০৮ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১, ২৮ শাওয়াল ১৪৪৫
`


কাশ্মির সঙ্কট, বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ

অরুন্ধতী রায় ও অমর্ত্য সেন -

‘ভূস্বর্গ’খ্যাত কাশ্মির উপত্যকা আবারো অশান্ত হয়ে উঠেছে। সেখানে প্রতিনিয়ত মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটছে এবং ভারত সরকারের ‘পোড়ামাটি নীতি’র কারণে মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছে। গত ৫ আগস্ট লোকসভায় ভারতীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ জম্মু-কাশ্মিরের বিশেষ মর্যাদাবিষয়ক সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ রহিত করার ঘোষণা দেয়ার সাথে সাথে জম্মু-কাশ্মির অশান্ত হয়ে ওঠে নতুন করে। ভারত সরকার বিক্ষুব্ধ জনতার বিক্ষোভ ঠেকাতে এ রাজ্যে কার্ফু জারি করেছে। বন্ধ করে দেয়া হয় টেলিযোগাযোগ এবং ইন্টারনেট পরিষেবা। ফলে কাশ্মির উপত্যকা গোটা বিশ্ব থেকেই কার্যত বিচ্ছিন্ন। কাশ্মিরিরা অভিযোগ করেছেন, ভারত সরকার কাশ্মিরে ব্যাপক গণহত্যা চালানোর জন্য এ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। বহির্বিশ্ব থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন থাকায় আসলে কী ঘটছে তা সঠিকভাবে জানা না গেলেও সেখানে যে সরকারের দলন-পীড়ন চলছে, তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

ভারত সরকারের একতরফা এ সিদ্ধান্ত যৌক্তিক বলা যায় না। কেউ কেউ বিষয়টিকে ভারতের ‘অভ্যন্তরীণ বিষয়’ বলে দিল্লিকে খুশি করায় লিপ্ত হলেও ভারতের প্রধান বিরোধী দলসহ রাজনৈতিক মহল, সুশীলসমাজ, বুদ্ধিজীবী মহল, নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞসহ সব শ্রেণী ও পেশার মানুষ এ সিদ্ধান্তকে অগণতান্ত্রিক, একপেশে ও অপরিণামদর্শী বলে সরকারের কঠোর সমালোচনা করেছে। ‘কাশ্মির সঙ্কটের একমাত্র সমাধান গণতন্ত্র’- এমনটিই মন্তব্য করেছেন ভারতের নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন। কাশ্মিরের বিশেষ সুবিধাসংবলিত ৩৭০ ধারা তুলে দেয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, ‘এ অযাচিত পদক্ষেপে সেখানকার সংখ্যাগরিষ্ঠের মানুষের কথা ভাবা হয়নি। গোটা বিশ্বে গণতান্ত্রিক আদর্শ অর্জনের জন্য ভারত অনেক কিছুই করেছে। তবে এখন আর একজন ভারতীয় হিসেবে এ সত্য নিয়ে গর্বিত নই’।

সরকারের এই একতরফা সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ভারতের প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবী ও মানবাধিকার কর্মী অরুন্ধতী রায় তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত এবং অচিরেই ভারতজুড়ে মুসলিমদের ওপর নিপীড়ন শুরু হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। শুধু তাই নয়, এর ফলে ভারতীয় গণতন্ত্রের ওপরও কালোছায়া নেমে আসবে বলেও তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। নিউ ইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত ‘দ্য সাইলেন্স ইজ দ্য লাউডেস্ট সাউন্ড’ শিরোনামে তার নিবন্ধটি গত ১৫ আগস্ট নিউ ইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত হয়। অরুন্ধতী বলেন, ‘গত ৫ আগস্ট বিজেপি সরকার একতরফাভাবে জম্মু-কাশ্মিরের স্বায়ত্তশাসন পুরোপুরি বাতিল করার পর সব ধরনের ভারতীয় জাতীয়তাবাদীরা উল্লাস প্রকাশ করেছে। এমনকি মূলধারার গণমাধ্যমগুলোও পরোক্ষভাবে সমর্থন দেয় এতে। রাস্তায় নেচে নেচে উল্লাস করে অনেকে। আর ইন্টারনেটে শুরু হয় কাশ্মিরি নারীদের প্রতি ভয়াবহ ধর্ষকামের চর্চা’।

গত ১৪ আগস্ট ‘ওয়াশিংটন পোস্ট’ পত্রিকায় এ বিষয় নিয়ে একটি অতিগুরুত্বপূর্ণ কলাম লিখেছেন ভারতের প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ প্রফেসর রামচন্দ্র গুহ। তিনি লিখেছেন, ‘ভারতবর্ষ ছিল গণতন্ত্রের জন্য একটি চমৎকার নমুনা। কিন্তু কাশ্মিরের আঞ্চলিক স্বাধীনতা হরণ, হিন্দুত্ববাদের উত্থান আর সংখ্যালঘু মুসলমানদের প্রতি উগ্রবাদী আচরণে ভারতের সেই প্রশংসাগুলোকে ‘ডাউনগ্রেড’ করার সময় এসেছে’। তিনি বলেছেন, ‘গত শতাব্দীর ৮০’র দশক থেকে বিজেপি ভারতে যে হিন্দুত্ববাদের জাগরণ তুলছে, তাতে বলা যায়- ১৯৪৭ সালের পর যেকোনো সময়ের চেয়ে এখন ভারত ‘হিন্দু পাকিস্তান’ হওয়ার কাছাকাছি।

ভারত সরকারের এই গোটা বিশ্বেই সমালোচনার ঝড় উঠেছে। গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের পরিবর্তে, কাশ্মিরিদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের আন্দোলন দমাতে অতিমাত্রার বলপ্রয়োগ দেশীয় ও আন্তর্জাতিক কোনো মহলের কাছেই গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। জম্মু ও কাশ্মিরে সৃষ্ট অচলাবস্থায় উদ্বেগ প্রকাশ করে জাতিসঙ্ঘের মহাসচিব গুতেরেস বলেছেন, ‘জম্মু ও কাশ্মিরের মর্যাদা ক্ষুণ্ন করে- এমন কোনো পদক্ষেপ যেন ভারত ও পাকিস্তান না নেয়’। জাতিসঙ্ঘের পক্ষে আরো বলা হয়, ‘মুসলিম অধ্যুষিত কাশ্মির উপত্যকার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ কী হবে, সে সিদ্ধান্ত ওই অঞ্চলের প্রশাসন ও জনগণ নিজেরাই নেবে, এ মর্মে জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদে একাধিকবার রেজুলেশন গৃহীত হয়েছে’। বিষয়টি নিয়ে ইসলামী সম্মেলন সংস্থা ওআইসি, আরবলিগসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো জাতিসঙ্ঘের অনুরূপ অবস্থানই গ্রহণ করেছে।

প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তান বিষয়টি নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। চীন ভারতীয় পদক্ষেপের কড়া সমালোচনা করেছে। তুরস্ক, ইরানসহ মুসলিম বিশ্বের প্রায় সব রাষ্ট্র কাশ্মিরিদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের অনুকূলেই তাদের অবস্থান ব্যক্ত করেছে। ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি কাশ্মিরি মুসলমানদের ওপর বল প্রয়োগ থেকে বিরত থাকতে ভারত সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। শেষ পর্যন্ত রাশিয়ার অবস্থানও কাশ্মিরিদের পক্ষে চলে গেছে। ভারত এই ইস্যুতে অনেকটা ব্যাকফুটে পড়েছে বলেই মনে হচ্ছে।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প কাশ্মির বিরোধ নিরসনে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে মধ্যস্থতা করার আগ্রহ প্রকাশ করায় দেশটি স্বীকার করে নিয়েছে যে, বিষয়টি একটি আন্তর্জাতিক ইস্যু। ভারতের ক্ষুদ্র ও শক্তিহীন প্রতিবেশীরা বিষয়টি নিয়ে তেমন প্রতিক্রিয়া না দেখালেও তাদের অবস্থান কাশ্মিরি জনগণের পক্ষেই। বোধগম্য সীমাবদ্ধতার কারণেই হয়তো তারা মুখ খুলতে পারছে না। একমাত্র বাংলাদেশ ছাড়া আর কোনো প্রতিবেশীই কাশ্মির সংক্রান্ত বিষয়টি ভারতের ‘অভ্যন্তরীণ বিষয়’ বলে মন্তব্য করেনি।

এবার কাশ্মির সঙ্কট শুরু হওয়া মাত্রই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী গণমাধ্যমকর্মীদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, ‘কাশ্মির ইস্যুতে পাক-ভারত যুদ্ধ শুরু হলে বাংলাদেশ ভারতের পক্ষে অবস্থান নেবে’। বিষয়টি নিয়ে দেশের সচেতন নাগরিক, সুশীলসমাজ, বুদ্ধিজীবী মহল ও নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা সমালোচনা মুখর হয়ে ওঠেন। কারণ, যুদ্ধরত কোনো পক্ষে অবস্থান নেয়া প্রকারান্তরে যুদ্ধে অংশ নেয়ার নামান্তর। বাংলাদেশ সংবিধানের ৬৩(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘সংসদের সম্মতি ব্যতীত যুদ্ধ ঘোষণা করা যাইবে না কিংবা প্রজাতন্ত্র কোন যুদ্ধে অংশগ্রহণ করিবেন না’।

কাশ্মির নিয়ে অস্থিরতার মধ্যেই সম্প্রতি তিন দিনের বাংলাদেশ সফর শেষ করেছেন ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর। সফরের পর বাংলাদেশ-কাশ্মির ইস্যুতে নিজ অবস্থান স্পষ্ট করেছে। গত ২১ আগস্ট বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘বাংলাদেশ মনে করে ৩৭০ ধারা রদ করা ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়। বাংলাদেশ সব সময়ই নীতিগতভাবে আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতার নীতিতে বিশ্বাসী। বাংলাদেশ একই সাথে মনে করে যে, সব দেশেরই উচিত উন্নয়নকে গুরুত্ব দেয়া।’ তবে কাশ্মির ইস্যুতে এ বক্তব্য বিশ্বজনমতের শুধু বিপরীতই নয়, বরং আমাদের সংবিধানের অনুচ্ছেদ-২৫ ও জাতিসঙ্ঘ মানবাধিকার সনদের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।

স্মরণযোগ্য যে, ক্ষমতাসীনরা সব সময়ই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্ন বাস্তবায়নের কথা বলে থাকেন। এমনকি নিজেদের উচ্চাভিলাষকে ‘বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন’ বলে চালিয়ে দেয়ার মুদ্রাদোষ থেকেও তারা মুক্ত নন। কিন্তু কাশ্মির ইস্যুতে ক্ষমতাসীনরা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বিপরীতে অবস্থান নিয়েছেন। তা বাংলাদেশের স্থপতির প্রতি চরম অশ্রদ্ধা বলেই মনে করা যায়। কাশ্মির ইস্যুতে বঙ্গবন্ধুর অবস্থান ছিল গণভোট ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ভিত্তিতে এ সমস্যার ন্যায়সঙ্গত সমাধান। তিনি তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘অত্যাচার আর গুলি করতে কেহ কাহারো চেয়ে কম পারদর্শী নয়। গুলি করে বা গ্রেফতার করে সমস্যার সমাধান করা সম্ভব নয়। ভারতের উচিত ছিল গণভোটের মাধ্যমে কাশ্মিরের জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার মেনে নিয়ে দুই দেশের মধ্যে একটি স্থায়ী শান্তি চুক্তি করে নেয়া।’

তার মতে, ‘গণতন্ত্রে বিশ্বাসী ভারত, গণতন্ত্রের পথে যেতে রাজি হয় না কেন ? কারণ তারা জানে, গণভোটের মাধ্যমে কাশ্মিরের জনগণের মতামত নিলে ভারতের পক্ষে কাশ্মিরের লোক ভোট দেবে না। তাই জুলুম করেই দখল রাখতে হবে...। আমার মনে হয়, ভারতের একগুঁয়েমিই দায়ী শান্তি না হওয়ার জন্য।’ বঙ্গবন্ধুর এমন সুস্পষ্ট উক্তিতে প্রমাণিত হয় না যে, বঙ্গবন্ধু কাশ্মির ইস্যুকে সে দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় মনে করতেন। মূলত তার এ বক্তব্যের মধ্যে কাশ্মির সমস্যার বাস্তবচিত্রই ফুটে উঠেছে। এটা পুরোপুরি ভারতের প্রতিকূলেই চলে গেছে। অথচ বঙ্গবন্ধুর কথিত উত্তরসূরিরা নিজেদের তার বিপরীত মেরুতেই অবস্থান নিয়ে তার প্রতি চরম অশ্রদ্ধাই দেখিয়েছেন।

৩৭০ অনুচ্ছেদটি ভারতীয় সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল ১৯৪৯ সালের ১৭ অক্টোবর। ১৯৫৪ সালে এর সাথে ৩৫-এ ধারা যুক্ত করা হয়। ৩৭০ অনুচ্ছেদের কারণে জম্মু ও কাশ্মির অন্য যেকোনো ভারতীয় রাজ্যের চেয়ে বেশি স্বায়ত্তশাসন ভোগ করত। এ অনুচ্ছেদের ভিত্তিতেই কাশ্মির রাজ্য ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, ভারতীয় রাজ্য জম্মু ও কাশ্মিরকে নিজেদের সংবিধান ও একটি আলাদা পতাকা রাখা স্বাধীনতা দেয়া হয়। এছাড়া পররাষ্ট্রসম্পর্কিত বিষয়, প্রতিরক্ষা এবং যোগাযোগ বাদে অন্য সব ক্ষেত্রে স্বাধীনতার নিশ্চয়তাও দেয় হয়েছিল। ৩৭০ ধারা বাতিলের আগ পর্যন্ত কাশ্মিরের নাগরিকেরা এসব সুবিধা ভোগ করতেন।

ভারত জম্মু-কাশ্মিরকে নিজের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে দাবি করলেও ইতিহাস সে কথায় সায় দেয় না। মূলত কাশ্মির অতীতে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র ছিল। কিন্তু রাজা হরি সিংয়ের বিশ্বাসঘাতকতার কারণেই কাশ্মির ভারতীয় ইউনিয়নভুক্ত হয়েছে। কিন্তু রাজা কাশ্মিরের মালিক নন, বরং কাশ্মিরের জনগণই কাশ্মিরের মালিক। তাই জম্মু-কাশ্মিরকে কোনো দেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ না মনে করে অন্তত ‘বিরোধপূর্ণ’ বলাই বাস্তবোচিত যৌক্তিক।
আর এ বিরোধের কারণেই ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে কাশ্মির নিয়ে ১৯৪৭, ১৯৬৫ এবং ১৯৯৯ সালে তিনটি যুদ্ধ হয়েছে। ভারত সমগ্র জম্মু ও কাশ্মির রাজ্যটি নিজেদের বলে দাবি করে। জম্মু বেশির ভাগ অংশ, কাশ্মির উপত্যকা, লাদাখ এবং সিয়াচেন হিমবাহ নিয়ে কাশ্মিরের প্রায় ৪৩ শতাংশ অঞ্চল ভারত শাসন করছে। পাকিস্তান এ দাবির বিরোধিতা করে আসছে শুরু থেকেই। দেশটি কাশ্মিরের প্রায় ৩৭ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করেÑ এর মধ্যে আছে ‘আজাদ’ কাশ্মির এবং গিলগিট বাল্টিস্থানের উত্তরাঞ্চল।

ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৯২৫ সালে হরি সিং কাশ্মিরের রাজা হয়েছিল। ১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতা লাভ করা পর্যন্ত তিনিই ছিলেন কাশ্মিরের শাসক। যে মানদণ্ডে ভারতবর্ষ বিভাজিত হয়েছিল সে অনুযায়ী মুসলিমপ্রধান কাশ্মির পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কথা। কিন্তু ১৯৪৭ সালের ২৬ অক্টোবর হরি সিং বিদ্রোহী ও উপজাতীয় আক্রমণের অজুহাতে কাশ্মিরের ভারতভুক্তির বিতর্কিত চুক্তিতে সই করেন। তা ছিল কাশ্মিরের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর আবেগ-অনুভূতি ও চিন্তা-চেতনার সাথে সুস্পষ্ট প্রতারণা। ২৭ অক্টোবর তা স্বাধীন ভারতের প্রথম জেনারেল এবং এবং ব্রিটিশ ভারতের শেষ ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেন কর্তৃক অনুমোদিত হয়। চুক্তি সই হওয়ার পর, ভারতীয় সেনা কাশ্মিরে প্রবেশ করে কথিত অনুপ্রবেশকারীদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয় এবং ভারত বিষয়টি জাতিসঙ্ঘে নিজেই উত্থাপন করে। জাতিসঙ্ঘে ভারত ও পাকিস্তান তাদের নিজ নিজ অধিকৃত এলাকা খালি করে দিয়ে জাতিসঙ্ঘের তত্ত্বাবধানে গণভোটের প্রস্তাব দেয়। এ বিষয়ে জাতিসঙ্ঘ ১৯৪৮ সালে ৪৭ নম্বর রেজুলেশনও গ্রহণ করেছিল। ভারত প্রথমে এই প্রস্তাবে সাগ্রহে সম্মত হয়েছিল। কিন্তু পরে ভারত গণভোটে অসম্মত হয় এবং এজন্য পাকিস্তানও সেনা প্রত্যাহারে অসম্মতি জানায়। আসলে ভারত নিশ্চিত ছিল, গণভোটের রায় কখনোই ভারতের পক্ষে যাবে না।

কোনো মানদণ্ডেই জম্মু-কাশ্মির ইস্যুকে ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয় মনে করার কোনো সুযোগ নেই। জম্মু ও কাশ্মির ভারতের অংশ নয়- এ মর্মে জম্মু-কাশ্মির হাইকোর্টের একটি ঐতিহাসিক রায়ও রয়েছে। ২০১৫ সালে প্রদত্ত রায়ে ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ ‘বাতিল বা সংশোধনযোগ্য নয়’ বলেও স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়। হাইকোর্টের সে আদেশে বলা হয়েছে, ‘Kashmir is not part of India and thus can not be amalgamated in India. Under the article of 370 constitution, Kashmir is an autonomous area’.

বাংলাদেশ সরকার রাষ্ট্রীয় সংবিধান, আন্তর্জাতিক রীতিনীতি, জাতিসঙ্ঘ ও মানবাধিকার সনদ এবং সর্বোপরি বিশ্বজনমতের বিপরীতে অবস্থান নিয়ে কাশ্মির ইস্যুতে ভারতীয় অবস্থানকে সমর্থন করে যাচ্ছে। এমনকি তারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শ ও চিন্তা-চেতনাকে এক্ষেত্রে বিসর্জন দিতে কসুর করেনি। বিষয়টিকে তারা প্রতিবেশী রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বলে আখ্যা দিয়েছে। অথচ জাতিসঙ্ঘ সনদের ২(৭) ধারায় বলা হয়েছে যে, ‘বর্তমান সনদ জাতিসঙ্ঘকে কোনো রাষ্ট্রের নিছক অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের অধিকার দিচ্ছে না বা সেরূপ বিষয়ের নিষ্পত্তির জন্য কোনো সদস্যকে জাতিসঙ্ঘের দ্বারস্থ হতে হবে না; কিন্তু সপ্তম অধ্যায় অনুযায়ী কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের ব্যাপারে এ নীতি অন্তরায় হবে না’। মনে রাখা উচিত, বাংলাদেশ জাতিসঙ্ঘের একটি সদস্য রাষ্ট্র ও জাতিসঙ্ঘ সনদে স্বাক্ষরকারী দেশ।

জম্মু-কাশ্মির ইস্যুতে বিশ্ব জনমত যখন প্রায় অভিন্ন, তখন এ ইস্যুতে বাংলাদেশ সরকারের ভিন্ন অবস্থান নেতিবাচকই বলতে হবে। যেখানে ভারতের রাজনীতিক, বুদ্ধিজীবীমহল ও নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ কাশ্মিরের বিশেষ মর্যাদার পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন সেখানে এ বিষয়ে কথা বলতে আমাদের আরো সতর্ক হওয়াই জরুরি ছিল। এ ছাড়াও, এ বিষয়ে বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দ্ব্যর্থহীন ও সুস্পষ্ট অবস্থান রয়েছে। তাই আমাদের অতীত অবস্থানের ধারাবাহিকতা, মুসলিম উম্মাহর আবেগ-অনুভূতি এবং বিশ্বজনমতের বিরুদ্ধে গিয়ে বিশেষ রাষ্ট্রের ‘খয়ের খাঁ’র ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া মোটেই কাক্সিক্ষত নয়, বরং এজন্য ভবিষ্যতে আমাদের খেসারতও দিতে হতে পারে।

smmjoy@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement