০৮ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১, ২৮ শাওয়াল ১৪৪৫
`


বিচারব্যবস্থার সংস্কার

-

মোটা দাগে বলতে হয়, এক ধরনের প্রতিশোধ থেকে বিচারব্যবস্থার প্রর্বতন শুরু হয়েছিল পর্যায়ক্রমে বিভিন্নভাবে কোথাও সংস্কার বা কোথাও স্বেচ্ছাচারিতা এমনকি স্বৈরতন্ত্রের মাধ্যমে এর ক্রমবিকাশ ঘটেছে। একজন ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি কতটুকু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন এবং সে অনুপাতে কতটুকু ক্ষতিপূরণ প্রাপ্তির হকদার, তা আইনগতভাবে নিরূপণ করা বিচারব্যবস্থার প্রধান দায়িত্ব। আনুষ্ঠানিক বিচারব্যবস্থা শুরু হওয়ার আগে সৃষ্টিকর্তার নামে উৎসর্গীকৃত কোনো প্রাণীকে (মানুষ বা জীবজন্তু) ভিকটিম হিসেবে চিহ্নিত করা হতো। বিচারব্যবস্থা যখন আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্ভাসিত হতে থাকে, তখন থেকে আঘাত, হত্যা, রোগ, প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্তকে বোঝানো হতো। প্রধানত ভিকটিম দুই প্রকার যথা : (১) প্রাইমারি এবং (২) সেকেন্ডারি। যারা সরাসরি বা শারীরিকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত তারা প্রাইমারি ভিকটিম বিষয়ে যারা অর্থনৈতিক ও ইমোশনাল বা মানসিকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত তারা সেকেন্ডারি ভিকটিম।

প্রচলিত বিচারে আধুনিক ব্যবস্থা হওয়ার আগে ভিকটিমের চাহিদার ওপরেই অপরাধীর সাজা নির্ধারিত হওয়ার প্রথা চালু ছিল। খ্রিষ্টের জন্মের চার হাজার ৫০০ বছর আগে ‘Code of Ur Nammu’ মোতাবেক, চোখের পরিবর্তে চোখ, নাকের পরিবর্তে নাক জখম করার আইনগত বিধান চালু ছিল। Mosaic Law মোতাবেক, একটি চুরির জন্য ভিকটিমকে পাঁচটি ষাঁড় ক্ষতিপূরণ প্রদানে বিধান ছিল। Code of Hammurabi মোতাবেক চুরিকৃত মালামালের মূল্যের ৩০ গুণ বেশি মূল্য ক্ষতিপূরণ ভিকটিমকে দিতে হতো। এর ব্যতিক্রম ঘটিয়ে Roman Law আইন প্রণয়ন করে যে, (১) হাতেনাতে ধরা পড়লে চুরি হওয়া মালামালের দ্বিগুণ মূল্য ভিকটিমকে দিতে হবে, (২) হাতেনাতে ধরা না পড়ে পরবর্তী সময়ে ধরা পড়লে তিনগুণ এবং (৩) চুরি করার সময় জোরজবরদস্তি করলে চারগুণ মূল্য ভিকটিমকে প্রদান করতে হবে। King Alfred of London অপরাধের গুরুত্বের ওপর বিবেচনা করে দাঁত খুলে নেয়া আইন প্রণয়ন করেছিলেন (তথ্যগুলো ANDREW KARMEN রচিত An Introduction to Victimology বইয়ের পৃষ্ঠা ২৯২/২৯৩ থেকে সংগৃহীত)।

আমেরিকান বিপ্লবের আগে ফৌজদারি অপরাধগুলো ব্যক্তিপর্যায়ের সঙ্ঘাত হিসেবে চিহ্নিত ছিল। ভিকটিমকে ক্ষতিপূরণ দেয়া হতো তার সন্তুষ্টি মোতাবেক। চুরি যাওয়া মালের তিনগুণ ক্ষতিপূরণ দেয়ার বিধান ছিল। অপরাধী যদি আর্থিকভাবে ক্ষতিপূরণ প্রদানে ব্যর্থ হতো, তবে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির অধীনে বিনা বেতনে চাকরি করে বা কামলা খেটে তা পরিশোধ করতে হতো। কারাগারে বন্দী করার বিধান তখনো ছিল, তবে কারাগারের খরচ বাদিকেই বহন করতে হতো (সূত্র : Geis 1977, Jacobo-1977, McDonald and Hillen Drand-1990)।

আমেরিকান বিপ্লবের পর ব্রিটিশ তাদের ১৩টি উপনিবেশকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি প্রদানের পর বিচারব্যবস্থার আমূল সংস্কার করা হয়। অপরাধকে ব্যক্তিগত সঙ্ঘাতের পরিবর্তে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা শুরু হলো (Crimes were redefined as act against the State)। তখন থেকেই Crimes এবং Torts’কে আলাদাভাবে সংজ্ঞায়িত করে বলা হয় যে, ‘Crimes were offences against the public (The People) as represented by the Public as represented by the State and Torts were the corresponding wrongful acts against the specific person.’ ফৌজদারি ও দেওয়ানি আদালত তখন থেকে আলাদা হয়ে যায় (সূত্র : Mc Donald 1977))। আইনটি সংস্কার করার পর বিচারকরা ভিকটিমকে ক্ষতিপূরণ দানের বিষয়টি উল্লেখ করে রায় প্রদান করতেন। তখন থেকে তারা মনে করা শুরু করছেন, ‘Restitution should routinely be part of the sentence after either negotiated pleas or trials.’

ভিকটিমদের ক্ষতিপূরণের জন্য প্রকৃত ক্ষতির চেয়ে অধিকমাত্রায় ক্ষতিপূরণ আদায়কে Cesare Becearia (১৭৩৮-১৭৯৪) অযৌক্তিক (Not Justified) বলে মন্তব্য করেন। তিনি মনে করতেন যে, নির্দোষ ব্যক্তিকে যাতে দোষী সাব্যস্ত না করা হয়, সে জন্য বিচারব্যবস্থা আরো সূক্ষ্ম ও সচল হওয়া আবশ্যক। এতে অপরাধী আত্মপক্ষ সঠিকভাবে সমর্থন করতে পারে। তিনি মনে করতেন, মানুষ বা সমাজ বিভিন্ন ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত বা ভিকটিম হতে পারে, যেমন- (1) Victims of the Criminal Justice System, (2) Victim of legal order & (3) Victim of Abuse of Power.

ক্ষতিপূরণের ব্যাপারে আগের ধ্যান-ধারণা যেমন- ‘Involves the transfer of Services or money from the offender to the Victim for damages inflicted by the offender’ পরিবর্তিত হয়ে ক্ষতিপূরণের ক্ষেত্রে বিভিন্ন মাত্রা যোগ হয়েছে; যেমন (1) Punishment, (2) Rehabilitation, (3) Restitution.

প্রথমত Utilitarian Principle and Retribution বলতে ‘উচিত শাস্তি’ (Punishment)-কে বোঝানো হয়েছে, ল্যাটিন ভাষায় যা ‘Lex Talionis’ অর্থাৎ চক্ষুর বদলে চক্ষু নেয়া। অপরাধীকে পরবর্তী অপরাধ কার্যের জন্য অক্ষম করে দেয়াটাও এ থিওরির আওতায় আসে। উদারপন্থী সিভিল সোসাইটি এ পদ্ধতিকে ‘অত্যন্ত কঠিন এবং অত্যাচারী শাসকদের হাতিয়ার’ হিসেবে মন্তব্য করেছেন। দ্বিতীয়ত ভিকটিমকে ক্ষতিপূরণের মাধ্যমে অর্থাৎ ভিকটিমকে সন্তুষ্ট করার মাধ্যমে শাস্তি থেকে রেহাই পাওয়ার পদ্ধতিকে Rehabilitation Theory বোঝানো হয়েছে।

তৃতীয়ত কোর্টের আদেশের মাধ্যমে ভিকটিমকে যে ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়, তা-ই Restitution. এ আদেশের বাইরেও অপরাধী ভিকটিমকে ক্ষতিপূরণ দিতে পারে, তবে সে ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণকে Compensation রূপে বোঝানো হয়েছে। আদালতে মামলা বা গ্রেফতার রেখেও Compensation হতে পারে, যা Restitution-এর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।

এ ছাড়াও আধুনিক বিচার পদ্ধতিতে ‘Restorative Justice’ নামে একটি সংস্কার শুরু হয়েছে যার বাংলা অর্থ ‘পুনরুদ্ধার’ হলেও এ পদ্ধতিতে বিকল্প বিচার বোঝায়। বর্তমান বিচার ব্যবস্থায় দীর্ঘসূত্রতা, জটিলতা, ঘুষবাণিজ্য, ক্ষমতাসীনদের প্রতি বিচারকদের কারো কারো দুর্বলতা প্রভৃতি থেকেই বিকল্প বিচারব্যবস্থার আইডিয়ার উৎপত্তি হয়েছে।

বাংলাদেশে বিচারব্যবস্থার সেশন জট প্রকট আকার ধারণ করেছে। ২১/১/২০১৯ তারিখে মিডিয়াতে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে দেখা যায়, ‘২০১৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত আদালতে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ৩৫,০৭,৮৯৮। গত বছরের জুন থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত রুজু করা মামলা ৫৪,৫৪৫টি। এর মধ্যে দেওয়ানি মামলার সংখ্যা হচ্ছে ১৩,৯৭,৩৫৪, ফৌজদারি মামলার ১৯,৬৭,১৬৫টি এবং অন্যান্য মামলার সংখ্যা ৮৮,৮৩৪। আইন মন্ত্রণালয়ের ভাষ্যমতে, দেশের নিম্ন আদালতে বিচারাধীন ফৌজদারি মামলার সংখ্যা হচ্ছে ১৭ লাখ ১১ হাজার ৬১৮। দুই লাখ ২৯ হাজার ৭৭৪টি মামলা পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে বিচারাধীন রয়েছে। মামলা নিষ্পত্তি করার সময়সীমা দেয়া থাকলেও বছরের পর বছর অতিবাহিত হয়ে যে তবু মামলার নিষ্পত্তি হচ্ছে না। এদিকে সরকার নিজেও ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য অসত্য মামলা দিয়ে মামলার সংখ্যা অতিমাত্রায় বৃদ্ধি করে, যা এখন বিচার বিভাগের পক্ষে সামাল দেয়া সম্ভব হচ্ছে না।

বিচার প্রার্থী মানুষ একটি বিকল্প বিচারব্যবস্থার দিকে ঝুঁকছেন। ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি পন্থা। বিট পুলিশিং কার্যক্রমের মাধ্যমে এসব বিরোধ নিষ্পত্তি করা হয়ে থাকে। যেমন গত এক বছরে শুধু হবিগঞ্জ জেলার সদর, লাখাই ও শায়েস্তাগঞ্জ উপজেলায়ই নিষ্পত্তি করা হয়েছে এক শ’টি বিরোধ। এর মাধ্যমে তুচ্ছ ঘটনা নিয়ে দাঙ্গা, খুন-খারাবি, মামলা-মোকদ্দমা কমেছে। মনিটরিং থাকার কারণে অল্পদিনেই তা জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এর মাধ্যমে অপরাধপ্রবণতা কমছে। এখন ছোটখাটো বিষয় নিয়ে আর মানুষ মামলা-মোকদ্দমায় জড়ায় না। সালিসের মাধ্যমেই তা নিষ্পত্তি করা হয় (সূত্র : জাতীয় পত্রিকা ১৭/১১/২০১৯)।’

লেখক : কলামিস্ট ও আইনজীবী (অ্যাপিলেট ডিভিশন)
taimuralamkhandaker@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement