২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

পুরনো কাহিনী ও নতুন কাণ্ড

পুরনো কাহিনী ও নতুন কাণ্ড - ছবি : নয়া দিগন্ত

৪ জুন মঙ্গলবার দিবাগত সন্ধ্যা। পরদিনই ঈদ হবে বলে প্রায় সবাই ধরে নিয়েছেন। সড়ক, নৌপথ আর রেলপথে ঘরমুখো অসংখ্য মানুষের অবর্ণনীয় ভিড়। অনেকে শেষ মুহূর্তে ঈদের শপিং সেরে নিচ্ছেন। ‘জাতীয় চাঁদদেখা কমিটি’ নিয়মমাফিক বৈঠকে বসেছে। সবার নজর টিভির পর্দার দিকে- কখন ঈদের খবর আসে, বলা তো যায় না। কিন্তু না, টিভিতে জানা যায়- দেশের কোথাও নতুন চাঁদ দেখা যায়নি। অতএব, বৃহস্পতিবার ঈদুল ফিতর, বুধবার নয়। ‘নিশ্চিতভাবে’ এ খবর প্রচারিত হওয়ায় অবশিষ্ট অনিশ্চয়তা ঝেড়ে অনেকে যথারীতি তারাবির জামাতে গেলেন। ধর্মপ্রাণ মানুষের কেউ কেউ ঈদের আগের রাত (তখনকার হিসাবে বুধবার দিবাগত রজনী) পবিত্র কুরআন তেলাওয়াত করে বেশি সওয়াব হাসিল করবেন ঠিক করলেন। আর পথেঘাটে, স্টেশন-টার্মিনালে কিংবা যানজটে যারা রোজার দিনে গরমের মধ্যে সকাল থেকে আটকা পড়ে, বাড়িতে পৌঁছে ঈদের নামাজ পড়তে পারার আশা ছেড়েই দিয়েছেন, তারা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। কেননা, বৃহস্পতিবার ঈদ হলে মাঝে একদিন সময় পাওয়া যাবে। এর মধ্যে বাড়ি পৌঁছা সম্ভব হবে বৈকি। না, আশা আর পূরণ হয়নি। কারণ, রাত সোয়া ১১টার দিকে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী নিজেই জানিয়ে দেন পরদিন ঈদ হবার কথা। শুনে অন্য সময়ের মতো আনন্দের চেয়ে বিস্ময় ছিল বেশি। চাঁদ দেখা কমিটির নতুন নজির স্থাপন করে দ্বিতীয়বারের মতো বৈঠকে বসেছিল সে রাতে। এতে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, ‘যেহেতু দেশের কোথাও কোথাও শাওয়ালের চাঁদ দেখা যাওয়ার খবর এসেছে, অতএব বুধবারেই ঈদ পালিত হবে, বৃহস্পতিবার নয়।’ নিয়মমাফিক এটাই সঠিক সিদ্ধান্ত। মঙ্গলবার মক্কা-মদিনায় ঈদ হয়েছে, লন্ডনে ক্রিকেটার মাশরাফিরা ঈদ করেছেন, বাংলাদেশের পূর্বদিকে অবস্থিত মুসলিম দেশগুলোতেও একই দিনে হলো ঈদুল ফিতর। তাহলে আমাদের দেশে বুধবারেই তা হওয়ার কথা।

এবার জনমনে মূল প্রশ্ন সেটা নয়। কথা হলো, ঈদের চাঁদ দেখা নিয়ে সংশ্লিষ্ট সরকারি কমিটি জরুরি মিটিং করেছে। এই দ্বিতীয় বৈঠকেই বুধবার ঈদ পালনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। তাহলে এবার শবেবরাত উপলক্ষে প্রয়োজনে দ্বিতীয়বার মিটিং ডাকা কি অসম্ভব ছিল? যদি তা করা হতো, তা হলে হয়তো শাবান মাসের চাঁদ দেখা নিয়ে অহেতুক বিভ্রান্তি ও বিতর্ক জন্ম নিত না।

যা হোক, ৫ জুন পবিত্র ঈদুল ফিতরের দিন এবং পরদিনও অনেকে বাড়ি গেছেন যথাসময়ে যেতে পারেননি বলে। আবার অনেকে জীবিকার তাগিদে এবং জরুরি কাজে ঈদের পরদিনই বাড়ি থেকে ফিরে এসেছেন। তবে সরকারি চাকুরেসমেত পেশাজীবীদের বেশির ভাগ এবার ম্যারাথন ছুটি ভোগ করেছেন ঈদের আনন্দ উপভোগের পাশাপাশি। তাদের ‘ছুটি’ শুরু হয়েছে ঈদের আগের শুক্রবার, শেষ হয়েছে ঈদের পরের শনিবার। মাঝে ৩ জুন সোমবার ব্যাংকে কিছু কাজ হলেও বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠান খোলা ছিল নামেমাত্র। স্টাফদের অবস্থা হয়েছিল ‘আইলাম আর গেলাম’। হাজিরা দিয়েই অনেককে ছুটতে হয়েছে বাড়ি যাওয়ার গাড়ি ধরার জন্য।

এবারো রোজার মাসে হত্যা, হানাহানি, ধর্ষণ, প্রতারণা ইত্যাদি নারকীয় অপরাধ সমানে চলেছে, তেমনি ঈদের দিনেও খারাপ খবর শুনতে হয়েছে। এবার মাহে রমজানে মসজিদে তারাবির জামাতে কুপিয়ে মুসল্লি হত্যার খবর নিশ্চয়ই বহু দিন ভুলবেন না অনেকে। তেমনি, ঈদের দিনেও বিরোধীদলীয় নেত্রী ও তিনবারের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর ৭৪ বছরের অসুস্থ দেহে কারাযন্ত্রণা এবং তার সাথে কাউকে দেখা করতে না দেয়া সাক্ষ্য দেয়, ঈদ মানে সবার জন্য আনন্দ নয়। আর বিদেশের দুঃসংবাদের মধ্যে মুসলিম দেশ সুদানে গুলিতে অন্তত ১১৩ জন বিক্ষোভকারীর মৃত্যু ঈদের উৎসব অনেকটাই ম্লান করে দিয়েছে। সেখানে ক্ষমতাসীনেরা বেসামরিক কর্তৃপক্ষকে প্রাধান্য দিতে টালবাহানা করার অভিযোগে জনতা রাজধানীর রাজপথে বিক্ষোভ করছিল। প্রথমে ৩৫ জনের মৃত্যুর সংবাদ দিয়ে জানানো হয়, এ সংখ্যা বাড়তে পারে। কিছু পরে জানা যায়, ৬০ জনের মৃত্যু হয়েছে। ঈদের রাতে তা বেড়ে একশ’রও বেশি হয়ে গেছে! এ অবস্থায়, আরব জগতের দেশটিতে এবার ঈদ কেমন উদযাপিত হলো, তা কাউকে বলে দিতে হয় না।
ট্রেনের বিপর্যয় ও রাস্তায় বিক্ষোভ

‘ঈদের আগে বাংলাদেশের ঈদ।’ এবার ঈদের প্রাক্কালে একটি পত্রিকার প্রধান শিরোনাম। এ দেশে তো ঈদ হয় সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের অন্তত একদিন পরে। তাই এখানে অন্যদের আগে ঈদ উদযাপন অস্বাভাবিক এবং অসম্ভবও। আসলে ২ জুন ক্রিকেট বিশ্বকাপে দক্ষিণ আফ্রিকাকে ২১ রানে হারিয়ে দিয়েছে আমাদের জাতীয় টিম। ইংল্যান্ডে বিশ্বকাপের শুভসূচনাতেই রেকর্ড গড়ায় খুশিতে ভেসেছে সারা দেশ। এই আনন্দে শামিল হয়ে পত্রিকাটি ওই হেডিং দিয়েছে। বাংলাদেশের হাসি শেষ পর্যন্ত ধরে রাখাই বড় কথা।
দেশের মানুষ নাড়ির টানে বাড়ির পানে দলে দলে ছুটছে জুন মাস আসার আগে থেকেই। অনেকেই পরিজনকে আগেভাগে দেশের বাড়ি (গ্রাম বা মফঃস্বল) পাঠিয়ে দেন যাতায়াত-বিড়ম্বনা এড়াতে। বেশির ভাগ চাকুরে ছুটি নেন ঈদের পরে। তবে ঈদের আগেও অনেককে ছুটি নিতে দেখা যায়, যারা এ ছুটি শেষ হওয়ার পর প্রথম দিনেই হাজির হয়ে যান কর্মস্থলে। যা হোক, বাড়িতে ঈদানন্দ উপভোগ করতে হলে আগে ছুটতে হয় ‘গাড়ির পানে’। এই গাড়ি স্থলযান ও জলযান- দুটোই হতে পারে। আজকাল অবশ্য পয়সাওয়ালাদের বিরাট অংশই আকাশযানে বাড়ি যাওয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে। এবারও পুরনো লক্কড়মার্কা বাস-মিনিবাস কিংবা লঞ্চ ঘষে মেজে, রঙচঙ মাখিয়ে নতুন দেখানোর হাস্যকর প্রয়াস কম হয়নি। উদ্দেশ্য, এসব বাজে বা বুড়ো যানবাহন দিয়ে ঈদ মওসুমে যাত্রী টেনে কিছু পয়সা কামানো। কিন্তু, যতই বাহারি মেকআপ লাগিয়ে বৃদ্ধ যানকে যুবা সাজানো হোক না কেন, এগুলো মাঝপথে দুর্ঘটনা ঘটানোর শঙ্কা থাকে বেশি। এতে প্রাণ হারিয়ে ও আহত হয়ে বিপুল ক্ষতির শিকার হন নির্দোষ ও অসহায় যাত্রীরা, তার মেকআপ (ক্ষতিপূরণ) কোনো দিন সম্ভব নয়। এদিকে, প্রাকৃতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের সাথে এবার শিডিউল বিপর্যয় যোগ হয়েছে বিশেষভাবে। রেলপথে ট্রেনের ৭-৮ ঘণ্টা বিলম্বে ঈদে ঘরমুখো নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধের অবর্ণনীয় দুর্দশার চিত্র পত্রিকায় উঠেছে। ছবিতে দেখা যায়, এসব দুর্ভাগা যাত্রীর কেউ কেউ প্লাটফর্মে ঘুমিয়ে পড়েছেন ট্রেনের জন্য প্রতীক্ষায় থাকতে থাকতে। এই দুঃখনিদ্রায় তারা বাড়ি গিয়ে সানন্দে ঈদ উদযাপনের স্বপ্ন দেখেছেন কিনা কে জানে। রেলমন্ত্রী ট্রেনের শিডিউল বিপর্যয়ে ‘ক্ষমা প্রার্থনা’ করলেও সে স্বপ্ন হয়তো সবার পূরণ হয়নি। সরকারবান্ধব অনুগৃহীত ব্যক্তিদের মালিকানাধীন কোনো কোনো টিভি চ্যানেল বলেছে, মাননীয় মন্ত্রী ‘দুঃখ প্রকাশ’ করেছেন (তা হলে তিনি কি জনগণের কাছে আসলেই ক্ষমা চাননি?)।

ঈদের আগের দিন সকাল থেকে বিশেষ করে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে সাঙ্ঘাতিক যানজট ছিল। রাতেও একই দুর্ভোগ ঘরমুখো হাজার হাজার মানুষের। এটা কোনো আঞ্চলিক পরিবহন রুট নয়, দেশের ব্যস্ততম মহাসড়ক হয়ে উঠেছে উত্তরবঙ্গের সাথে রাজধানীর যাতায়াতের এই মাধ্যমটি। ৪ জুন দিন যত বাড়ছিল, ততই এই সড়কের বেহাল চিত্র আর চরম জনদুর্ভোগের ছবি বিশদ ফুটে উঠছিল টিভিতে। বিকালে জানা গেল, গাজীপুরের চন্দ্রা থেকে টাঙ্গাইল হয়ে একেবারে যমুনা সেতু পর্যন্ত দীর্ঘপথে যানজট। ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করে অতিষ্ঠ হয়ে বিক্ষুব্ধ যাত্রীরা স্থানে স্থানে প্রতিবাদ মিছিল করতে থাকেন। একপর্যায়ে টাঙ্গাইলের পুংলিতে একটি ভ্রাম্যমাণ আদালতের একজন ম্যজিস্ট্রেটের গাড়ি জনরোষের শিকার হয়েছে। টিভি চ্যানেলের ছবিতে দেখা গেছে, ক্রোধের আগুন জ্বলছে দাউ দাউ করে আর পুড়ছে সরকারি গাড়িটি। এদিকে, বাস-মিনিবাসের দীর্ঘ সারি আটকা পড়ে আছে। নারায়ণগঞ্জ-গুলিস্তানের মতো অন্যান্য রুটের বাসও ঈদের অতিরিক্ত যাত্রী বহনের জন্য সেখানে গিয়েছিল। অনেক নারী-পুরুষ, ছেলে-বুড়ো যাত্রীকে দেখা গেছে- আটকে থাকা গাড়ি থেকে নেমে, কাঁধে ব্যাগ, আর মাথায় বোঝা নিয়ে কষ্ট করে হাঁটতে। পরদিন সকালে সুদূর গণ্ডগ্রামে পরিবার-পরিজনের সাথে ঈদ করা সম্ভব হবে কিনা- এই দুশ্চিন্তায় অস্থির অসংখ্য মানুষের কষ্টের শেষ ছিল না শেষ রোজার দিনে। এর মধ্যে ‘কাটা ঘায়ে নুনের ছিটার’ মতো শোনায় ক্ষমতাবান কেউ কেউ যদি বলেন, ‘এবার আমাদের সড়কগুলো ইতিহাসের সেরা অবস্থানে আছে। এবারের ঈদে কোনো যানজট হবে না।’ আধুনিক যুগের গণতান্ত্রিক রাজনীতি আর জ্যোতিষীসুলভ ভবিষ্যদ্বাণী যে এক নয়, তার প্রমাণ ঈদ-পূর্ব সড়ক পরিস্থিতি।

ঈদের দিন একে তো লঘুচাপজনিত বৃষ্টির কারণে গুরুতর দুর্ভোগ, তার ওপর সকাল থেকে দিনভর বারবার টিভির মর্মান্তিক খবর, ফরিদপুরে বাস দুর্ঘটনায় ছয়জন নিহত আর ২৬ জন আহত এবং ঝিনাইদহে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় একসাথে তিনজনের মৃত্যু। স্বজনহারা নারীর আহাজারির ছবিও দেখা গেল টেলিভিশনে। এর পরই সরকার সমর্থক টিভিতে আবার সরকারের মন্ত্রীর অমিয়বচন : ‘এবার ঈদে মানুষ শান্তিতে বাড়ি গেছে, স্বস্তির সাথে ফিরবে।’ সড়ক ট্র্যাজেডি যেখানে ঈদের সব আনন্দকে হত্যা করেছে, সেখানে এমন উক্তি মর্মান্তিক প্রহসন ছাড়া আর কী হতে পারে? পথে পথে গাড়ি উল্টে, ধাক্কা খেয়ে, ব্রেক ফেল করে যদি একদিনে দু’ডজন মানুষের প্রাণহানি ঘটায়, এটাকে কেউ শান্তি বা স্বস্তি বলতে পারেন না। উল্লেখ করা দরকার, এবারে ঈদের আগে রোববার বিভিন্ন স্থানে সড়ক পথের ‘দুর্ঘটনায়’ ২৩ জন আর খোদ ঈদের দিন ২৫ জন নিহত হয়েছেন। আহত অনেক। ঈদের আগের রাতে মিডিয়ার খবর, সড়কপথে গত কয়েক দিনের স্বস্তি এখন দুর্ভোগে পরিণত হয়েছে। কথায় বলে, ‘সব ভালো তার, শেষ ভালো যার।’ মন্ত্রী মহোদয়ের মুখস্থ বুলি না আউড়িয়ে, অতিরঞ্জিত কথা না বলে সর্বশেষ পরিস্থিতিটা জেনে নেয়াই উচিত ছিল।

মিডিয়ার মন যা চায়
মিডিয়া আধুনিক যুগে এতই গুরুত্ববহ যে, এটা ছাড়া মানুষের সমাজ-সভ্যতার কথা কল্পনাও করা যায় না। কানাডার গণযোগাযোগ বিশেষজ্ঞ মার্শাল ম্যাকলুহান বলেছেন, ‘এখন মিডিয়া জনমত কেবল তুলেই ধরে না, গঠনও করে।’ রোজা ও ঈদে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার বৃহদংশের হালচাল দেখে অনেক কিছু বলা দরকার। তবে পরিসর কম। নমুনা হিসেবে কয়েকটি কথা বলতে হয়। প্রথমত, একটি টিভি চ্যানেল রোজার মাসে অন্যদের মতো ইসলামী অনুষ্ঠান এবং ইফতার পূর্বে মোনাজাত সম্প্রচার করে আসছে।

এটা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। কিন্তু একজন আলেম এই মোনাজাত করার প্রাক্কালে এবং এর পরই মাগরিবের আজানের আগ মুহূর্তে নৃত্যরত যুবতীর নূপুরনিক্কন দেখানোকে সংশ্লিষ্ট চ্যানেল কর্তৃপক্ষ কেন জরুরি মনে করছেন? এটা অত্যন্ত দৃষ্টিকটু, হাস্যকর ও সামঞ্জস্যহীন ব্যাপার। অকস্মাৎ এই অযৌক্তিক দৃশ্য প্রচারের সাথে ভেসে ওঠে ‘হৃদয়ে বাংলাদেশ’। পবিত্র মাহে রমজানে ইফতারলগ্নে এবং মোনাজাতের আগে পরে নারীনৃত্যের ছন্দই কি বাংলাদেশের হৃদয়ের প্রতীক? সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা এই জ্ঞান কোত্থেকে কিভাবে পেলেন, এটা দীর্ঘদিন জনমনে প্রশ্ন। দ্বিতীয়ত, জাতীয় কবি নজরুলের একটি বিখ্যাত ও বহুল পরিচিত সঙ্গীত : ‘ও মন, রমজানেরি রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ; তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে রে, শোন আসমানি তাগিদ।’ ঈদ উপলক্ষে বাংলাভাষায় রচিত গানগুলোর মধ্যে এটাকে সর্বশ্রেষ্ঠ মনে করা হয়। এ বছর একাধিক খ্যাতনামা শিল্পীর কণ্ঠে গানটির রেকর্ড বেরিয়েছে। কোনো কোনো টিভি চ্যানেলে এর যে মিউজিক ভিডিও তরুণ-তরুণীদের নাচগানের যৌথ পরিবেশনা হিসেবে সম্প্রচার করা হচ্ছে, তা গানটির আবহ এবং জাতীয় কবির ইমেজসহ জাতির ঐতিহ্য ক্ষুণ্ন করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ‘ও মন রমজানেরি রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’ হাল আমলের পোশাকে ছেলেমেয়ে মিলে নেচে নেচে গেয়ে বেড়ানোর জন্য রচিত হয়নি। তৎকালীন পরিবেশ ও প্রয়োজনের কথা বিস্মৃত হলে আমাদের জাতীয় কৃষ্টির জন্য তা হবে অমর্যাদাকর। তৃতীয়ত, একটা কথা আছে- যার বিয়ে তার খবর নাই; পাড়াপড়শির ধুম নাই।’ পত্রপত্রিকার মোটা ও ভারী, রঙচঙা ও দামি ঈদ সংখ্যাতে ঈদ ও রমজান এবং সংশ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সাধারণত লেখা ছাপা হয় না। রেডিও-টিভির কয়েক দিনব্যাপী ঈদ অনুষ্ঠানমালাতেও গান, নাচ, নাটক, ছায়াছবিসহ আর সবকিছু থাকলেও খোদ ঈদের ধর্মীয় গুরুত্ব, ইতিবৃত্ত ও তাৎপর্য তুলে ধরা হয় না। পত্রিকাগুলো মনে করে, রোজার মাসে নির্ধারিত এক কলামের লেখা কিংবা সম্পাদকীয় পাতার একটা নিবন্ধ অথবা ধর্মীয় পাতার বাইরে এ বিষয়ে লেখালেখি অপ্রয়োজনীয়। আর ইলেকট্রনিক মিডিয়ার যারা মালিক-মোখতার, তারা হয়তো এটা ভেবে বসে আছেন যে, ঈদ হলো আনন্দ-বিনোদনের মজা-মাস্তি করার ব্যাপার। এর মধ্যে বেরসিক ‘মোল্লা’দের ঢোকানো মানে, উৎসবটাকে মাটি করা।

ঈদ মিছিল : ঐতিহ্য ও ক্রিকেট
ঈদ মিছিল ঢাকা শহরের ঐতিহ্য। মোগল আমলের পতনকালে নবাবীর যুগে এখানে ঈদের এই শোভাযাত্রার সূচনা বলে মনে করা হয়। সম্ভবত ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে, নায়েবনাজিমদের বিলুপ্তির সাথে তাল রেখে এ মিছিলও বিদায় নিয়েছিল। তবে বিশ শতকের গোড়ায় আবার চালু হলো বর্ণাঢ্য ঈদ মিছিলের রেওয়াজ। এবার সাধারণ মানুষের ব্যাপক অংশগ্রহণ দেখা গেল জাঁকজমকপূর্ণ মিছিলে। তখন ঢাকার নবাবরা মুসলমানের ঈদ মিছিল এবং হিন্দুর জন্মাষ্টমীর মিছিল, উভয়ের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। সেসব দিনে ঢাকা নগরী প্রধানত আজকের ‘পুরনো ঢাকা’য় ছিল সীমাবদ্ধ। সাধারণত নিমতলী প্রাসাদ বা চকবাজার থেকে বের হয়ে ঈদ মিছিল নিয়ে ইসলামপুর, পাটুয়াটুলি, নবাবপুর, বংশাল, জেলখানার পাশের রাস্তা, হোসেনি দালান প্রভৃতি এলাকা প্রদশিক্ষণ করা হতো।
এটা নিছক আনন্দবিনোদন কিংবা নবাবদের রাজসিকতা দেখানোর মাধ্যম ছিল না। সমসাময়িক নানাবিধ নৈতিক-সামাজিক সমস্যা বা ইস্যু উপস্থাপন করা হতো অভিনয় ও হাস্য-রসিকতার মধ্য দিয়ে। একজন লেখকের ভাষায়, ‘একটি মঞ্চে হয়তো একজন লোককে মদখোর হিসেবে সাজিয়ে জুতার মালা পরিয়ে শাস্তি দেয়া হতো। মঞ্চে লেখা থাকত ‘মদখোরের শাস্তি’। রহমতগঞ্জের তরুণ সম্প্রদায় একবার বখতিয়ার খিলজি ও সপ্তদশ অশ্বারোহীর বঙ্গবিজয়ের চিত্র মিছিলে তুলে ধরেছিল।’ কয়েক বছর আগে থেকে প্রতি ঈদে আবার সে মিছিল বের হচ্ছে আকর্ষণীয়ভাবে। তবে অতীতের মতো সামাজিক অবক্ষয়ের চিত্র কিংবা জাতীয় স্বাতন্ত্র্যের ঐতিহ্য-ইতিহাস তুলে ধরার জন্য অনেক সাহস ও সদিচ্ছা প্রয়োজন। কারণ, বর্তমানে সমাজের ক্ষমতাবান, প্রভাবশালী ধনিক ও অভিজাতদের বিরাট অংশই পানাসক্ত। এদিকে, অবাঙালি ‘বখতিয়ার আসলে বঙ্গবিজয়ী নন’- এমন প্রচারণা শুরু হয়ে গেছে।

পুরান ঢাকার সন্তান ও প্রখ্যাত লেখক-গবেষক প্রফেসর মোহাম্মদ আবদুল কাইউম জানিয়েছেন ঈদ মিছিল, জন্মাষ্টমীর মিছিল এবং মহররমের মিছিল সাম্প্রদায়িক বা ধর্মীয় কারণে আক্রান্ত হওয়ার কথা। তার ভাষায়, ‘বাদ্যসহযোগে মিছিল অথবা হোলিখেলার দিন গায়ে রঙ দেয়া নিয়ে ঢাকায় বহুবার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বেধেছে। ১৯৪৬-এর ঈদের মিছিল নবাবপুর দিয়ে যাওয়ার সময় চারদিক থেকে আক্রান্ত হয় এবং বেশ কিছু লোক হতাহত হয়।’ সম্ভবত ঢাকায় সেবার প্রথম কোনো মিছিলকে কেন্দ্র করে কাঁদানে গ্যাস ছোড়া হয়। অপর দিকে, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির লক্ষ্যে শাঁখারি বাজারের হিন্দু যুবকরা ঈদ মিছিলে একবার শামিল হয়েছিল।

এখন ঈদ উৎসব আর বিশ্বকাপ ক্রিকেটের উন্মাদনা যুগপৎ চলছে। প্রায় দু’দশক আগে বাংলাদেশ এই প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়ার যোগ্যতা অর্জন করে। তখনকার এক ঈদ মিছিলে কয়েকজন ব্যাট-বল-স্টাম্পসমেত ক্রিকেটার সেজেছিলেন। সে কথা এখন আবার মনে পড়ার কথা ক্রিকেটবোদ্ধাদের।

পাদটীকা : মন্ত্রী বলেছেন, ‘এবার ঈদে মানুষ সবচেয়ে আরামে ভ্রমণ করেছে।’ অপর দিকে, দেশের রাস্তাঘাটের যে অবস্থা, তার পরিপ্রেক্ষিতে ঈদের প্রাক্কালে একটি দৈনিকের রম্যপাতায় বলা হয়েছে- একজন লোক বিশাল বোঁচকা নিয়ে ঈদে গ্রামে যাচ্ছে। এর কারণ হিসেবে সে জানায়, ‘সড়ক তো ভাঙাচোরা। এ জন্য ওজনদার গাট্টিবোঁচকা নিয়ে যাওয়াই উচিত।’ তার এমন উল্টো কথা ব্যাখ্যা করে সে বলেছে, রাস্তা ভাঙা হওয়ায় গাড়ি কেবল লাফায়। আমার ধারণা, সাথে ভারী বোঝা নিয়ে উঠলে গাড়ি আর লাফাতে পারবে না।’


আরো সংবাদ



premium cement