২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ঢাকার খালগুলো

-

রাজধানী ঢাকা থেকে একে একে উধাও হয়ে যাচ্ছে এক সময়ের প্রাণবন্ত খালগুলো। ঢাকার যোগাযোগ ক্ষেত্রে যে খালগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখত তার বেশির ভাগ এখন দখলদারদের কবলে পড়ে অস্তিত্ব হারিয়েছে। বাকি অংশ দখল ও দূষণে পরিণত হয়েছে নোংরা নালায়। নদী, খাল, লেকসহ প্রাকৃতিক জলাশয় সুরক্ষায় বর্তমান সরকার আমলে অঙ্গীকারবদ্ধ ভূমিকা রাখার কথা বারবার বলা হলেও তা রক্ষায় কাক্সিক্ষত সাফল্য আসেনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অবহেলায়। গত আট বছরে ঢাকার ১১টি খাল নর্দমা ময়লা-আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। আবর্জনায় জমাটবাঁধা খালের নর্দমায় খুঁটি পুঁতে পাটাতন বসিয়ে বস্তি তোলা হয়েছে। স্থায়ীভাবে আটকে গেছে পানিপ্রবাহের পথ। ৩০-৩২ বছর আগেও ঢাকার প্রান্তসীমায় স্রোতস্বিনী এসব খালে পণ্যবাহী বড় বড় নৌকার আনাগোনা ছিল, সেসব খাল এখন দুই-আড়াই ফুট চওড়া নর্দমার রূপ ধারণ করেছে।
ঢাকা ওয়াসার তথ্যানুযায়ী, দখলবাজদের আগ্রাসী থাবায় ৩০ বছরেই অন্তত ৩৯টি খালের অস্তিত্ব নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। এমনকি সরকারি ওই দফতরে খালগুলোর কোনো নথিও নেই। ওয়াসার একশ্রেণীর কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশে প্রভাবশালী মহল বছরের পর বছর ধরে খাল দখলের মহোৎসব চালিয়ে আসছে। তারা প্রথমেই খালের নির্দিষ্ট কোনো পয়েন্টে আড়াআড়ি বাঁধ দিয়ে পানিপ্রবাহ বন্ধ করে দেয়। পরে বাঁধ ঘেঁষে রাতারাতি গড়ে তোলে বস্তিঘর। ওয়াসা কর্মকর্তাদের মাধ্যমে খালের মূল নথিপত্র বের করে সে আদলেই মালিকানা-সংক্রান্ত জাল কাগজপত্র বানিয়ে নেয় তারা। এরপরই বস্তিবাসীকে খালের অন্য অংশে সরিয়ে ওই জায়গা প্লট আকারে বিক্রি করে দেয় প্রভাবশালী দখলবাজরা। রাজধানীর খাল, বিল, লেক, বিলঝিল ভরাট ও অপদখলের শিকার হওয়ায় রাজধানীর পরিবেশ বিপন্ন হয়ে পড়েছে। যে প্রাকৃতিক জলাশয়গুলো মানুষের হৃদরাজ্য ভালো লাগার অনুভূতি সৃষ্টি করত; সেগুলোর মধ্যে যেগুলো টিকে আছে; তা মশা প্রজননের উর্বর ক্ষেত্র হয়ে পড়েছে। দখল-দূষণে সেগুলোরও অস্তিত্ব এখন বিপন্নের পথে। রাজধানীতে মানুষ বসবাসের পরিবেশ টিকিয়ে রাখার পাশাপাশি পানি নিষ্কাশনের সুবিধা নিশ্চিত করতে দখল করা খাল উদ্ধারের উদ্যোগ নেয়া দরকার। যেগুলোর অস্তিত্ব এখনো কোনোরকমে টিকে আছে; সেগুলোর সংস্কারও জরুরি। এ ব্যাপারে সরকার, সিটি করপোরেশন সবার অঙ্গীকারবদ্ধ ভূমিকা প্রত্যাশিত।
ঢাকার প্রাণ সঞ্চারকারী নদী বুড়িগঙ্গার সাথে এক সময় সরাসরি নৌপথের সংযোগ ছিল রাজধানীর বিভিন্ন খালের। সারা ঢাকার জলযান চলত এসব খাল দিয়ে। কিন্তু সে দৃশ্য এখন কল্পনাতীত। হবেই বা না কেন, খাল কোথায়? কাগজ-কলমে থাকলেও বাস্তবে নেই। যে কারণে পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা হুমকির মুখে পড়েছে। পানি নিষ্কাশনের দু’টি পথ। প্রথমত, ভূগর্ভে পানি শোষণ করে নেয়া এবং অন্যটি খালবিল বা ড্রেন দিয়ে নদীতে চলে যাওয়া। রাজধানী ঢাকায় এই দু’টি পথের একটিও কার্যকর নেই। যে কারণে জলাবদ্ধতা বাড়ছে। এ থেকে মুক্তি পেতে হলে জনগণকে সম্পৃক্ত করে পরিকল্পিত উপায়ে সরকারকে খাল উদ্ধার করতে হবে। প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বিদ্যমান খালগুলোর মধ্যে রামচন্দ্রপুর খাল ১০০ ফুটের জায়গায় ৬০ ফুট, মহাখালী খাল ৬০ ফুটের জায়গায় ৩০ ফুট, প্যারিস খাল ২০ ফুটের স্থলে ১০-১২ ফুট, বাইশটেকি খাল ৩০ ফুটের স্থলে ১৮-২০ ফুট, বাউনিয়া খাল ৬০ ফুটের বদলে ৩৫-৪০ ফুট, দ্বিগুণ খাল ২০০ ফুটের বদলে ১৭০ ফুট, আবদুল্লাহপুর খাল ১০০ ফুটের বদলে ৬৫ ফুট, কল্যাণপুর প্রধান খাল ১২০ ফুটের স্থলে স্থানভেদে ৬০-৭০ ফুট, কল্যাণপুর ‘ক’ খালের বিশাল অংশে এখন সরু ড্রেন, রূপনগর খাল ৬০ ফুটের স্থলে ২৫-৩০ ফুট, কাটা সরু খাল ২০ মিটারের বদলে ১৪ মিটার, ইব্রাহিমপুর খালের কচুক্ষেত সংলগ্ন মাঝামাঝি স্থানে ৩০ ফুটের স্থলে ১৮ ফুট রয়েছে। এসব খালের অধিকাংশ স্থানে প্রভাবশালীরা দখল করে বহুতল ভবন, দোকানপাট ও ময়লা-অবর্জনায় ভরাট করে রেখেছে। ফলে খালে পানিপ্রবাহ বন্ধ হয়ে গেছে। অনেক জায়গায় বিলীন হয়ে গেছে।
রাজধানীর খিলগাঁও রেলগেট ফ্লাইওভার-সংলগ্ন ফার্নিচার দোকানগুলোর সামনে খিলগাঁও-বাসাবো খালের নামসংবলিত ঢাকা ওয়াসার একটি ফলক রয়েছে। এতে খাল দখলমুক্ত রাখতে সচেতনতামূলক বিভিন্ন কথা লেখা রয়েছে। তবে ফলকটির আশপাশের কোথাও খালের কোনো অস্তিত্ব নেই। আর একটি ঐতিহ্যবাহী খালের নাম ছিল ধোলাইখাল। এটির নামের সাথে মানুষ পরিচিত রয়েছে বটে; তবে এ খালের ওপর নির্মিত হয়েছে বহুতল অট্টালিকা। এ ছাড়া যতটুকু খাল অবশিষ্ট আছে, তাও যেন মৃত্যুপথযাত্রী। শীর্ণকায় নর্দমায় পরিণত হয়েছে। দখল-দূষণে শীর্ণ রাজধানীর খালগুলো দিন দিন অরক্ষিত হয়ে পড়ছে। ড্রেন হয়ে বয়ে চলা এসব খাল এক দিকে যেমন পরিবেশ দূষণ করছে, তেমনি এর ভেতরে পড়ে প্রাণহানির ঘটনাও কম নয়। সম্প্রতি খালে ডুবে শিশু মৃত্যুর ঘটনা বাড়ছে। দেখা গেছে, দখল হয়ে যাওয়া খালগুলোর পাশে নিম্ন আয়ের মানুষের বাসস্থান। নর্দমা ভরে থাকায় বেখেয়ালে শিশুরা যখন খালে ডুবে যায়; তখন উদ্ধার করা কষ্টকর হয়ে পড়ে। গৃহস্থালি ও শিল্প বর্জ্য নিক্ষেপে বর্জ্যরে ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে রাজধানীর খালগুলো। যে কারণে টানা বর্ষণে পানির প্রবাহ আটকে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে। এ থেকে উত্তরণে বাড়াতে হবে নাগরিক সচেতনতা। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিকে হতে হবে কর্মতৎপর। এখনো যতটুকু খাল রয়েছে; সেগুলো উদ্ধার করে খালের আকার ধারণ করানো গেলে কমবে রাজধানীর জলবদ্ধতা। ঢাকাকে বাঁচাতে হলে দখলদারদের হাত থেকে খালগুলো উদ্ধার করে সেসব পুনঃখনন করতে হবে। খাল প্রাণ পেলে মুমূর্ষু ঢাকাতেও প্রাণসঞ্চার হবে। হ
লেখক : সহসভাপতি, এফবিসিসিআই; সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতি ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক,
ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ড লিমিটেড


আরো সংবাদ



premium cement