২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

বাজেট ও অর্থনৈতিক ধসের শঙ্কা

-

নতুন অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপনের আগে ধারণা করা হয়েছিল অর্থমন্ত্রী এবার বেশ কিছু সংস্কার পদক্ষেপ নেবেন, যাতে উচ্চ প্রবৃদ্ধির চিত্রের আড়ালে যে শূন্যতা বাড়ছে তা সঙ্কুচিত হয়ে আসে। এ ব্যাপারে যারা বেশি আশাবাদী হয়ে উঠেছিলেন তারা বাজেটটি উপস্থাপনের পর বেশ খানিকটা আশাহত হতে পারেন। আসলে প্রতি বছর যে এক ধরনের গতানুগতিক কাঠামোতে দাঁড়িয়ে বাজেট উপস্থাপন করা হয় তাতে পরিবর্তন খুব একটা আসেনি এবারো। মোটা দাগে প্রতি বছর পুরো অর্থবছরের রাজস্ব ব্যয়ের একটি কাঠামোর সাথে উন্নয়ন বাজেটের সংযোগ করে মোট ব্যয় আর বাড়তি আয়ের প্রয়োজন চিহ্নিত করা হয়।

রাজস্ব আয় আর বাজেট ব্যয়ের যে ব্যবধান থাকে সেই ঘাটতি অর্থায়নের উৎসগুলোও চিহ্নিত করা হয়। এই ঘাটতির অর্থ বৈদেশিক খাত থেকে যা পাওয়া যেতে পারে তার বাইরের অংশটি সঞ্চয়পত্র ও ব্যাংকিং খাত থেকে নেয়ার একটি হিসাব থাকে। আয় এবং ব্যয় উভয় কাঠামোতে কাদের বাড়তি সুবিধা দেয়া হবে, আর কাদের কাছ থেকে রাজস্ব আদায় করা হবে, তার একটি অগ্রাধিকার নিরূপণ করা হয়Ñ যেখানে রাজনৈতিক অর্থনৈতিক এমনকি বাইরের দেশ বা লবির প্রভাবও সক্রিয় থাকে। দেশী-বিদেশী এই লবির স্বার্থ থাকে বিশেষত উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ এবং কর-শুল্ক নির্ধারণের ক্ষেত্রে।

এই গতানুগতিকতার মধ্যেও সরকারের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ভিশন বা অগ্রাধিকারের প্রতিফলন থাকে বাজেট প্রস্তাবে। আর সরকারের বিশেষ আদর্শ বা দৃষ্টিভঙ্গি থাকলে এই কাঠামোর মধ্যেও কিছুটা পরিবর্তন বা সংস্কার লক্ষ করা যায়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা উত্তর কমান্ড অর্থনীতি থেকে ১৯৭৫ সালে যখন মুক্ত বাজার অর্থনীতিতে রূপান্তর শুরু হয় তখন বাজেট কাঠামোতে উল্লেখযোগ্য সংস্কার আসে। আবার মূল্য সংযোজন করের মতো মৌলিক কর ব্যবস্থার প্রবর্তনের সময়ও রাজস্ব কাঠামোতে পরিবর্তন আসে।

নানা কারণে এবারের বাজেটে সামগ্রিক কোনো সংস্কার পদক্ষেপ নেয়া না হলেও কিছুটা কাঠামোগত পরিবর্তন প্রত্যাশা করা হয়েছিল। নতুন অর্থমন্ত্রী নিজেই এমন আভাস দিয়েছিলেন। বিশেষত, দেশের ব্যাংকিং খাত, পুঁজি বাজার এবং বেসরকারি খাত এমন কিছু সঙ্কটের সম্মুখীন রয়েছে, যা থেকে উত্তরণের জন্য কিছু উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ এবারের বাজেটে থাকবে বলে মনে করা হয়েছিল। কিন্তু সে ধরনের চ্যালেঞ্জ গ্রহণের সদিচ্ছা বা সাহস এবারের বাজেটে দেখা যায়নি।

বাংলাদেশের অর্থনীতি এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে ভেতর থেকে পর্যবেক্ষণ এক সময় রুটিন পেশাগত কাজের অংশ ছিল। এখন সেই পর্যবেক্ষণ কিছুটা দূরবর্তী স্থান থেকে করতে হয়। ২০১১ সালে শেয়ার বাজারে বিপর্যয়ের পর বেসরকারি খাতের বিকাশে বড় ধরনের ব্যত্যয় ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা হচ্ছিল। ২০০৬ সাল এবং ২০১১ সালে বর্তমানের শাসক দল ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় শেয়ার বাজারে ধসের দুটি ঘটনা ঘটায় বাজারের ওপর এক ধরনের আস্থাহীনতা সৃষ্টি হয়। দুই সময়ের মধ্যে শেয়ার বাজারে কাঠামো ও পরিচালনগত বেশ কিছু সংস্কার ঘটায় বাজারে ধস নামার প্রক্রিয়া এক ছিল না। প্রথম সময়ে সেকেন্ডারি শেয়ারের হাত বদলে যেখানে কারসাজি করে বাজারে বাবল ঘটানো হয়েছিল। সেখানে দ্বিতীয়বার কারসাজির জন্য বেছে নেয়া হয় প্রাইমারি শেয়ার ইস্যুকে। প্রতিষ্ঠানের মৌল ভিত্তির সাথে কোনো ধরনের সামঞ্জস্য না রেখেই প্রিমিয়াম যুক্ত করে শেয়ার বাজারে ছাড়ার সুযোগ দেয়া হয় বিভিন্ন কোম্পানিকে। আর বাজারে ছাড়ার পর স্বাভাবিকভাবে এই শেয়ারের দাম একবারে নিম্নপর্যায়ে নেমে আসে। উভয় সময়ে বাজার কারসাজির সুবিধাভোগী ও ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান ছিল অভিন্ন।

২০১১ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত আট বছর সময়ে শেয়ার বাজারে আরেক দফা বাবল ঘটানোর প্রচেষ্টা ঘটেনি তা বলা যাবে না। তবে এই বাজারে জায়গা জমি ঘটি-বাটি বিক্রি করে হামলে পড়ার মতো ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী খুব বেশি না থাকায় সেই প্রচেষ্টায় সাফল্য আসেনি। ফলে রাতারাতি বড় হওয়ার ব্যাপারে লোলুপ ব্যক্তিদের ভিন্ন দিকে দৃষ্টি দিতে হয়। পুঁজি বাজারের পর আরো বড় এবং গুরুত্বপূর্ণ খাত হলো আর্থিক খাত। রাষ্ট্রের সার্বিক অর্থনীতির ওপর এই খাতের প্রভাব প্রতিক্রিয়া পুঁজি বাজারের চেয়েও অনেক ব্যাপক। পুঁজি ব্জাারের চেয়ে আর্থিক খাতের সাথে সংশ্লিষ্টতা অনেক বেশি সংখ্যক মানুষের।

এই আর্থিক খাত নিয়েই শঙ্কাটা কয়েক বছর ধরে বেশি উল্লেখযোগ্যভাবে উচ্চারিত হচ্ছে অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী নেতাদের মধ্যে। তবে রাষ্ট্রের সার্বিক রেজিমেন্টেড ধরনের আবহের কারণে খোলামেলা অভিব্যক্তি খুব কমই নজরে এসেছে। আমেরিকান যুক্তরাষ্ট্র্রের বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান এমআইটির সাথে যুক্ত একজনের গবেষকের লেখা নিয়ে সোস্যাল মিডিয়াতে এখন ঝড় উঠেছে। মূল ধারার কোনো কাগজে এই ধরনের লেখা প্রকাশ হতে দেখা যায়নি। মালয়েশিয়া থেকে আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত একজন বাংলাদেশী এ ব্যাপারে মতামত জানতে চাওয়ার পর লেখাটি গভীরভাবে কয়েকবার পাঠ করি।

এই লেখায় জিয়া হাসান বাবলের ইতিহাস তুলে ধরে বলেছেন, ‘বিশ্বের প্রথম রেকর্ডেড বাবল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, ১৭০০ শতকে ডেনমার্কের টিউলিপ ম্যানিয়াকে। তখন হঠাৎ করে টিউলিপ ফুলের দাম বাড়তে থাকে। দাম বাড়তে থাকায় সবাই টিউলিপ ফুল কেনা-বেচা করতে থাকে। এই ভরসায় যে এই দাম বাড়তেই থাকবে। এমন অবস্থা হয় যে, এক সময়ে একটা ফুলের দাম ওই সময়ে একজন শ্রমিকের তিন মাসের বেতনের সমান হয়ে যায়। একটাপর্যায়ে কাগজের নোটের বদলে টিউলিপ বেচা শুরু হয়, যার মাধ্যমে আপনি ছয় মাস পরের প্রডাকশনও বেচে দিতে পারেন। কিন্তু এই বাবলের পেছনে কোনো ইকোনমিক ফান্ডামেন্টালস ছিল না। মানুষের বাসার শোভা বৃদ্ধি বাদে টিউলিপের কোনো ফাংশনাল বেনিফিট নেই। তাই একদিন যখন হুট করেই টিউলিপের দাম ক্র্যাশ করে, তখন অসংখ্য টিউলিপ ব্যবসায়ী দেউলিয়া হয়ে পড়ে।’

জিয়া উল্লেখ করেন, ‘টিউলিপ ম্যানিয়ার এই বাবল সৃষ্টির কারণ কি? এই প্রশ্নেœর একটা উত্তর হচ্ছে- সাধারণ ব্যবসায়ীরা বড় ব্যবসায়ীদের দিকে তাকিয়ে ভেবেছে- এত বড় বড় ব্যবসায়ী যদি টিউলিপ কিনতে পারে, তার মানে এই ব্যবসায় লাভ আছে। এটা একটা ট্রাস্ট ইস্যু। বড় ব্যবসায়ীরা যাদের মার্কেট সম্পর্কে ধারণা থাকার কথা, যাদের হাতে অনেক টাকা-পয়সা তাদের ডিলিংস দেখে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা ধরে নিয়েছে- এই ব্যবসায় রিস্ক থাকলে তো এত বড় বড় ব্যবসায়ীরা ইনভেস্ট করত না, এই চিন্তা করে, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরাও টিউলিপ ম্যানিয়াতে নেমে পড়ে। এই ট্রাস্ট জিনিসটা যেকোনো ফিন্যান্সিয়াল বাবলের একটা বড় উৎস। এই ট্রাস্টের কারণে, একজন আরেকজনকে পজিটিভ ফিডব্যাক দিতে থাকে। এটাকে বলে ফিডব্যাক লুপ।’

জিয়া হাসানের মতে, ‘আগামী কয়েক বছরের মধ্যে বাংলাদেশে যে ম্যাসিভ ফিন্যান্সিয়াল ক্র্যাশ হবে তখন, আমরা সরকার, প্রাইম মিনিস্টার, অর্থমন্ত্রী, ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, আইএমএফ, সিপিডি, পিআরআই, সানেম এডিবিসহ বিভিন্ন অরগানাইজেশানকে দায়ী করব, যারা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বর্তমান যে বাবল সৃষ্টি হয়েছে তাকে ক্রমাগত ভ্যালিডেশান দিয়ে গেছে। বাংলাদেশের অর্থনীতি বিগত প্রায় সাত-আট বছর খারাপ যাচ্ছে। এই খারাপের শুরু ২০১০ সালে শেয়ার মার্কেট বাবল বাস্টের সাথে সাথে। কিন্তু এই সময়ের মধ্যে সরকার ব্যাপক অর্থনৈতিক প্রগতি দেখিয়ে গেছে শুধু ডাটা ম্যানিপুলেশান করে। অবশ্যই অর্থনীতির বেশ কিছু অংশ এর মধ্যে রিকভার করেছে; কিন্তু ওভার অল বাংলাদেশের অর্থনীতি ঠিকমতো রিকভার এখনো করেনি।’

জিয়া বলেছেন, ‘অর্থনীতি ভালো না খারাপ যাচ্ছে তার প্রধান সিগন্যাল বাজার অর্থনীতিতে আসে শেয়ার মার্কেট থেকে। এই পুরো সময়ে শেয়ার মার্কেট খারাপ গেছে। এই সময়ে পার ইউনিট অফ জিডিপি তৈরি করতে পার ইউনিট অফ এনার্জি কনজাম্পশান অস্বাভাবিকভাবে কমে এসেছে, যেটা পরিষ্কার ইন্ডিকেট করে জিডিপি ডাটা ম্যানিপুলেট করা হয়েছে। আমরা দেখতে পারব নাইট লাইট তুলনা করলে, কিভাবে এই ৯ বছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধি সরকারি ডাটার সাথে মেলে না। আমরা দেখতে পারব, পার ইউনিট এনার্জি কনজাম্পশান জিডিপি প্রবৃদ্ধির সাথে মেলে না। এই সময়ে সরকারি ডাটা মতেই, মানুষের ক্যালোরি কনজাম্পশান কমেছে। এই সময়ে সরকারি ডাটা মতেই, দেশের বিভিন্ন সাইজের ফ্যাক্টরির সংখ্যা কমে এসেছে। এই সময়ে সরকারি ডাটা মতেই, শ্রমিকদের ইনফ্লেশান অ্যাডজাস্টেড আয় কমেছে। এই সময়ে সরকারি ডাটা মতেই, ওপরের ১০ শতাংশ বাদে, বাকি ৯০ শতাংশ জনগোষ্ঠীর আয় কমেছে।’

জিয়া হাসান বলেছেন, ‘দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক ইকোসিস্টেমের পতন এবং বুম সাইকেলের পরে বাস্ট সাইকেলে বাংলাদেশের পা দেয়া; কিন্তু বাস্ট সাইকেলের ডাটা ম্যানিপুলেট করে একটি ফেক অর্থনৈতিক উচ্চ প্রবৃদ্ধির হাইপ তোলা- এটা নিয়ে তাদের কিছু বলার নেই। মার্কেটে যে ফিডব্যাক লুপ সৃষ্টি হয়েছে, তাতে সরকার এবং দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের একটি জালিয়াত ধারণার ওপরে সরকার, বিগত কয়েক বছর প্রতি বছর বিশাল বিশাল বাজেট তৈরি করে গেছে, সরকারি কর্মচারীদের বেতন বাড়িয়ে গেছে, সরকারের খরচ বাড়িয়ে গেছে এবং বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প সৃষ্টি করে ব্যাপক লুটের মকশো করছে। আর সেই অতিরিক্ত খরচের জোগান দিতে গিয়ে যে অতিরিক্ত ট্যাক্সেশান করা হয়েছে, সেটা অনেক ক্ষেত্রেই ব্যবসায়ী এবং কনজিউমার উভয়ের সক্ষমতাতে হাত দিয়েছে- যা বর্তমান দুরবস্থা দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার একটা মূল কারণ।’

জিয়ার মতে, ‘যেকোনো অর্থনৈতিক সিস্টেম একটা বুম এবং বাস্ট পিরিয়ডের মধ্য দিয়ে যায়, যাকে বলা হয় বিজনেস সাইকেল। এর মধ্যে আছে নিকোলাই ক্লোডাট্রিয়াল ওয়েভ, যা একটা ৫০ থেকে ৬০ বছরের লং টারম সাইকেল, আছে সাইমেন ক্লুজনেটের ১৫ থেকে ২০ বছরের ইনভেস্টমেন্ট সাইকেল, জোসেফ কিচেনের ৮ থেকে ৯ বছরের ইনভেন্টরি সাইকেল, ক্লেমন ইয়গ্লার ফিক্সড ইনভেস্টমেন্ট বিজনেস সাইকেল, যা এভারেজ হয় ৩.৩ বছরে। এটা ছাড়াও আছে, ১০/১২ বছরের ডেট সাইকেলসহ অনেক ধরনের সাইকেল যা প্রাকৃতিক নিয়মে ওঠানামা করে। ফিজিক্সের ফুরিয়ের সাইকেলের মতো এ সাইকেলগুলো সমাজ, পরিবেশ, আন্তর্জাতিক অর্থনীতি, গ্লোবাল সাইকেলসহ অনেক কিছুর সাথে সংযুক্ত। পৃথিবীর প্রতিটি দেশের অর্থনীতির এই সাইকেলগুলোর নিয়মে প্রবৃদ্ধি, স্থিরতা ও রিসেশান চলে।’

জিয়া বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সংস্কৃতির ওপর আলোকপাত করে বেশ কয়েকটা বিপদ চিহ্নিত করেছেন। বলেছেন, একটা বাস্ট পিরিয়ডকে একটা দুর্নীতিমগ্ন সরকারকে ক্ষমতায় বসিয়ে রাখার জন্য, বুম দেখা যাওয়ার জন্য, মার্কেটে, ব্যক্তিপর্যায়ে, সমাজের একটা খারাপ পিরিয়ডকে সাস্টেন করার কারণে অর্থনৈতিক শক্তিগুলো ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। ব্যাংকিং সেক্টরে আমরা সেই ইম্প্যাক্টটাই দেখতে পাচ্ছি। দ্বিতীয়ত, আপনি যখন একটা বাস্ট পিরিয়ডকে আইডেন্টিফাই করতে পারবেন, তখন আপনি আবার উঠে আসার জন্য কিছু স্ট্রাকচারাল পরিবর্তন করবেন। যার কারণেই আপনি আবারো বাস্ট পিরিয়ড থেকে বুম পিরিয়ডে উঠে আসবেন। যেগুলো না করা হলে আপনি কোনো মতেই রিকভারি করতে পারবেন না।

তৃতীয়ত, আপনি বাস্ট পিরিয়ডে যেমন ইচ্ছা খরচ করবেন, সব কিছু ধ্বংস করবেন তখন আপনার পতন অনেক গভীর এবং অনেক দীর্ঘ স্থায়ী হবে। এই মিথ্যার সাইকেল যত দীর্ঘ হবে, আপনার পরবর্তী রিকভারি ততটাই কঠিন হবে। আর সব চেয়ে খারাপ যেটা সেটা হচ্ছে, এই বাস্ট পিরিয়ডে মানুষের যে সাফারিংস, বেকারত্ব এবং অর্থনৈতিক দুর্যোগ সেটাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত করবেন। কিন্তু মানুষ যে সাফারিংসয়ের মধ্য দিয়ে যাবে তাকে নরমালাইজ করে ফেলবেন। আপনি বলবেন, ‘উন্নয়ন যেহেতু হচ্ছে, তাই আপনার যে দুর্যোগ সেটা আপনার ব্যক্তিগত দুর্বলতা। ’

জিয়ার অনুসিদ্ধান্ত হলো, ‘একটা খুব গভীর ফিন্যান্সিয়াল ক্রাইসিসে বাংলাদেশে পড়তে যাচ্ছে। এটা প্রকৃতির অগ্রাহ্য নিয়মে হবে না, এইটা ম্যান মেড। সেটি বছর তিনেকের মধ্যে আসবে। এবং এই বিগত কয়েক মাসে যা ঘটছে তাতে প্রেডিকশানগুলো যে ইন্ডিকেশানের ভিত্তিতে সৃষ্টি হয়েছে সেগুলো আরো দৃঢ় হয়েছে এবং এই ফিন্যান্সিয়াল ক্রাইসিসের রূপটাও কেমন হবে সেটাও ধারণা করা সম্ভব। বিভিন্ন ধরনের অনিশ্চয়তার পরে, আমরা একটা ব্যাপক ইনফ্লেশান দেখতে পাবো। যাতে মধ্যবিত্তের সঞ্চয় নিঃশেষ হয়ে যাবে। এই যে সঞ্চয়পত্রে যারা বিনিয়োগ করেছে, দুই বছরে ২৫ শতাংশ, ২৫ থেকে ৫০ শতাংশ রিসেশানেই তাদের কী অবস্থা হবে আমি চিন্তা করি। তখন যে প্যানিক সেট হবে, তারপরে কী হবে সেটা চিন্তা করতেও ভয় লাগে। বিগত কয়েক বছর যে বিশাল বাজেট সৃষ্টি করা হচ্ছে, সেটাও এই ফিনান্সিয়াল ক্রাইসিসের মূল একটা কারণ। সরকার এখন যে হাই ট্যাক্সেসান করছে এবং অর্থনীতিবিদেরা তাতে বাংলাদেশের ডেট টু জিডিপি কম বলে বলে, সরকারকে আরো হাই ট্যাক্স বসাতে উৎসাহ দিচ্ছে, সেটা আমাকে টিউলিপ ম্যানিয়ার কথাই মনে করিয়ে দিচ্ছে।’

জিয়া হাসান লিখেছেন, বাংলাদেশের সরকার যেটা কম ডেট টু জিডিপি বলছে, সেখানে ব্যক্তি এবং বিজনেসের যে প্রফিটটুকু আছে তা মার্কেটের বিভিন্ন ফলস অলরেডি কনট্রোল নিয়েছে, তার মধ্যে আছে চাঁদাবাজি সিন্ডিকেট, ব্যুরোক্র্যাট দুর্নীতি ইত্যাদি। এগুলোও ট্যাক্স। এখন সরকার বিশালভাবে ভ্যাট বসাচ্ছে। এগুলো পতনকে আরো ত্বরান্বিত করবে। কারণ জিনিসপত্রের দাম আরো বাড়বে, বিজনেস আরো কম্পিটিভনেস হারাবে। চাকরির সুযোগ কমবে। কিন্তু সবচেয়ে মারাত্মক হলো, মানুষের সাফারিংস বাড়বে। নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত মানুষ এখন কী সাফারিংসয়ের মধ্যে আছে সেটা কোথাও চিত্রিত হচ্ছে না। বড় লোকদের সমস্যা নেই। তারা তাদের টাকা পাচার করে দিয়েছে। এখন শুধু শীর্ষ ব্যবসায়ী না মাঝারি আকারের উচ্চ বিত্তরাও টাকা বাইরে পাঠিয়ে দিচ্ছে। তারা সবাই এই ক্রাইসিসটার জন্য অপেক্ষা করছে।’

বাংলাদেশের ব্যাপারে যে ধরনের অর্থনৈতিক ক্রাইসিস বা সঙ্কটের আশঙ্কা জিয়া করছেন দুটি দেশের সেই একই ধরনের সঙ্কটের অভিজ্ঞতা রয়েছে। ২০০৭-০৯ সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে এবং গ্রিসে আর্থিক সঙ্কটের সৃষ্টি হয়। গ্রিসের সঙ্কট ২০১৭ সাল পর্যন্ত চলতে থাকে। দুই দেশের অর্থনৈতিক সঙ্কটের কারণ ও প্রকৃতির সাথে বেশ কিছু মিল এবং অমিল রয়েছে। এই অর্থনৈতিক সঙ্কটের প্রভাব আশপাশের বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন মাত্রায় পড়েছে। তবে ২০০৮ সালের আমেরিকান অর্থনৈতিক সঙ্কটের বড় ধরনের প্রভাব বাংলাদেশে দেখা যায়নি। কিন্তু এখনকার জন্য উদ্বেগের বিষয় হলো দুটি দেশেই যেসব কারণে অর্থনৈতিক সঙ্কট দেখা দিয়েছে তার অনেক কারণ এখনকার বাংলাদেশ পরিস্থিতিতে অবিস্ফোরিত অবস্থায় বিদ্যমান রয়েছে।

আমেরিকান অর্থনৈতিক সঙ্কট শুরু হয় ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান দিয়ে। এর আগে আমেরিকান অর্র্থনীতিতে একটি চাঙ্গাবস্থা পার হয়। এ সময়ে ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীরা অধিক মুনাফা অর্জনের কৃতিত্ব নেয়ার জন্য আগ্রাসী বিনিয়োগ করে। আর কোল্যাটারেল হিসাবে জমা রাখা সম্পদের অতি মূল্যায়ন করে ঋণ মঞ্জুর করে। আবাসন ও অন্য কয়েকটি খাতে মন্দা শুরু হলে ঋণগ্রহীতাদের মধ্যে খেলাপি হওয়ার প্রবণতা শুরু হয়। এতে ব্যাংকগুলো জামানত বিক্রি করতে গেলে সম্পদ বিক্রির মহাচাপ শুরু হয়। অতিমূল্যায়িত সম্পদের দাম এমনভাবে নিচে পড়ে যায় যে কোল্যাটারাল বিক্রি করে এক তৃতীয়াংশ ঋণ আদায় কঠিন হয়ে পড়ে। এর প্রভাব মারাত্মকভাবে পড়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর। দেউলিয়াত্বের হাত থেকে বাঁচাতে সরকারের হস্তক্ষেপের প্রয়োজন হয়।

গ্রিসের ক্ষেত্রে সঙ্কটের মূল কারণ ছিল সরকারের জনতুষ্টিবাদি নীতি। একের পর এক সরকার ভোটারদের খুশি করতে তাদের বেতন বোনাস বাড়াতে থাকে। স্থূল দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির আকার অনেক ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দেখানো হয়। ঋণের অঙ্ক কমিয়ে প্রদর্শন করে ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান থেকে অধিক ঋণ গ্রহণ করা হয়। একপর্যায়ে রাষ্ট্রের বিদেশী ঋণ ফেরত দানে অনিশ্চয়তা দেখা দিলে তথ্য ধামাচাপা দেয়া কঠিন হয়ে ওঠে। তখন ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক তদন্ত করে দেখে যে, সরকারের দেয়া নানা তথ্যের মধ্যে ভ্রান্তি রয়েছে। পরে আইএমএফ ও ইউরোপীয় ব্যাংক কৃচ্ছতা নীতি চাপিয়ে দেয়। এক বছরেই কয়েকটি সরকারের পতন ঘটে। ২০০৭ সালে সরকারি ঋণ যেখানে জিডিপির ১২৭ শতাংশ ছিল তা ২০১৭ সালে ১৭৯ শতাংশে উন্নীত হয়। স্ফীত জিডিপি সংশোধনের কারণে এর আকার ছোট হয়ে এই অবস্থা দেখা দেয়।

বাংলাদেশে ৮০ দশককে মনে করা হতো ব্যাংকিং খাতের বিশৃঙ্খলার সময়। এই সময় ঋণ নিয়ে তা ফেরত না দেয়ার একটি সংস্কৃতি সৃষ্টি হয়। দশকের শেষ দিকে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ-এর পরামর্শে ব্যাংকিং খাতে সংস্কার কর্মসূচি নেয়া হয়। এর পর থেকে ব্যাংকিং খাতের সার্বিক অবস্থার উন্নতি হতে থাকে। তবে চলতি দশকের গোড়া থেকে ব্যাংকের অবস্থার আবার অবনতি হতে থাকে। রাজনৈতিক বিবেচনায় নতুন নতুন ব্যাংক দেয়া হয়। আর বেসরকারি ব্যাংকগুলোর নিয়ন্ত্রণ অধিগ্রহণ করা হতে থাকে একের পর এক। এই নিয়ন্ত্রণ নেয়ার সাথে সাথে নামে বেনামে ঋণ মঞ্জুর হতে থাকে নতুন মালিকদের ইচ্ছায়। রাজনৈতিক চাপে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তার তদারকি কার্যক্রমকে পেশাদারিত্বের ভিত্তিতে পরিচালনা করতে অপারগ হয়ে ওঠে। ব্যাংক, সেটি সরকারি বা বেসরকারি যেটিই হোক না কেন, সুশাসন এক প্রকার বিদায় নেয়।

অর্থ মন্ত্রণালয় ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ব্যাংকিং খাতের স্বচ্ছতা ও গুণগত মান উন্নয়নের পরিবর্তে বড় বড় খেলাপি ঋণগ্রহীতাদের স্বার্থে নীতি প্রণীত হতে থাকে। ব্যাংকের নির্বাহীরা যুক্তরাষ্ট্রের মতো পরিচালকদের মুনাফা দেখানোর জন্য নিজেদের উদ্যোগে অনিয়মিত ঋণকে নিয়মিত দেখিয়ে প্রকৃত চিত্র আড়াল করতে থাকে। অনেক বড় বড় ঋণের বিপরীতে অতিরিক্ত জামানত এমনভাবে রাখা হতে থাকে, যা বিক্রি করে ঋণের এক দশমাংশও পাওয়া যাবে না। মূল্যস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে ডলার রেট কমান্ড ইকোনমির মতো করে কেনাবেচা দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। অর্থ সরবরাহ নিয়ন্ত্রণে স্বচ্ছতা কতটা অনুসরণ করা হচ্ছে তা নিয়ে সংশয় সৃষ্টি হয়েছে। জিডিপিসহ জাতীয় অর্থনৈতিক হিসাবের ব্যাপারেও সৃষ্টি হয়েছে অনেক প্রশ্ন। সব মিলিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও গ্রিসের অনেক বৈশিষ্ট্য এখন বাংলাদেশে বিদ্যমান দেখা যাচ্ছে।

২০০৮ সালের আমেরিকান অর্থনৈতিক সঙ্কটের সময় বাংলাদেশ রক্ষা পাওয়ার একটি বড় কারণ ছিল তখন বাংলাদেশের স্বল্পকালীন বৈদেশিক দায় ছিল না। ফলে সঙ্কটের সময় বাইরের অর্থ পরিশোধের চাপ ছিল না। এখন সরকারি ও বেসরকারি উভয় খাতে স্বল্প ও মধ্য মেয়াদি বড় অঙ্কের দায় রয়েছে। বাংলাদেশের অনেক নাম করা ব্যাংকের এখন এলসি গ্রহণ করে না শীর্ষ আন্তর্জাতিক ব্যাংকগুলো। সঙ্কট শুরু হলে এ অবস্থার আরো অবনতি ঘটতে পারে।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো বাংলাদেশের সাথে বিশ্ব ব্যাংক, আইএমএফ ও এডিবির সম্পর্ক অনেকটা টেকনিক্যাল পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। এখন চীনের ঋণ ও বিনিয়োগের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে সরকারকে। ভারতের নির্বাচনে বিপুলভাবে মোদি ক্ষমতায় ফেরার পর ইতোমধ্যে চীনের সাথে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক সীমিত করার চাপ শুরু হয়েছে। এই টানাপড়েন বাড়লে চীনা অর্থের যে প্রবাহ সেটি কমে যেতে পারে। এটি ঘটলে বৈদেশিক মুদ্রার ওপর চাপ আরো বাড়তে পারে। এই অবস্থায় বড় আকারের অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের যে আশঙ্কা ব্যক্ত করা হচ্ছে সেটি অনিবার্য হয়ে দাঁড়াবে না- এমন কোনো ভরসা দেখা যাচ্ছে না।
mrkmmb@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement
নোয়াখালীতে প্রবাসীর স্ত্রীর ব্যক্তিগত ছবি দেখিয়ে চাঁদা আদায় দেশের উন্নয়নে পাকিস্তান প্রশংসা করে, অথচ বিরোধী দল দেখে না : কাদের আশুলিয়ায় বাঁশবাগান থেকে নারী পোশাক শ্রমিকের রক্তাক্ত লাশ উদ্ধার মিয়ানমারের কর্মকর্তারা ফেরত গেলেন, কিন্তু রোহিঙ্গা সঙ্কট কি আরো জটিল হচ্ছে দিনাজপুরে দুই ট্রাকের সংঘর্ষ, চালক-হেলপার নিহত মানিকগঞ্জে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ২ সখীপুরে বৃষ্টির জন্য অঝোরে কাঁদলেন মুসল্লিরা দক্ষিণ ভারতে কেন কাজ করেনি বিজেপির হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি জাতীয়তাবাদী ওলামা দলের নতুন আংশিক কমিটি বাংলাদেশের হাসপাতাল ও চিকিৎসায় বিনিয়োগ সম্ভাবনা অন্বেষণে থাইল্যান্ডের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর আহ্বান ট্রাম্পের বিচার নিয়ে বিভক্ত যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্ট

সকল