২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

অনলাইন উদ্যোক্তাদের দিনকাল

-

ফেসবুককে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে স্বল্প পুুঁজিতেই উদ্যোক্তা হয়ে উঠেছেন নারীরা। ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ই-ক্যাব) তথ্য বলেছে, এখন দেশে প্রায় ২০ হাজার ফেসবুক পেজে কেনাকাটা চলছে। এর মধ্যে ১২ হাজার পেজ চালাচ্ছেন নারীরা। নারী উদ্যোক্তাদের কেউ পোশাক, কেউ গয়না,কেউ হাতে তৈরি জিনিস, কেউ তৈরি খাবারসহ নানা পণ্য বিক্রি করছেন। অনেকে দেশীয় সংস্কৃতিকে তুলে ধরার কাজ করছেন। কেউ শৌখিন পণ্যকে নিয়ে ব্যবসায় নেমেছেন। এই নারীরা শিক্ষিত। এমনই কয়েকজন অনলাইন উদ্যোক্তার কথা লিখেছেন বদরুন নেসা নিপা


বাধা জয় করেই সফলতা পাবো
রাহি ইসলাম
রাহিস স্পাকেল

নিজের একটা আলাদা পরিচয় থাকতে হবে। কিছু করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। একজন সফল উদ্যোক্তা হতে চাই। তাই এই অনলাইন বিজনেসে আসা। অ্যাকাউন্টিংয়ে পোস্ট গ্রাজুয়েশন করেছি। পাশাপাশি দুই বছর হলো আমার অনলাইন পেজ ‘রাহিস স্পারকেলের’ যাত্রা। কথাগুলো রাহির। অল্প কিছু নিজের জমানো টাকা দিয়ে মেয়েদের পোশাক কিনে ফেসবুক পেজ খুলে ব্যবসা শুরু করলাম। প্রথম দিকে কেউই তেমন সাহস দেয়নি। অনেক ধৈর্য ধরেছি, পরিশ্রম করেছি, নিজের ওপর বিশ্বাস রেখেছি। ধীরে ধীরে সফলতার মুখ দেখতে পাই। অনলাইন ব্যবসা পরিচালনা করা খুব চ্যালেঞ্জিং একটা কাজ। এই প্রফেশন এতটা সহজ নয়। অনলাইনের বিজনেসের প্রথম শর্তই হলো ক্রেতা এবং বিক্রেতার মধ্যে ভালো সম্পর্ক তৈরি হওয়া, পণ্যের মান, সঠিক মূল্য উপস্থাপন করা এবং নির্দিষ্ট সময়ে ক্রেতার কাছে পণ্য পৌঁছে দেয়া। সব ক্ষেত্রে আমি আমার ক্রেতাদের পছন্দকেই গুরুত্ব দেই। হোম ডেলিভারি ও ক্যাশঅন ডেলিভারি দেই, যাতে ক্রেতারা পণ্য যাচাই বাছাই করে নিতে পারে। অনলাইন ব্যবসার ক্ষেত্রে কিছু সমস্যা তো মোকাবেলা করতে হয়। যেমন ক্রেতা অর্ডার করে আর ফোন ধরে না। অর্ডার ডেলিভারির পর ক্যানসেল করে। অনেকে ফেক আইডি দিয়ে অর্ডার করে সেটাতে প্রডাক্ট রিসিভ করে না। তবুও বাধা বিপত্তি তো আসবে, ঝুঁকি নেয়াই একজন ব্যবসায়ীর বৈশিষ্ট্য, থেমে থাকা যাবে না সফলতা আসবেই। এভাবে সফল হওয়ার চেষ্টা আমি নিজেই করছি। নিজেই নিজেকে অনুপ্রাণিত করে নিজের সুপ্ত মেধাকে কাজে লাগিয়েছি। আমার নিজের নামেই অনলাইন বিজনেস পেজের নাম রেখেছি রাহিস স্পার্কেল। যখন ক্রেতারা আমার পোশাক হাতে পেয়ে খুশি হয়, প্রশংসা করে তখন অনুপ্রেরণা পাই। যদিও আরো অনেকদূর যেতে হবে। স্বপ্ন দেখি একটি বুটিক শপ দেবো। জীবনে বাধাবিপত্তি তো থাকবেই। বাধা জয় করেই তো সফলতা পাবো, তখন পথের বাধাগুলোকে দূর অতীত মনে হবে। নিজের ব্যবসাকে এমন এক জায়গায় নিয়ে যেতে চাই, যেন সবাই দেখে বলে মেয়েরাও কোনো ছেলে থেকে কম নয়।

 

 

 

 

আমাদের স্বপ্ন আনকোরাকে
সাথে নিয়ে চলার
সুমাইয়া নাইয়ার অসমিতা
নাজিফা নুসরাত
হৃদি পদ্দার চৈতি
আনকোরা

গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজের তৃতীয়বর্ষ শিল্পকলা ও সৃজনশীল শিক্ষা বিভাগের শিক্ষার্থী ও তিন বন্ধু অসমিতা, নুসরাত, চৈতি। আমরা তিন বন্ধু প্রায়ই একই রকম পোশাক তৈরি করতাম। নিজেরাই পোশাকের ডিজাইন করতাম। আর উৎসবগুলোতে একই রকম নিজেদের তৈরি শাড়ি পরে ক্যাম্পাসে আসতাম। সবাই খুব প্রশংসা করত, আমাদের শাড়ি বা সালোয়ার কামিজের ডিজাইনগুলো পছন্দ করত। তখন খুব ভালো লাগত। রঙতুলির ছোঁয়ায় শৈল্পিকতা ফুটিয়ে তোলা আমাদের বৈশিষ্ট্য। কাঠের ও মাটির তৈরি বিভিন্ন মোটিভের গয়নায় রঙতুলিতে ফুটে ওঠে নান্দনিক সব নকশা। ব্লক, বাটিক, টাইডাই আর হ্যান্ড পেইন্টে পোশাকগুলো শৈল্পিক ছোঁয়ায় বর্ণিল হয়ে ওঠে। কলেজ ক্যাম্পাসে বিভিন্ন সময় যে মেলার আয়োজন হয় সেখানে স্টল দিয়েই আমাদের প্রথম পণ্য বিক্রি করা শুরু করি। মাত্র চার হাজার টাকা দিয়ে কাজ শুরু করি। তিন বন্ধু মিলে এর নাম দেই ‘আনকোরা’। এই অল্প পুঁজি দিয়ে যে ব্যবসা শুরু করা সম্ভব বা আনকোরাকে আরো বড় করা হবে সেটা নিয়ে আমরা ভাবিনি। কলেজে আমাদের সহপাঠী ও অন্য ডিপার্টমেন্টের মেয়েদের এবং কলেজের শিক্ষকদের আমাদের তৈরি পণ্যসামগ্রীর প্রতি এত আকর্ষণ দেখে পরে আমরা ঢাকায় বিভিন্ন জায়গায় মেলায় অংশগ্রহণ শুরু করি। সেখানেও প্রচুর ক্রেতা আমাদের তৈরি পণ্যগুলো পছন্দ করেছেন। বেশ কিছু পণ্যের অর্ডারও আসতে শুরু করে। ঢাকার বাইরে থেকেও অর্ডার পেতে শুরু করি। আর আমাদের নিয়মিত ক্রেতার সংখ্যাও বাড়তে থাকে। এরপর আমরা ফেসবুক পেজ খুলে ব্যবসা শুরু করলাম। আনকোরায় সব আমাদের হাতে তৈরি পণ্য। মেয়েদের শাড়ি, সালোয়ার-কামিজ, ওড়না থেকে শুরু করে অন্যান্য পোশাক, ছেলেদের পাঞ্জাবি, বিছানার চাদর, টেবিল ক্লথ। আছে পোশাকের সাথে ম্যাচিং গয়না। মেয়েদের পার্স। বিভিন্ন মোটিভের নকশা ও রঙের বৈচিত্র্যের শোপিস আনকোরা পুরোপুরি বাঙালিয়ানা ও দেশীয় ঐতিহ্যকে নিয়ে কাজ করে। আশা করি আমাদের ক্রেতারা সবসময় আমাদের কাজ নিয়ে সন্তুষ্ট থাকবে। আর আনকোরার সাথেই থাকবে। আমাদের তিন বন্ধুর শুরু থেকেই নিজেদের বিষয় (শিল্পকলা) নিয়ে কাজ করার চিন্তা ছিল। সেই ভাবনা থেকেই এগিয়ে চলা। আনকোরা কতদূর যাবে সেটা নিয়ে আমরা ভাবছি না। বরং আমাদের স্বপ্ন আনকোরাকে সাথে নিয়ে চলার। আনকোরার মধ্যেই বেঁচে থাকবে আমাদের বন্ধুত্ব, আমাদের শিল্পকলা আর আমাদের উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার গল্প।

 

 

 


আজ আমি একজন পরিচিত উদ্যোক্তা
জয়া ইসলাম
লাভ রিফ্লেক্সন

মানুষকে তার নিজের পরিচয় গড়ে তুলতে পার করতে হয় একটি স্রোতময় সমুদ্র। মানুষের পরিচয় তার কর্মের মধ্যে। জয়া ইসলাম গর্বের সাথে নিজের পরিচয় একদিন সবার কাছে তুলে ধরতে পারবেন, সেই স্বপ্ন মনের মধ্যে লালন করে এগিয়ে চলেছেন তার লক্ষ্যে। শুরু হয়েছিল ঠিক তেমনি, যেমনি ভাবে একটি সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ের জীবন শুরু হয়। তার নিজের ভাষায়Ñ এখন আমি অনার্স তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী। বাবা-মায়ের দেয়া হাতখরচে আমার পড়াশোনা ঠিকই চলছিল; কিন্তু অনেক চাহিদা যেন অপূর্ণ ছিল। ছোটবেলা থেকে আমি একটু চাপা স্বভাবের। কোনো জিনিস অনেক ভালো লাগলেও চাইতে পারতাম না। নিজেকে কিছু করতে হবেÑ এমন অদম্য বাসনা আমার মনের মধ্যে ছিল। হঠাৎ একদিন আমার বড় বোন কাঠের কারুকার্য করা একটি ল্যাম্পশেড কিনে আনলো। ঘুরতে ঘুরতে তারা একটি কারখানায় এটি পেয়েছিল। ক্রিয়েটিভ জিনিস আমি অনেক পছন্দ করি। সাথে সাথে একটি প্ল্যান করে ফেললাম, আপুর কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে পৌঁছে গেলাম কারখানায়। সেখানকার মালিকের কাছ থেকে জেনে নিলাম সমস্ত বিষয়। তিনি আমাকে অনেক উৎসাহ দিলেন। আমার আগ্রহ এবং কাজের প্রতি একাগ্রতা দেখে তিনি মুগ্ধ হলেন। প্রাথমিক পর্যায়ে আমার কোনো পুঁজি ছিল না। আমি কারখানার মালিককে অনুরোধ করলাম, আপনার প্রডাক্ট সেল করে আপনাকে টাকা দেবো। তিনি রাজি হলেন। ‘লাভ রিফ্লেক্সন’ নামে ফেসবুকে পেজ খোলার মধ্য দিয়ে আমার যাত্রা শুরু। আমার প্রথম উপার্জন ছিল ৫০০ টাকা এবং এক মাসে আমার উপার্জন হয় ৩২০০ টাকা। এখন আলহামদু লিল্লাহ, মাসে আমার প্রায় ১৫ হাজার টাকা ইনকাম হচ্ছে। আমার প্রডাক্টগুলো কাঠের বা বোর্ডের তৈরি হোমডেকোরেটেড প্রডাক্ট ও উপহারসামগ্রী। এ ছাড়াও বর্তমানে আমি পাটজাত ব্যাগ ও পাটের তৈরি দ্রব্যসামগ্রী, কাঠের চুড়ি ও গয়না তৈরি করছি। এভাবেই আমার উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে চলেছে। আজ আমি শুধু আমার বাবা-মায়ের মেয়ে হিসেবে নই, আমার পারিবারিক মর্যাদার পরিচয়ে নই, বরং আজ আমি আমার ক্ষুদ্র ভুবনে সবার কাছে পরিচিত একজন উদ্যোক্তা জয়া ইসলাম।”

 

 

 

 

দেশকে ভালো কিছু দিতে চাই
সাদিয়া ইসলাম মিতু
বাহারিকা

সাদিয়া একজন মেধাবী তরুণ শিক্ষার্থী; সেই সাথে একজন সফল উদ্যোক্তা। নিজেকে উদ্যোক্তা হিসেবে পরিচয় দিতেই বেশি পছন্দ করেন তিনি। পড়াশোনার পাশাপাশি বিতর্ক, স্কাউটিং, ক্রাফটিং, ড্রেস ডিজাইন আর আঁকাআঁকি ছিল এই উদ্যোক্তার নেশা। স্কুল কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পেইন্টিং বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে বিভিন্ন সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। শুধু একটি বিষয় নিয়ে কখনোই সন্তুষ্ট ছিলেন না। সাদিয়া বিশ্বাস করতেন মানুষ চাইলে পর্যায়ক্রমে অনেক কিছুই করতে পারে। চারুকলা বিভাগে ভর্তি হওয়ার ইচ্ছা থাকলেও পরিস্থিতির জন্য হয়ে ওঠেনি। সামরিক বাহিনীতে যোগদানের ইচ্ছাটা পরিবারের অসম্মতিতে থেমে যায়। পরিবারের ইচ্ছায় বর্তমানে বিইউবিটিতে বিবিএ করছেন। তিনি মনে করেন পড়াশোনা করে কেবল চাকরি করতে হবে, এমনটা নয়। সাদিয়া বলেন, যে কাজ করে তৃপ্তি পাই, নিজের মেধা, শক্তি, আত্মবিশ্বাস একশত ভাগ সেই কাজের মধ্যেই মনোনিবেশ করতে হবে। ক্রাফটিং, ড্রেস ডিজাইন আর আঁকাআঁকির কাজ জানা থাকায় সিদ্ধান্ত নিলাম ব্যবসা করার। ছোটবেলা থেকে নিজের পছন্দ মতো কিছু করতে চাইতাম। ভিন্ন কিছুর তাগিদ থেকে নিজের জামার নকশা নিজেই করতাম। আমার সেলাই বা ক্রিয়েটিভিটির যতটুকু তার প্রথম শিক্ষক আমার মা এবং গ্রামের মানুষগুলো। যারা আমাকে প্রচণ্ড ভালোবাসে। আমার শৈশব কেটেছে গ্রামে। তাই দেশের প্রতি ভালোবাসা আর দেশের জন্য কিছু করার তাগিদ থেকেই দেশীয় পণ্য নিয়ে কাজ শুরু করি।
বাহারিকার যাত্রা শুরু ২০১৭ সালের ১৭ জুলাই। শুরুর টাকাটা ছিল হাত খরচের জমানো ৫,০০০ টাকা। হ্যান্ড পেইন্ট, কারচুপি ব্লক, অ্যামব্রয়ডারি, বাটিক, স্ক্রিন প্রিন্ট, হাতে তৈরি গয়না, হাতে আঁকা টিপ, শৌখিন আসবাবপত্র, ক্যানভাস, ওয়াল পেইন্ট, ক্রাফটিং, ওয়ালমেট, ওয়েস্টার্ন টপস, শিশুদের পোশাক, ওয়েডিং গাউন, লেহেঙ্গা, শাড়ি, পাটজাত দ্রব্য, লেদার, গামছা, মসলিন, জামদানি, সুতি নানান পণ্যের বিপুল সমাহার নিয়ে বাহারিকা ক্রমান্বয়ে তার লক্ষ্য পূরণে এগিয়ে যাচ্ছে। ব্যবসা শুরুর দিকে প্রাতিষ্ঠানিক কোনো জ্ঞান ছিল না। পরে কিছু শর্ট কোর্স করেছি। বিভিন্ন সেমিনার এবং ওয়ার্কশপে অংশগ্রহণ করি। আমার পণ্য নিয়ে বিভিন্ন মেলাগুলোতে অংশ নেই। নতুন নতুন ক্রেতাদের সাথে বাহারিকার পরিচয় হয়। তারাই আবার আমার অনলাইন পেজ বাহারিকার নিয়মিত ক্রেতা হয়ে ওঠেন। এভাবেই সময়ের সাথে সাথে এগিয়ে চলছে আমার বাহারিকা আর আমি।
একটা মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়। স্বপ্ন দেখি বাহারিকা একদিন বড় হবে, ব্র্যান্ড হবে, শোরুম হবে। দেশকে ভালো কিছু দিতে চাই। বেকারত্ব কমাতে সাহায্য করতে চাই। সময়ের সাথে সাথে এগিয়ে যেতে চাই, তার জন্য যতটুকু লাগবে নিজেকে তৈরি করব।


আরো সংবাদ



premium cement