ্যের শাসক সম্রাট ভেসপাসিয়ান। নিরোর শাসনামলের সময় সম্রাটের প্রতি জনসাধারণের মনে জন্ম নেয়া ক্ষোভ ও ক্রোধের অগ্নিশিখায় পানি ঢালতে সম্রাট ভেসপানিয়াস বিনোদনকেন্দ্র হিসেবে এ স্থাপনাটি নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে ভেসপানিয়াসের পুত্র সম্রাট টাইটাসের তাদারকিতে ৮০ খ্রিষ্টাব্দে স্থাপনাটির কাজ শেষ হয়। প্রায় দশ বছর ধরে চলা স্থাপনাটির নির্মাণ কাজে ষাট হাজার ইহুদি দাসকে নির্মাণশ্রমিক হিসেবে দিন রাত অক্লান্ত পরিশ্রম করানো হয়। তৎকালীন সময়ে বিজ্ঞানের এতটা অগ্রগতি না হলেও গাণিতিক পদ্ধতি মেনে এবং নানা সুক্ষ্ম বৈজ্ঞানিক বিষয়ের প্রয়োগ ঘটিয়ে পুরো কাজটি সম্পন্ন করা সত্যিই সুদূরপ্রসারী চিন্তাভাবনার প্রতিফলন ছিল। এই কলোসিমায়ের আদলেই গড়ে উঠেছে বর্তমান আধুনিক বিশ্বের ক্রিকেট, ফুটবলের স্টেডিয়াম বা গ্যালারি। পাথর ও ক্রংক্রিটে নির্মিত কলোসিয়াম মোট ছয় একর জায়গা জুড়ে অবস্থিত। দৈর্ঘ্যে ১৮৯ মিটার এবং প্রস্থে ১৫৬ মিটার। বাইরের দেয়ালের উচ্চতা ৪৮ মিটার। নির্মাণ কাজ শেষ হলে স্থাপনাটির নাম দেওয়া হয়, ফ্লেবিয়ন এম্পিথিয়েটর (ফ্ল্যাভিয়ান নাট্যশালা)। যা পরবর্তীতে এটি দ্যা রোমান কলোসিয়াম হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। কলোসিয়ামের মঞ্চে বিনোদনের জন্য মূলত গ্ল্যাডিয়েটরদের মল্লযুদ্ধ, হিংস্র পশুদের লড়াই প্রদর্শন করা হতো। ৮০ খ্রিষ্টাব্দে প্রিস্ক্যাস ও ভেরাসে নামে দুজন মল্লযোদ্ধার লড়াইয়ের মাধ্যমে কলোসিয়ামের যাত্রা শুরু হয়। পশুদের গ্যালারির নিচে খাঁচায় বন্দি করে রাখা হতো। পরে মোটা রশি দিয়ে টেনে মঞ্চে তোলা হতো। একই সাথে মঞ্চে একশটি পশু প্রদর্শন করা যেতো। পশুর সাথে লড়াই করে কোন গ্ল্যাডিয়েটর বিজয়ী হলে তাকে বীরের খেতাব দেওয়া হতো। কখনো কখনো লড়াই একটানা একশো দিনের বেশি সময় ধরে প্রদর্শিত হতো। দীর্ঘ এই একশো দিনের বেশি সময়ের লড়াইয়ে গড়পড়তা পাঁচ হাজারের বেশি পশু এবং নয় হাজারের বেশি গ্ল্যাডিয়েটর মৃত্যু হতো। অনেক সময় কলোসিয়ামের এই মঞ্চে বন্দি দাসদের হিংস্র পশুর সাথে ছেড়ে দেয়া হতো। নিরস্ত্র অসহায় দাস পশুর হিংস্র থাবায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তো। দাসের করুণ আর্তচিৎকারের পৈশাচিক এই রক্তখেলা গ্যালারিতে বসে উপভোগ করতেন স্বয়ং সম্রাট এবং হাজার হাজার দর্শক। লড়াইয়ের জন্য সুদূর আফ্রিকা ও পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে সহস্র হাতি, গন্ডার, সিংহ, ভাল্লুক কিনে আনা হতো। এই মঞ্চে হিংস্র পশুর সাথে অপরাধীকে ছেড়ে দিয়ে অপরাধীর শাস্তি বা মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত কার্যকর করা হতো। ধারণা করা হয়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যতটা না রক্তপাত হয়েছে তার চেয়ে বেশি রক্ত ঝরেছে কলোসিয়ামের এই মঞ্চে। কলোসিয়ামের মঞ্চে ছোট ছোট ফুটোর নিচে বালির স্তর রাখা থাকতো। যেন মঞ্চের রক্ত দ্রুত বালি শোষণ করে নিতে পারে। রোমকে শান্তির দেশ বলা হলেও অনেকে অমানবিকতার আরেক নাম বলে থাকেন রোমের এই কলোসিয়ামকে। ৪০৪ খ্রিষ্টাব্দে সম্রাট অনারিয়াস কলোসিয়ামের এই রক্তখেলা বাতিল করেন। ১৭৪৯ সালে পোপ বেনডিক্স নিহতদের আত্মার শান্তি কামনায় কলোসিয়ামকে ‘শান্তির মন্দির’ বলে ঘোষণা করেন। কলোসিয়ামের এই স্থাপনা বিনোদন ছাড়াও বিভিন্ন সময় আবাসন স্থান, প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, সৈন্যদের ব্যারাক এবং দুর্গ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। নির্মাণের পর থেকে কয়েকবার অগ্নিকাণ্ড এবং ৪৪৩ খ্রিষ্টাব্দ ও ১৩৪৯ খ্রিষ্টাব্দে দুইবার শক্তিশালী ভূমিকম্পে স্থাপনাটি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। পরবর্তীতে ১৯৯০ সালে ইতালি সরকার এটিকে নতুন রূপে সংস্কার করেন আকর্ষণীয় করে তোলেন। একই বছরে ইউনোস্কো কলোসিয়ামকে বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী অঞ্চলের মর্যাদা দেয়। ২০০৭ সালে এটি মানুষের সৃষ্টি আধুনিক সপ্তাশ্চর্যে স্থান দখল করে নেয়। বিশ্বের সবচেয়ে বড় এম্পিথিয়েটার হিসেবে কলোসিয়ামের রয়েছে গিনেস রেকর্ড। এত বড় এম্পিথিয়েটার পৃথিবীতে আর কোথাও নির্মিত হয়নি। অমানবিক নিষ্ঠুরতার সাক্ষী এবং অসাধারণ নির্মাণশৈলিতে নির্মিত এই ঐতিহাসিক স্থাপনাটি দেখতে বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে প্রতি বছর পাঁচ মিলিয়ন ভ্রমণ পিপাসু দর্শনার্থী ভিড় জমান।


আরো সংবাদ



premium cement