১৯ মে ২০২৪, ০৫ জৈষ্ঠ ১৪৩১, ১০ জিলকদ ১৪৪৫
`


কারুশিল্প মেলা ও লোকজ উৎসব

সোনারগাঁওয়ে কারুশিল্প মেলার মঞ্চে চলছে লোকসঙ্গীত উৎসব; মেলার কারুশিল্প স্টল ঘুরে দেখছেন দুই তরুণী; মেলার মাঠে চলছে গ্রাম-বাংলার বিয়ের প্রদর্শনী -

গ্রাম বাংলার হারিয়ে যাওয়া উৎসব যেন সোনারগাঁওয়ে। নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ে অবস্থিত বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনের বিশাল চত্বরে উৎসব আমেজে আর লালনের একতারার সুরে বেজে উঠছে এ উৎসব। এখানে বসেছে মাসব্যাপী লোককারুশিল্প মেলা।
‘বারো মাসে তেরো পার্বণ’ পালনের ঐতিহ্যের অনুস্মরণে দেশের কৃষিজীবী সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা ও সংস্কৃতি থেকে উৎসারিত লোক ও কারুশিল্পের ঐতিহ্যকে তুলে ধরার লক্ষ্যে গত ১৫ জানুয়ারি শুরু হয়েছে মাসব্যাপী এ মেলা। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় আয়োজিত এবারকার মেলায় পুরনো বাংলা যেন জীবন্ত, সচল হয়ে উঠেছে। প্রতিদিন অগণিত মানুষ কর্মব্যস্ত জীবন থেকে ছুটি নিয়ে আসছে সোনারগাঁওয়ে। গ্রামের প্রতি নাড়ির চিরন্তন টান আর ভালোবাসার আকর্ষণে রাজধানীসহ বিভিন্ন শহরের মানুষও দলবদ্ধভাবে ভিড় করছে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের গড়ে তোলা এ শিল্পগ্রামে।
মেলা উপলক্ষে ফাউন্ডেশনের বিশাল চত্বরকে সাজানো হয়েছে বর্ণাঢ্য সাজে, ভিন্ন আঙ্গিকে ও বর্ণিল ঢঙে। লাল নীল ও সবুজ বাতি দিয়ে মালার মতো করে জড়িয়ে দেয়া হয়েছে ভবনগুলোর ইটের তৈরি শরীরে। এই বাতিগুলো সন্ধ্যা নামতে না নামতেই জ্বলা নেভার লুকোচুরি খেলায় মেতে ওঠে। গতানুগতিকার প্রাচীর ভেঙে অতিথিদের স্বাগত জানানোর জন্য ফাউন্ডেশনের প্রধান ফটকের পাশে ‘কাঁদায় পড়া গরুর গাড়ি’ ভাস্কর্যের সামনের রাস্তার দু’পাশে দুটো বর্ণাঢ্য মুরালে গেট তৈরি করা হয়েছে। মেলা উপলক্ষে বিভিন্ন দেয়ালে চিত্রিত হয়েছে ফাউন্ডেশনের প্রদর্শন কর্মকর্তা এ কে এম আজাদ সরকারের লোকজীবনের চিত্রকল্প ‘মুরাল’। ফাউন্ডেশনের মূল আঙিনা থেকে মেলার বিভিন্ন রঙিন পতাকা শোভিত রাস্তার ধারে ধারে বিভিন্ন লোকজ প্রবাদবাক্য ও খনার বচন সংবলিত প্ল্যাকার্ড ফেস্টুন দিয়ে মেলার পুরো চত্বর সাজানো হয়েছে।
এ ছাড়া এ বছরের মেলার অন্যতম আকর্ষণ হলো গ্রামীণ লোকজ সংস্কৃতির অন্যতম মাধ্যম ‘ভালোবাসার তামা, কাঁসা, পিতল শিল্পের’ শিরোনামে প্রদর্শনী আয়োজন করেছে মেলার আয়োজকরা।
মেলার বিশেষ আকর্ষণ হলো আয়োজক প্রতিষ্ঠানের বিশেষ প্রদর্শনী দেশের প্রথিতযশা কারুশিল্পীদের শিল্পকর্ম নিয়ে ‘কর্মময় কারুশিল্পী’ প্রদর্শনী। এটি মেলার মূল চত্বরের মাঠের মাঝে অবস্থান। এ বিশেষ প্রদর্শনীতে ৩০টি স্টলে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে ৬০ কারুশিল্পী দেশের হারানো ঐতিহ্যকে আবার নতুন করে আবিষ্কার করছে। প্রদর্শনীর গ্যালারিগুলো কারুশিল্পীরা তাদের স্বহস্তে তৈরি করছে ঝিনাইদহ ও মাগুরার শোলা শিল্প, রাজশাহীর শখের হাঁড়ি, চট্টগ্রামের নক্শি পাখা, রংপুরের শতরঞ্জি, সোনারগাঁওয়ের হাতি ঘোড়া পুতুল ও কাঠের কারুশিল্প, নকশিকাঁথা, নকশি হাতপাখা, মুন্সীগঞ্জের শীতল পাটি, মানিকগঞ্জের তামা-কাঁসা পিতলের কারুশিল্প, রাঙ্গামাটি ও বান্দরবান জেলার ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর কারুপণ্য, কিশোরগঞ্জের টেরাকোটা শিল্প, সোনারগাঁওয়ের পাটের কারুশিল্প, নাটোরের শোলার মুখোশ শিল্প, মুন্সীগঞ্জের পটচিত্র, ঢাকার কাগজের হস্তশিল্পসহ ইত্যাদি কারুপণ্য। এখানে শিল্পীরা বসেই তাদের নিপুণ হাতে নিজস্ব মেধা ও মননে তৈরি করছেন বাহারি কারুপণ্য এবং তা প্রদর্শন ও বিক্রি করছে। প্রদর্শনীর গ্যালারিগুলোতে থরে থরে সাজানো কারুপণ্যের পসরা দেখে কেউ কেউ লোভ সামলাতে না পেরে কেনাকাটা করছেন শখের চিত্রিত হাঁড়ি, শোলাশিল্প, কাঠের সামগ্রী, শতরঞ্জি, নকশি কাঁথাসহ বিভিন্ন কারুপণ্য সামগ্রী।
মেলায় আবহমান বাংলার গ্রাম্য সালিস, কনে দেখা, গায়ে হলুদ, বরযাত্রা, জামাইকে পিঠা খাওয়ানো ইত্যাদি লোকজীবন প্রদর্শনী কারুশিল্প মেলার এক পাশে চলছে। আবহমান বাংলার লৌকিক আচার এবং ঐতিহ্যগত সংস্কৃতিই ফুটিয়ে তোলা হচ্ছে এ প্রদর্শনীতে। সোনারগাঁওয়ের বিভিন্ন স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা এতে অংশগ্রহণ করছে। মেলা বরাবরেই নাগরদোলা, বিমান চড়কি, সাপ খেলাতো রয়েছেই।
মেলায় সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, গ্রামীণ ঐহিত্যের বিলুপ্ত প্রায় সব কারুপণ্যের সমাহার ঘটেছে সোনারগাঁওয়ের কারুশিল্প মেলায় ও লোকজ উৎসবে। দেশ-বিদেশের দর্শণার্থী ভিড় করেছেন এ মেলায়।
মেলায় আগত রাজশাহীর শখের হাঁড়িতে আল্পনা আঁকছিলেন সুশান্ত পাল। বিলুপ্তপ্রায় এ হাঁড়ির ইতিহাস বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেন, আগেকার দিনে অ্যালুমিনিয়াম, প্লাস্টিক দ্রব্য ছিল না। গ্রামের লোকজন তাদের মুড়ি, চিড়া, খই ইত্যাদি এ শখের হাঁড়িতে ভরে শিকায় তুলে রাখত। এ ছাড়া গাঁয়ে হলুদ, বিয়ে ও গীত গাওয়া অনুষ্ঠানে এ হাঁড়ি ব্যবহার হতো। মিষ্টি পাঠানোর জন্য নতুন বেয়ান-বেয়াইনদের এ শখের হাঁড়ি ছিল প্রথম পছন্দ।
সোনারগাঁওয়ের জামদানি যা বিলুপ্ত বিখ্যাত মসলিনের পরবর্তী সংস্করণÑ বললেন জামদানি শিল্পী আবু তাহের ও সালাম। তারা জানান, এ শিল্পটি নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ, সোনারগাঁও, আড়াইহাজারে এখনো টিকে আছে। বিশ্বব্যাপী এখনো জামদানি কাপড়ের কদর আছে এমনটি উল্লেখ করে বলেন, একটি ভালো মানের জামদানি তৈরি করতে ছয় মাসও সময় লেগে যায়। আর এখন সোনারগাঁওয়ে ভালো মানের জামদানি দেখা মেলে।
মেলার আয়োজক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনের পরিচালক কবি রবীন্দ্র গোপ জানান, গ্রামের অতি সাধারণ মানুষ গভীর মমতা দিয়ে তাদের সৃষ্টিশীলতায় কারুশিল্প তৈরি করে। এসব কারুশিল্প আমাদের হাজার বছরের ঐতিহ্য। এ বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতির ঐতিহ্য নিয়ে লোক কারুশিল্প এ মেলার আয়োজন করেছে। লোককারুশিল্পের প্রসারের জন্য প্রতি বছরের মতো আকর্ষণীয় বিভিন্ন খেলা, গান, প্রদর্শনী অনুষ্ঠান ছাড়াও এবারের উৎসবে গ্রামবাংলার আর্থসামাজিক জীবনের প্রতিচ্ছবি উপস্থাপন করা হয়েছে বৈচিত্র্যময়ভাবে। এ ছাড়া সোনারতরী লোকজ মঞ্চে লোকজ নাটক, সেমিনারের আয়োজনও আছে মেলায়। প্রতিটি বিকেলে বাউল, লালন, হাসনরাজাসহ নানা গান হচ্ছে। মেলা ও উৎসবে বিলুপ্তির অন্ধকার থেকে উদ্ধার করে বাঙালির শৈশবের সম্পদ গ্রামীণ খেলাধুলা যেমনÑ কানামাছি, বৌচি, এক্কা-দোক্কা, লাঠিখেলা, গোল্লাছুট, দাঁড়িয়াবান্দা, হা-ডু-ডু, ওপেনটি বাইস্কোপ, মোরগ লড়াই, আঁকুনি টুকুনি, ইছোন বিছোন প্রভৃতি খেলাও পরিবেশিত হচ্ছে। এবারের মেলায় মোট স্টল রয়েছে ১৭০টি। মুড়ি মুড়কি, মণ্ডা মিঠাই, চটপটি থেকে শুরু করে গ্রামীণ হস্তশিল্প, বাঁশ, বেত, কাঠ, লোহা, পাটজাত দ্রব্যসামগ্রী বিলুপ্ত প্রায় কুটিরশিল্পের পসরা বসেছে মেলায়। মেলা চলবে আগামী ১৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত।
ছবি : মো: শফিকুর রহমান


আরো সংবাদ



premium cement
ইরানের প্রেসিডেন্টকে বহনকারী বিমান দুর্ঘটনার শিকার ইতিবাচক অবস্থায় নেই অর্থনীতির সূচক কুমিল্লায় ব্যবসায়ী হত্যায় মৃত্যুদণ্ড ৭, কারাদণ্ড ৭ সাময়িক বিনোদন চূড়ান্ত সফলতার পথে অন্তরায় : শিবির সভাপতি ঝিনাইদহের এমপি আজিমের ভারতে নিখোঁজের ব্যাপারে যা জানা গেছে রাজশাহীতে মোটরসাইকেলের কাগজ দেখতে চাওয়ায় ২ পুলিশকে মারধর জিম সেশনে ঘাম ঝরালো বাংলাদেশ দল আশুলিয়ায় নিবন্ধন না থাকায় ২টি হাসপাতাল সিলগালা সরকারের ইচ্ছের অভাবে উচ্চ শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে স্বদেশী ভাষা চালু হয়নি এমপির প্রভাব ও নিরাপত্তার স্বার্থে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ালেন উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থী উপজেলা চেয়ারম্যানদের আয় বেড়েছে প্রায় ৫৫০ শতাংশ : টিআইবি

সকল