২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

শুধু মুসলিম নয়, এনআরসি নিয়ে ভয়ে ভারতের হিন্দুরাও

শুধু মুসলিম নয়, এনআরসি নিয়ে ভয়ে ভারতের হিন্দুরাও - সংগৃহীত

২০১৯ সালের লোকসভা ভোট। পেশার সূত্রে পশ্চিমবঙ্গের আনাচকানাচ ঘুরতে হয়েছিল মূলত ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের নির্বাচনী প্রচার দেখতে। প্রায় প্রতিটি সভায় গিয়েই একটি বিষয় স্পষ্ট করে জানিয়ে দিতেন শাহ। ক্ষমতায় এলে প্রথমে তারা নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন করবেন এবং তার পরেই পশ্চিমবঙ্গে এনআরসি হবে। অর্থাৎ, জাতীয় নাগরিক পঞ্জি। এই দু'টি বাক্য বলেই গলার স্বর অনেকটা চড়িয়ে শাহ বলতেন, বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারীদের খুঁজে খুঁজে চিহ্নিত করে দেশের বাইরে বার করে দেয়া হবে। এটাই তার সরকারের সব চেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

সীমান্ত লাগোয়া পশ্চিমবঙ্গ ৭০ বছর ধরে দেখেছে এবং দেখছে দেশ ভাগের বাস্তবতা। হিন্দু অধ্যুষিত অঞ্চলে গিয়ে মোদি-শাহদের এ ধরনের প্রচারে একটি বিষয় স্পষ্ট ছিল। অনুপ্রবেশকারী হিসেবে তারা কেবলমাত্র মুসলিমদেরই চিহ্নিত করছেন এবং ধর্মীয় মেরুকরণের রাজনীতি করে ভোট বৈতরণি পার করতে চাইছেন। বস্তুত, দীর্ঘ দিন ধরে এটাই বিজেপি এবং আরএসএস এর রাজনীতির পরিচিত ছক। মোদি-শাহের আমলে যা চূড়ান্ত চেহারা পেয়েছে বলে রাজনীতির কারবারিদের একাংশের বক্তব্য।

লোকসভা নির্বাচন পর্বে আসামে এনআরসি বা নাগরিক পঞ্জির কাজ শুরু হয়ে গেলেও চূড়ান্ত তালিকা তখনো তৈরি হয়নি। ফলে বিজেপি খুব সহজেই ধর্মীয় মেরুকরণের তাস ব্যবহার করে এক শ্রেণির হিন্দু নাগরিকের মন জয় করতে পেরেছিল। পশ্চিমবঙ্গে ভোটের ফলাফলেই তা বোঝা গেছে। যে বিজেপি এ যাবৎ পশ্চিমবঙ্গে ১৯ শতাংশের বেশি ভোট পায়নি, লোকসভা নির্বাচনে সেখানে ৪০ শতাংশের আশেপাশে ভোট পেয়েছে। জিতে নিয়েছে ১৮টি আসন।

পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক আলোচনায় ধর্মীয় মেরুকরণ অন্যতম বিষয় হয়ে উঠেছে। তবে বিশেষজ্ঞদের অনেকেই বলছেন, বিজেপি যেমন ধর্মীয় মেরুকরণের রাজনীতি করছে, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও সেই একই কাজ করেছেন। প্রায় ৩০ শতাংশ মুসলিম অধ্যুষিত পশ্চিমবঙ্গে সংখ্যালঘু ভোট পুরোটাই নিজের দিকে রাখতে তিনি কংগ্রেস এবং বাম দলগুলিকে কার্যত অপ্রাসঙ্গিক করে বিজেপিকে প্রধান বিরোধী শক্তি হিসেবে তুলে এনেছেন। ভেবেছেন, ধর্মীয় মেরুকরণ হলে বাম এবং কংগ্রেসের মুসলিম ভোটও তার ঝুলিতে ঢুকবে। বাস্তবে ঘটেছেও তাই। ভোটের অঙ্কে ধর্মীয় ভোট বিজেপি এবং তৃণমূলের মধ্যে ভাগাভাগি হয়ে গেছে।

পশ্চিমবঙ্গের হিন্দুদের একটা বড় অংশ ভেবেছিল, সিএএ ও এনআরসি হলে তার সরাসরি প্রভাব পড়বে মুসলিমদের উপর। হিন্দুদের উপর নয়। কিন্তু আসামের তালিকা সব বদলে দিয়েছে। লোকসভা নির্বাচনের পর পরই আসামে এনআরসি-র চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশিত হয়। তালিকায় মোট ১৯ লাখ লোকের নাম আছে। যার মধ্যে প্রায় ৫ লাখ বঙ্গভাষী হিন্দু এবং ৭ লাখ মুসলিম। বাকি ৭ লাখ মানুষের একটা বড় অংশ আসামের আদি বাসিন্দা এবং অন্য অংশ উত্তর ভারতীয়। অর্থাৎ, সকলেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, কোনো এক পক্ষ নয়।

কী হবে এই ১৯ লাখ মানুষের? সত্যি সত্যি কি তারা ভারতীয় নন? কোথা থেকে তারা এসেছেন? এর পরে তারা যাবেন কোথায়? প্রশ্ন অনেক। উত্তর নেই। পুরোটাই ধোঁয়াশা। দেশ থেকে তাদের তাড়াতে হলে অন্য দেশে পাঠাতে হবে। কিন্তু অন্য দেশ তাঁদের নেবে কেন? শেষ পর্যন্ত এই মানুষদের একটা বড় অংশর গন্তব্য হবে ডিটেনশন ক্যাম্প। হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে। গোটা আসামজুড়ে তৈরি হয়েছে এমন অনেক ক্যাম্প। সেখানেই কি তাদের বাকি জীবন কাটাতে হবে? সে উত্তরও স্পষ্ট নয়। এমনও ঘটনা ঘটেছে, যেখানে একই পরিবারের একজন বা দু'জন সদস্যকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে ডিটেনশন সেন্টারে। বাকিরা উদভ্রান্তের মতো বিচারের আশায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন। সব মিলিয়ে এক অদ্ভুত অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে আসাম জুড়ে।

আসামের এই অনিশ্চয়তার পিছনে একটা লম্বা ইতিহাস আছে। যার শুরু সেই ১৯৫০ এর দশকে। অত পিছনে না গিয়েও বলা যায়, স্থানীয় অহমিয়াদের সঙ্গে আসামে বসবাসকারী বাঙালিদের বচসা বহু দিনের। যার জেরে ১৯৭০ এর দশকে হয়েছিল 'বাঙালি খেদাও' আন্দোলন। আসামের ছাত্র সংগঠন আসুর সেই জঙ্গি আন্দোলনের প্রভাবে কার্যত রণক্ষেত্রের চেহারা নিয়েছিল আসাম। কেন্দ্রীয় সরকারকেও সেখানে হস্তক্ষেপ করতে হয় এবং এনআরসি-র দাবি মেনে নিতে হয়।

মনে রাখা দরকার, দেশ ভাগের পর আসামে বসবাসকারী বাঙালিদের একটা অংশ এসেছে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে। সিলেট থেকে আসামের বরাক উপত্যকায় এসে নতুন করে থাকতে শুরু করেন তারা। কেউ কেউ চলে যান শিলংয়ে। আর বাঙালিদের আর একটি অংশ কাজের সূত্রে আসামে পৌঁছে গিয়েছিলেন সেই ব্রিটিশ আমলে। স্থানীয় অহমিয়াদের দাবি. আসাম কেবল অহমিয়াদের জায়গা। বাঙালিদের সেখানে থাকতে দেয়া হবে না। হিন্দু-মুসলিমের ধর্মীয় মেরুকরণের প্রশ্ন সেখানে ছিল না। কিন্তু বিজেপি আসামের সেই আগুন-রাজনীতিতে ধর্মীয় মেরুকরণের স্ফূলিঙ্গ দেখতে পায়। বিজেপি ভেবেছিল, মুসলিম অনুপ্রবেশের বিষয়টির আধারে আসামের এনআরসি মডেল দেশজুড়ে ছড়িয়ে দেবে তারা। কিন্তু বাস্তবে হিন্দু-মুসলিম মেরুকরণের অঙ্ক খাটেনি। এনআরসিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সব পক্ষই। তার উপর সিএএ আশায় আগুন আরো তীব্র ভাবে জ্বলে উঠেছে।

পশ্চিমবঙ্গে যে হিন্দুরা বিজেপির এনআরসিপ্রচারে আশার আলো দেখেছিলেন, আজ তারাও ভয় পাচ্ছেন। তাদের প্রশ্ন, আসামের মতো যদি পশ্চিমবঙ্গেও এনআরসি হয়, তাহলে শুধু মুসলিম নয়, হিন্দুরাও ছাড় পাবেন না। সকলকেই যেতে হবে ডিটেনশন ক্যাম্পে। কারণ, নাগরিকত্ব প্রমাণের জন্য যে কাগজগুলি দেখানোর কথা বলা হচ্ছে, যে নথি জমা দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে, দেশ ভাগের সময় ভারতে চলে আসা বহু হিন্দু পরিবারের কাছেও সে সব নথি নেই। থাকা সম্ভবও নয়। এনআরসি হলে আসামের হিন্দুদের মতো তারাও ফ্যাসাদে পড়বেন। ফলে গোটা দেশের মুসলিমদের মতো, হিন্দুরাও বিজেপির রাজনীতিকে সন্দেহ করতে শুরু করেছে।

আসামের এনআরসি তালিকা যে তাদের বিপাকে ফেলেছে, বিজেপিও সে কথা বুঝতে পেরেছে। ফলে সিএএ নিয়ে প্রচার চালালেও আপাতত এনআরসি নিয়ে প্রচার করছে না বিজেপি। বরং বলা হচ্ছে, সিএএ কিংবা এনআরসি-তে হিন্দুদের কোনো সমস্যা হবে না। কারণ, সিএএ তে পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও আফগানিস্তান থেকে আসা হিন্দু উদ্বাস্তুদের শরণার্থীর স্বীকৃতি দেওয়ার কথা বলা আছে। শুধু তাই নয়, এই শরণার্থীরা ৫ বছর এ দেশে থাকলেই নাগরিকত্বের জন্য আবেদন জানাতে পারবেন। কিন্তু তাতেও চিঁড়ে ভিজছে না।

প্রশ্ন উঠছে, যে হিন্দু উদ্বাস্তুরা ৭০ বছর আগে কিংবা ৫০ বছর আগে কিংবা ৩০ বা ২০ বছর আগে এ দেশে চলে এসেছেন, এ দেশে ভোট দিয়েছেন, নাগরিকত্ব পেয়েছেন, চাকরি করছেন, বাড়ি কিনেছেন, ব্যবসা করছেন, আজ এনআরসিতে তাদের নাম উঠলে কী অবস্থা হবে? তা হলে কী তখন ৫ বছর ডিটেনশন সেন্টারে কাটিয়ে ফের তাদের নতুন করে নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে হবে? কী হবে তাদের সম্পত্তির? আসলে আসামের এনআরসি দু'টি বিষয় স্পষ্ট করে দিয়েছে। এক, সমস্যাটা কোনো এক পক্ষের নয়, সকলের। বহু মুসলিম বরাবর ভারতে থেকেও এনআরসি-র শিকার হয়েছেন। সম্প্রতি জুবেদা বিবির কাহিনি আবার সে বিষয়টি সামনে নিয়ে এসেছে। আর দুই, এ ভাবে অনুপ্রবেশকারী চিহ্নিত করা যায় না।

আগামী বছরের গোড়ায় পশ্চিমবঙ্গ এবং আসামে বিধানসভা ভোট। মোদী-শাহ যে তাস খেলে সেই নির্বাচনে নিজেদের ভোট ব্যাংক পোক্ত করতে চেয়েছিলেন, আপাতত সে গুড়ে বালি। তবে বিরোধীদেরও মনে রাখা দরকার, ভোটে ধর্মীয় মেরুকরণের অঙ্ক কষে আখেড়ে কারো সুবিধা হয় না। লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল দেখেও তৃণমূল যদি তা বুঝতে না পারে, তা হলে বিপদ আসন্ন। রাজনৈতিক অঙ্ক সাধারণ মানুষকে কোন দুর্বিপাকে ফেলতে পারে, আসামে তা প্রমাণ হয়ে গিয়েছে। বাকি দেশ এর থেকে শিক্ষা নিয়েছে। দেশ জুড়ে যে এনআরসি সিএএ বিরোধী আন্দোলন হচ্ছে, বিজেপি তাকে যতই মুসলিমদের আন্দোলন বলে চালানোর চেষ্টা করুক, আসলে তা একত্র আন্দোলনেরই নজির তৈরি করেছে।
সূত্র : ডয়চে ভেলে

 


আরো সংবাদ



premium cement