২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

শীতের উৎসব শীতের পিঠা

-

পিঠাপুলির দেশ বাংলাদেশ। বাঙালির ইতিহাস-ঐতিহ্যের সাথে পিঠাপুলি অত্যন্ত নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে। ভাতের পরে একচেটিয়া বাঙালির খাদ্যসংস্কৃতিতে সবচেয়ে বেশি অভ্যস্ত পিঠাপুলিতে। এ দেশের লোক ইতিহাস-ঐতিহ্যে পিঠাপুলি ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। আবহমান কাল থেকে লক্ষ করা যায় পিঠা লোকজ ও নান্দনিক সংস্কৃতিরই স্বতন্ত্র ধারা। প্রচলিত পিঠায় ধরে রাখে আত্মীয়বন্ধন। আত্মীয়স্বজনদের বাড়ি পিঠা পাঠানো এ দেশের সমাজ-সংস্কৃতির বড় একটি রীতি। সমাজে এ রীতি বা নিয়ম পালন হয়ে আসছে বহু বছর ধরে। পিঠা শীতকালেই মজাদার খাবার হিসেবে দেখা যায় বাঙালির ঘরে ঘরে। পিঠা খাওয়া শুরু হয় মাঘ মাসে আর শেষ হয় ফাল্গুনে। চৈত্রেও কিছু কিছু পিঠা খাওয়া হয় কিন্তু তখন পিঠার স্বাদ-গন্ধ শীত মৌসুমের মতো তত সজীব থাকে না। কেননা নতুন ধানের চালের সুঘ্রাণ ও আর্দ্রতা পুরনো চালের আটার মধ্যে তত দিনে আদৌ নিহিত নয়। পুরনো হওয়ার সাথেই সাথেই ধান দ্রুত আর্দ্রতা হারায়ি ফেলে। ফলে পুরনো চালের তৈরি আটায় পিঠা সুস্বাদু হয় না নতুন চালের আটার মতো। হেমন্তে নতুন ধান এলে গ্রাম-বাংলার নারীরা চালের গুঁড়ো বানাতে ঢেঁকির সাহায্যে। এখন আর গ্রাম-বাংলায় এ চিত্র দেখাই যায় না। কলের মেশিনের দৌরাত্ম্যে হারিয়ে গেছে ঢেঁকি। কিন্তু পিঠা হারায়নি। সে স্বমহিমায় আমাদের খাদ্য তালিকায় রাজকীয়তার সাথে সুমিষ্ট ঘ্রাণ ছড়িয়ে আন্দোলিত করে প্রাণকে। রন্ধনপ্রণালী অনুযায়ী পিঠা সাধারণত ‘ভাজা ও ভাপা’ এই দুই রকমের হয়। শীতের পিঠা বেশির ভাগ মিষ্টি হলেও সেই মিষ্টি স্বাদ একই রকম নয়। মিষ্টি, নোনতা, পানসে ও ঝাল স্বাদের ভিন্নতার কারণে কোনো পিঠা বেশি মজাদার তা বলা অনেকটা কঠিন। পিঠারাও যেন তাদের নিজেদের মধ্যে স্বাদের প্রতিযোগিতায় নেমেছে। যেমনÑ গরম ভাপে তৈরি ভাপা পিঠা, নকশা করে তৈরি নকশি পিঠা, দুধে ভিজে চিতই হয় দুধ চিতই, লবঙ্গের ঘ্রাণে সাজে লবঙ্গ লতিকা, মুঠ পাকিয়ে সেদ্ধ হলে হয় মুঠোপিঠা, ডিম ভেঙে পাতলা কাই করে তৈরি করা হয় খোলাজালি পিঠা-(এ পিঠার উৎপত্তিস্থল নোয়াখালী জেলায়)। এই একই পদ্ধতিতে তৈরি হয় চিতই পিঠাও। আবার ময়দা, চালের গুঁড়ো, চিনি, দুধ, ক্ষীর, নারিকেল প্রভৃতি মিশ্রণে তৈরি হয় পাটিসাপটা পিঠা, চালের গুঁড়ো, চিনি ও নারকেল কুরো দিয়ে তৈরি করা হয় সবারই প্রিয় পুলি পিঠা। এ ছাড়াও গোলাপ ফুলের আকারে হলো গোলাপ পিঠা, কুলি, বিয়ের বিশেষ বিবিয়ানা পিঠাসহ প্রায় ১৫০ প্রকারের পিঠা রয়েছে বাংলাদেশে। তন্মধ্যে প্রচলন দেখা যায় মাত্র ৩০ প্রকারের পিঠা। রাজধানী ঢাকায় ফুটপাথে, গলির মোড়ে মোড়ে শহরবাসীদের শীতের পিঠা খেতে দেখা যায় উৎসবে সাথে। এখানে পাওয়া যায় চিতই, ভাপা, ফুয়া, পাটিসাপটা, রসের পিঠা প্রভৃতি। এর মধ্যে জনপ্রিয়তার শীর্ষে আছে ভাপা ও চিতই পিঠা। আর চিতই পিঠা খাওয়ার জন্য রয়েছে বিভিন্ন ধরনের ভর্তা। যেমনÑ সর্ষে ভর্তা, ধনে পাতা ভর্তা, শুঁটকি ভর্তা, মুরগির জোল প্রভৃতি। সংস্কৃত সাহিত্য অনুযায়ী ভারতীয় উপমহাদেশে প্রাচীন সময় থেকে পিঠা খাওয়ার চল। প্রায় ৫০০ বছরের পুরনো বই অন্নদামঙ্গল, চৈতন্যচরিতামৃত কাব্য ও ময়মনসিংহ গীতিকার কাজল রেখা আখ্যানে পিঠার উল্লেখ রয়েছে মজাদার খাবার হিসেবে। পিঠা বানানো ও খাওয়ার কথা প্রাচীন বইগুলোতেও থাকার সূত্রে বলা যায় পিঠা খাওয়ার রেওয়াজ বাঙালি সমাজে বহু প্রাচীন। তা ছাড়া টুনাটুনির পিঠা খাওয়ার গল্প প্রচলিত রয়েছে বহুকাল থেকেই। এই পিঠা খাওয়াকে কেন্দ্র করেই বাংলাদেশের বিখ্যাত কবি সুফিয়া কামাল তার ‘পল্লী মায়ের কোল’ কবিতায় উল্লেখ করেনÑ ‘পৌষ পার্বণে পিঠা খেতে বসি খুশীতে বিষম খেয়ে
আরও উল্লাস বাড়ায়াছে মনে মায়ের বকুনি পেয়ে’
বাংলাদেশের গ্রামীণ কৃষি-সংস্কৃতির সাথে বেড়ে ওঠা আপামর জনগণ সারা বছর পিঠা খায় না। হেমন্তে নতুন ধানের পর আসে নবান্ন। তখনই নতুন ধান থেকে গৃহিণীরা তৈরি করে চাল ও চালের গুঁড়ো। মাঘের শুরুতে থেকে ফাল্গুন পর্যন্ত বাঙালির ঘরে ঘরে চলতে থাকে শীতের পিঠা খাওয়ার উৎসব। হ


আরো সংবাদ



premium cement