০৬ মে ২০২৪, ২৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`


বিজ্ঞান শিক্ষা, বিজ্ঞানী ও ভ্যাকসিনের পক্ষে

-

আমাদের দেশে ক্রমেই বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী কমছে। চার পাশে তাকালে এ পরিবর্তনটা সহজেই চোখে পড়ে। ব্যানবেইসের পরিসংখ্যান অনুসারে, ১৯৯০ সালে মাধ্যমিকে মোট পরীক্ষার্থীর মধ্যে বিজ্ঞানের পরীক্ষার্থী ছিল ৪২.৮১ শতাংশ আর উচ্চমাধ্যমিকে ২৮.১৩ শতাংশ। ১৯৯৬ সালে উচ্চমাধ্যমিকে বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী ছিল মাত্র ১৫.৩৩ শতাংশ। এরপর ২০০২ সালে তা বেড়ে হয় ২৫.৮৪ শতাংশ। তার পর আবার পতনের শুরু এবং ২০১৩ সালে তা নেমে আসে শতকরা ১৭.০১ শতাংশে। ২০১৪ সালে তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেছিলেন, ‘মাধ্যমিক পর্যায়ে বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী কমে যাচ্ছে। শিক্ষার্থীরা বিজ্ঞান শিক্ষায় আগ্রহ দেখাচ্ছে না। আমরা এ বিষয়ে ‘কিছুটা’ উদ্বিগ্ন।’
শিক্ষার্থীরা বিজ্ঞান পড়ার আগ্রহ হারাচ্ছে কেন? মাধ্যমিকে বিজ্ঞান পড়া শিক্ষার্থীদের সাধারণ একটা চিন্তাধারা হচ্ছেÑ বিজ্ঞান পড়া মানেই হচ্ছে ভবিষ্যতে ডাক্তার বা প্রকৌশলী হওয়া এবং তাদের মতে, এটার ক্ষেত্র খুব সীমিত। তবে অন্য একটা কারণও খুব স্পষ্টÑ বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানীদের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি। বৈশ্বিক মহামারী করোনাভাইরাসের প্রতিষেধক হিসেবে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠান ‘গ্লোব বায়োটেক’ যখন ভ্যাকসিন আবিষ্কারের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিলো তখন আমাদের অনেকের অনাগ্রহ, ক্ষেত্রবিশেষে তাচ্ছিল্য ছিল অবাক করার মতো! বরাবরের মতো সব থেকে এগিয়ে ছিলেন ‘নেটিজেন’রা এবং চিকিৎসাবিজ্ঞানে অল্প জ্ঞান আছে কিন্তু পেশায় বা নেশায় চিকিৎসক ননÑ এই দলটি।
এর আগে যখন বাংলাদেশ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা: তারেক আলম অ্যান্টিপ্রোটোজোয়াল মেডিসিন ইভারমেকটিনের সিঙ্গল ডোজের সাথে অ্যান্টিবায়োটিক ডক্সিসাইক্লিন প্রয়োগে করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে সাফল্য পাওয়ার কথাটি ঘোষণা এবং এ বিষয়ে আরো পরীক্ষা হওয়া প্রয়োজন বলে অভিমত ব্যক্ত করেছিলেন, তখনো এ দলটি একই রকম অনাগ্রহ ও তাচ্ছিল্য দেখিয়েছিল। পরে এ দু’টি ওষুধের ব্যবহারের নিরাপত্তা ও কার্যকারিতা যাচাইয়ের লক্ষ্যে আইসিডিডিআর,বি ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু করেছে। নিজে যখন সাসপেকটেড প্যাসেন্ট হিসেবে দেশের একটি বেসরকারি হাসপাতালের রেসপিরেটরি মেডিসিন কনসালট্যান্টের শরণাপন্ন হই, তখন আমাকেও ইভারমেকটিন প্রেসক্রাইব করা হয়েছিল।
যারা গ্লোব বায়োটেকের ভ্যাকসিন নিয়ে তাচ্ছিল্য ও ‘ট্রল’ করেছেন, তারা হয়তো প্রতিষ্ঠানটির রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ডিপার্টমেন্টের প্রধান, মাইক্রোবায়োলজিস্ট ড. আসিফ মাহমুদের চোখ ছলছল করে ওঠা দেখেছেন। কিন্তু তার শেষের দিকে উচ্চারণ করা কথাটি শোনেননিÑ ‘ওরা যদি পারে, আমরাও পারব।’ অথচ এই নেটিজেনরাই দফায় দফায় ট্রায়াল দিয়ে ব্যর্থ হওয়া বিভিন্ন উন্নত দেশের ভ্যাকসিন আবিষ্কারে খবর শেয়ার দিতে দিতে টাইমলাইন ভরে ফেলেছেন। অনেকেই ভ্যাকসিন নিয়ে সন্দেহ করছেন। সমালোচনাকারীদের ভাবা উচিত, ভ্যাকসিনটা যদি শেষ পর্যন্ত সফল নাও হয়, তাতেও আমাদের অনেক কিছু অর্জন করার সুযোগ থাকবে।
ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছেন, ‘যে দেশে গুণের সমাদর নেই, সে দেশে গুণী জন্মাতে পারে না।’ তাই সমাজে তথা রাষ্ট্রে যেসব গুণী ব্যক্তি মানুষের কল্যাণে কাজ করেন তাদের অন্তত প্রাপ্য সম্মানটুকু দেয়া আমাদের কর্তব্য। আমরা যদি প্রচেষ্টার শুরুতেই তাদের নিরাশ করি, তা হলে সফলতার মুখ দেখব কিভাবে? আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, সমালোচনা করার আগে আমরা ভুলে গেলাম, যারা আমাদের জন্য কিছু আবিষ্কার করার চেষ্টা করছেন তারা সবাই ডাক্তার, বিজ্ঞানী বা গবেষক; কমার্স পড়ুয়া এক্সিকিউটিভ বা বিসিএস করা অফিসার নন! যারা প্যাসেন্টদের ইভারমেকটিন প্রেসক্রাইব করছেন তারা সবাই রেজিস্টার্ড ফিজিশিয়ান।
কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কোনো কিছু আবিষ্কার করে ফেললেই আমরা তা ব্যবহার করি না। গণস্বাস্থ্য-আরএনএ বায়োটেক গবেষকরা ‘জি র্যাপিড ডট ব্লট’ নামে যে কিট আবিষ্কার করেছেন, তা কিন্তু আমরা এখনো ব্যবহার করতে পারছি না। কাজেই গ্লোব বায়োটেক ভ্যাকসিন আবিষ্কার করে ফেললেও আমরা সাথে সাথে তা ব্যবহার করতে পারব না। দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক সংস্থার অনুমোদনসাপেক্ষে সেটি ব্যবহার করা হবে। এখন ভ্যাকসিনটি নিয়ে দ্বিতীয় ধাপে অ্যানিমেল মডেলে ট্রায়াল করা হবে। এরপর এটি মানবদেহে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে যাবে। সে জন্যও বাংলাদেশ চিকিৎসা গবেষণা পরিষদের (বিএমআরসি) অনুমতি লাগবে।
আমাদের ক্রিকেট দল বা কাবাডি দল যদি কোনো টুর্নামেন্টে জয় পায়, তখন আমরা তাদের লালগালিচা সংবর্ধনা দেই। তা হলে বিজ্ঞানী, গবেষক, চিকিৎসকদের বেলায় আমাদের এই দীনতা কেন? আমরা যদি করোনাভাইরাসকে পরাজিত করতে চাই, তা হলে আমাদের চিকিৎসাবিজ্ঞানী ও গবেষকদের উপরেই আস্থা রাখতে হবে; আইনজীবী কিংবা ব্যাংকাররা করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন আবিষ্কার করবেন না। সে জন্যই আমাদের সন্তানদের বিজ্ঞান পড়তে উৎসাহ দিতে হবে। ড. আসিফ মাহমুদ ও ড. বিজন কুমার শীলদের মতো বিজ্ঞানীদের ধন্যবাদ, তারা সরকারি চাকুরে হননি; হলে হয়তো আমরা এসব সাফল্য দেখতে পেতাম না।
শিক্ষকতা পেশা ছেড়েছি আজ প্রায় দেড় বছর। যদি আজো শিক্ষক থাকতাম, তা হলে সংবাদ সম্মেলনে ড. আসিফ মাহমুদের উপস্থাপনাটার ভিডিওটা দেখাতাম আমার শিক্ষার্থীদের। তার উপস্থাপন, জ্ঞান, আত্মবিশ্বাস দেখাতাম; দেশের জন্য ভালোবাসা দেখাতাম। আমার শিক্ষার্থীদের প্রেরণা দিতাম বড় হয়ে বিজ্ঞানী হতে, বিজ্ঞান পড়তে। বিগত বেশ কিছু বছরে আমরা অনেক সিভিল সার্ভিস অফিসার পেয়েছি। আমাদের দেশ এখন কমার্স পড়ুয়া বেসরকারি এক্সিকিউটিভ আর বিসিএস উত্তীর্ণ সরকারি অফিসারে পরিপূর্ণ; সেই তুলনায় বিজ্ঞানী বা গবেষক তৈরি হননি। চাকুরে হওয়ার জন্য লেখাপড়া না করে বিজ্ঞানী বা গবেষক হওয়ার জন্য লেখাপড়া করা উচিত।
আমেরিকান যুক্তিবিদ ও দার্শনিক নোয়াম চমস্কি বলেছেন, ‘উই উইল ওভারকাম করোনাভাইরাস, বাট উই হ্যাভ মোর সিরিয়াস ক্রাইসিস অ্যাহেড অব আস।’ এখন আমরা যদি ভবিষ্যতের সেসব ক্রাইসিস মোকাবেলা করতে চাই, তাহলে আমাদের দরকার বিজ্ঞান শিক্ষা এবং বিজ্ঞান জানা মানুষ। কাজেই আমাদের শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞান পড়ার আগ্রহ থাকতে হবে। এখানে রাষ্ট্রের দায়িত্ব ব্যাপক। আমাদেরও দায়িত্ব আছেÑ বিজ্ঞান, বিজ্ঞানী ও চিকিৎসকদের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধাবোধ বাড়াতে হবে, তাদের প্রাপ্য সম্মান তাদের দিতে হবে। নভেল করোনাভাইরাস মোকাবেলায় দেশের প্রত্যেক চিকিৎসক, চিকিৎসাবিজ্ঞানী ও গবেষকদের প্রচেষ্টাগুলো সফলতায় পরিণত হোকÑ এই প্রত্যাশা। হ
লেখক : উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাধ্যক্ষ, এমফিল গবেষক (পেডাগজি), স্কুল অব এডুকেশন, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়। nazrul.russell@gmail.com

 


আরো সংবাদ



premium cement