২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

শ্রাবণের বৃষ্টি

-

ঘুম ভাঙতেই দেয়াল ঘড়িটার দিকে লক্ষ করে দেখি সকাল ৯টা ১৫ মিনিট। নিত্যদিনের তুলনায় আজকের ঘুমটা একটু বেশিই হয়ে গেল। রাস্তায় অনেক জ্যামÑ ১০টার মধ্যে যেভাবেই হোক অফিসে পৌঁছাতে হবে; তাই নাশতা করার সময়টুকুও পেলাম না। ঘর থেকে বের হয়ে দেখি চা দিক অন্ধকার; মনে হয় এক্ষুণিই বৃষ্টি নামবে। মুহূর্তেই বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। শ্রাবণের বৃষ্টি কিছুতেই থামার উপায় নেই, পড়ছে তো পড়ছেই...। অফিসে আর যাওয়া হলো না; কাকভেজা হয়ে বাসায় ফিরে এলাম। ভেজা কাপড় পাল্টিয়ে- এক মগ কফি হাতে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম শ্রাবণের বৃষ্টি আর সেইসাথে হারিয়ে গিয়েছিলাম ফেলে আসা দুই বছর আগের এমনই এক শ্রাবণের দিনে। কলেজ লাইফ শেষ করে যখন ভার্সিটিতে ভর্তি হই, তখন থেকেই নীলিমার সাথে প্রথম পরিচয়; তারপর বন্ধুত্ব। বন্ধুত্ব থেকে ভালো লাগা, ভালো লাগা থেকে ভালোবাসা, ভালোবাসা থেকে একসময় দু’জন সারাজীবন একসঙ্গে থাকার সিদ্ধান্ত নিলাম। অবশেষে পারিবারিকভাবে আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে চার হাত এক করে বিয়েবন্ধনে আবদ্ধ হলাম। বিয়ের ঠিক ছয় মাস পর হঠাৎ একদিন অফিস থেকে বাসায় ফেরার পর নীলিমার মুখে শুনতে পেলাম আমি নাকি বাবা হতে চলেছি। মুহূর্তেই যেন পৃথিবীর সব সুখ এসে পায়ের কাছে গড়াগড়ি খাচ্ছে। কী করব, কোথায় যাবো কিছুই ভেবে পাচ্ছি না। বাবা হওয়ার আনন্দ যে কতটুকু তা বলে বোঝানো যাবে না। সেদিন পুরো মহল্লায় মিষ্টি বিতরণ করেছিলাম। তারপর একের পর এক দিন চলে যাচ্ছে আর নীলিমার গর্ভে আমার অনাগত সন্তান বড় হচ্ছে। ১০ মাস পূর্ণ হওয়ার পর হঠাৎ একদিন নীলিমার প্রসব ব্যথা ওঠে; সাথে সাথে হসপিটালে নিয়ে গেলাম। ঘণ্টাখানেক পর ডাক্তার এসে বললেন- আপনার কন্যাসন্তান হয়েছে; আর...। আর কী ডাক্তার সাহেব? আমার নীলিমা কেমন আছে? সরি আপনার স্ত্রীকে বাঁচাতে পারলাম না। মুহূর্তেই বিশাল আকাশটা ভেঙে পড়ল মাথায়।
ডাক্তারের শার্টের কলারে ধরে... ডাক্তার সাহেব আপনি মিথ্যে বলছেন- আমার নীলিমা কখনোই আমাকে ছেড়ে যেতে পারে না। এক দৌড়ে অপারেশন কেবিনে গিয়ে দেখি সাদা কাপড় অঙ্গে জড়িয়ে চিরনিদ্রায় শুয়ে আছে আমার নীলিমা। নীলিমা অ-নীলিমা, এমন তো কথা ছিল না, পৃথিবী নামের মায়াজালের এই সংসারে আমি থাকব তুমি থাকবে না? বলেছিলে একসাথে হাসব, একসাথে কাঁদব; একসাথে বাঁচব আর কোনো দিন যদি এই মায়ার পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হয় তা হলে এক সাথেই যাবো। তবে কেন কঠিন প্রতিশ্রুতি দিয়ে আজ তুমিও কথা রাখনি? সেদিন আমার কান্নার ধ্বনিতে ভেঙে পড়ছিল পুরো হসপিটাল। পৃথিবীর নির্মম বাস্তবতা মেনে নিয়ে নীলিমার শেষ স্মৃতি আমার একমাত্র মেয়ে লীলাবতীকে বুকে আগলে ধরে বেঁচে থাকার কঠিন এক জীবনযুদ্ধে নিজেকে সমর্পণ করলাম। লীলাবতীর বয়স যখন ছয় বছর। হঠাৎ একদিন গ্রামের বাড়ি থেকে মা ফোন দিয়ে বললেন- বাবারে কত দিন হয়ে গেল তোর মুখখানা দেখি না, সেই যে কবে একবার বউমা মারা যাওয়ার আগে এসেছিলি, আর তো এলি না। আমার দাদুভাই লীলাবতী কেমন আছে? ওকে দেখতে খুব ইচ্ছা করছে; অফিস থেকে কয়েক দিনের ছুটি নিয়ে তোর এই বুড়ো মাকে দেখে যা বাবা। এখন বর্ষাকাল। চারদিক শুধু পানি আর পানি...। এ বছর আমাদের বিলে অসংখ্য শাপলা শালুকের মিছিল-
দেখতে প্রকৃতির পরিবেশ অসম্ভব ভালো লাগে; লীলাবতীকে নিয়ে নৌকায় চড়ে ঘুরতেও পারবি। ঠিক আছে মা সময় করে আসব। কিছু দিন পর আমি আমার একমাত্র মেয়ে লীলাবতীকে নিয়ে ঢাকা কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে রওনা দিলাম গ্রামের বাড়ি ব্রাক্ষণবাড়িয়া, নবীনগরের উদ্দেশে। অনেক দিন পর ট্রেন জার্নি ভালোই লেগেছিল। ভৈরব স্টেশনে নেমে পড়লাম। ভৈরব থেকে নবীনগরের নৌকায় উঠলাম। কিছুক্ষণ পর নৌকা ছেড়ে দিলো; কিছুটা পথ যাওয়ার পরÑ
সম্ভবত আশুগঞ্জ ফার্টিলাইজার; মুহূর্তেই নীলাকাশ ঢেকে গেল- যেন কালবৈশাখীর কালো আঁধারে। নৌকায় তুলনামূলক যাত্রী অনেক বেশি ছিল। একের পর এক ঢেউ আসছে আর সব যাত্রী মৃত্যুর ভয়ে চিৎকার শুরু করল। আমার ছয় বছরের অবুঝ লীলাবতী আমার বুকে জড়িয়ে চুপটি করে বসে আছে। আমিও অনেক শক্ত করে লীলাবতীকে বুকে জড়িয়ে রেখেছিলাম। হঠাৎ এক ঢেউ এসে যাত্রীসহ নৌকা ডুবিয়ে দিলো নদীর মাঝখানে। সেদিন নিজ চোখে দেখেছিলাম বেঁচে থাকার জীবনযুদ্ধ। দেখেছিলাম আমার নিষ্পাপ লীলাবতীর চোখে বেঁচে থাকার এক পৃথিবী আহাজারি। ঢেউয়ের স্রোতে একসময় লীলাবতীর হাতটা আমার হাত থেকে ছুটে গেল। ঢেউয়ের স্রোতে ভাসতে ভাসতে কখন জানি জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম। জ্ঞান ফেরার পর দেখি হসপিটালে বেডে শুয়ে আছি আর পাশে ডুবে যাওয়া অসংখ্য মানুষের লাশ। শত লাশের ভিড়ে পাগলের মতো খুঁজতে শুরু করলাম আমার লীলাবতীকে। খুঁজতে খুঁজতে একসময় দেখি আমার লীলাবতীর নিষ্পাপ মুখখানা। দুই হাত তুলে ভাগ্য বিধাতাকে ডেকে বললাম- হে ভাগ্য বিধাতা, কী অপরাধ ছিল আমার লীলাবতীর? আর কিছুটা দিন এই পৃথিবীটা দেখার কী অধিকার ছিল না ওর? কী অপরাধ করেছিলাম আমি? এক এক করে- এক জীবনের সব সুখ কেড়ে নিলে। একসাথে সারাজীবন পথচলার প্রিয় মানুষটাকে কেড়ে নিলে- তবুও কোনো অভিযোগ করিনি। আজ আবার সেই মানুষটার শেষ স্মৃতি আমার বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বনও কেড়ে নিলে; তবে কেন- আমাকে বাঁচিয়ে রেখে প্রতি মুহূর্ত দিচ্ছ বেঁচে থেকেও মৃত্যুর স্বাদ? সব ভাবনার শহর ছেড়ে ফিরে এলাম কফির মগ হাতে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শ্রাবণের বৃষ্টি দেখার মুহূর্তে। জ্বলন্ত কফিটা শীতল হয়ে গেল; আর কখন জানি নিজের অজান্তেই গাল বেয়ে অঝোরে ঝরে পড়ছে শ্রাবণের বৃষ্টি।

 


আরো সংবাদ



premium cement