২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

দল জোট ও রাজনীতির কিছু প্রসঙ্গ

- ফাইল ছবি

গত সাত দিনের অনেক ঘটনার মধ্যে দু’টি ঘটনাকে আলোচনার জন্য বেছে নিলাম এবং একটি ঘটনা আলোচনা করা গেল না। প্রথম ঘটনা : বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চতুর্থ ত্রিবার্ষিক কাউন্সিল ও তার মাধ্যমে জাতির প্রতি নিবেদন করা বার্তা। দ্বিতীয় ঘটনা : দেশনেত্রী বেগম জিয়ার সুচিকিৎসা ও নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে বিএনপি কর্তৃক আয়োজিত গণ-অনশন ও তার মাধ্যমে বিএনপি নেতাকর্মীদের প্রতি আহ্বান ও জাতির প্রতি আবেদন। তৃতীয় ঘটনা : দীর্ঘ দিন পর ২০ দলীয় জোটের শীর্ষ বৈঠক এবং তার মূল্যায়ন।

কল্যাণ পার্টির কাউন্সিল
রাজনৈতিক দলগুলো কেমন চলছে, দলগুলোর রাজনৈতিক স্বাস্থ্য কেমন, দলগুলো কী রকম কর্মসূচি দিচ্ছে ও পালন করছে, দলগুলোর মধ্যে কোন বিষয়গুলো বেশি আলোচিত হয় ইত্যাদি নিয়েই বিভিন্ন পত্রিকায় রিপোর্টিং হয়; এই কলাম লেখার আগমুহূর্তে একটি পত্রিকায় এ রকমই একটি দীর্ঘ রিপোর্ট পড়লাম। এখন আমাদের দল কল্যাণ পার্টি একটি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল; অতএব নিবন্ধনের শর্ত এবং আরপিও বা রিপ্রেজেন্টেশন অব পিপলস অর্ডার নামক আইনটির বক্তব্য মেনে চলতে হয়। এই প্রেক্ষাপটেই তিন বছর পরপর, ডিসেম্বর মাসে পার্টির কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। গত বছর ডিসেম্বরে যেহেতু নির্বাচনী ডামাডোল ছিল, তাই কাউন্সিল পেছাতে হয়েছিল।

৬ এপ্রিল ২০১৯ কাজটি সুন্দরভাবে সম্পন্ন হয়েছে; শোকর আলহামদুলিল্লাহ। ৬ এপ্রিল অনুষ্ঠিত কল্যাণ পার্টির অনুষ্ঠানেও আলোচনায় তিনটি বিষয় কম-বেশি আলোচিত হয়েছে। আলোচিত একটি বিষয় ছিল কল্যাণ পার্টির সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী হতেই হবে। দ্বিতীয় বিষয় ছিল কল্যাণ পার্টি ২০ দলীয় জোটে অতীতের মতোই শক্তিশালী ভূমিকা রাখতে হবে। আলোচিত তৃতীয় বিষয় ছিল বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম জিয়ার মুক্তির আন্দোলনকে কেন্দ্র করে জোটের অনুভূতি ও কর্মসূচি। বিএনপি মহাসচিব রাজনৈতিক পরিস্থিতির বাস্তবতা তুলে ধরে আহ্বান জানিয়েছেন, কেউ যেন হতাশ না হন। বিএনপি মহাসচিব এবং জনাব নজরুল ইসলাম খান উভয়েই জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও ২০ দলীয় জোটকে যুগপৎ সাথে নিয়ে চলার ওপর গুরুত্ব দেন। বস্তুত স্বস্তিদায়ক চিত্রটি ছিল এ রকম, সভার সভাপতি ও কল্যাণ পার্টির সভাপতি মাঝখানে বসেছিলেন, ঐক্যফ্রন্টের মুখপাত্র ও বিএনপি মহাসচিব মির্জা আলমগীর সভাপতির ডান পাশে বসেছিলেন এবং ২০ দলীয় জোটের সমন্বয়ক নজরুল ইসলাম খান বাম পাশে বসেছিলেন।

যুবদলের সাবেক সভাপতি মোয়াজ্জেম হোসেন আলালের ভাষায়- এই বসার ব্যবস্থাটিতেই ফুটে ওঠে যে, ঐক্যফ্রন্ট ও জোট পরস্পরের সম্পূরক। ৬ এপ্রিলের আলোচনা সভায় জেনারেল ইবরাহিম মন্তব্য করেননি কিন্তু এটাই বাস্তব, ঐক্যফ্রন্ট এবং ২০ দলীয় জোটের পারস্পরিক সম্পর্ক ও উভয়ের সাথে বিএনপির আলাদা আলাদা সম্পর্ক কোন মাত্রায় তা নিয়ে, পত্রিকা পাঠক এবং রাজনীতিমনস্ক ব্যক্তিদের মনে প্রশ্ন বিদ্যমান। সভাপতি, প্রধান অতিথি এবং প্রধান আলোচক তিনজনই বীর মুক্তিযোদ্ধা। অতএব, মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যাশার সাথে আজকের বাস্তবতার মিল-অমিল তারা খুঁজবেন, এটিই স্বাভাবিক। সভাপতির বক্তব্যে জেনারেল ইবরাহিম বাংলাদেশের রাজনীতির অঙ্গনে সাধারণত আলোচনা হয় না এমন বাস্তবতা এবং পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন। তার ভাষায়, প্রয়োজনীয় পরিবর্তন দুই প্রকার। প্রথমটি হলো, গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের পরিবর্তন। দ্বিতীয় প্রকারের পরিবর্তন হলো, রাজনৈতিক দল ও রাজনীতিবিদদের মধ্যে গুণগত পরিবর্তন।

পরিবর্তন চাই : বক্তব্যের সারমর্ম
আমি নিজে রাজনৈতিক কর্মী এবং কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান। এ দল জন্মদিনেই ঘোষণাপত্র ও গঠনতন্ত্র প্রকাশ এবং প্রচার করেছিল; সেগুলো হালনাগাদ অবস্থায় এখনো মুদ্রিত আছে, পার্টির ওয়েবসাইটেও পাওয়া যাবে। আমাদের ঘোষিত লক্ষ্যের সারমর্ম, একটি কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। তবে বর্তমান অবস্থা থেকে পরিবর্তন না আনলে, আমরা কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে পারব না। অতএব, আমাদেরকে পরিবর্তন আনতেই হবে। তাই বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির ঘোষিত নীতিবাক্য হলো ‘পরিবর্তনের জন্য রাজনীতি’। এই পরিবর্তন আনার লক্ষ্যেই রাজনীতিতে নাম লিখিয়েছি। এগারো বছর চার মাস ধরে মহান আল্লাহ কর্তৃক প্রদত্ত জীবনের পরিশীলিত মেধা, কনসেনট্রেটেড অভিজ্ঞতা ও অবসর জীবনের সময়টি রাজনীতির জন্য ব্যয় করছি। নিজের ও দলের নেতাকর্মীদের পরিবার, দলের নেতাকর্মীরা এবং শুভাকাক্সক্ষীরা দোয়া ও সহযোগিতা করছেন। আমরা পরিবর্তনের জোরালো প্রবক্তা।

আমরা একা এই পরিবর্তন করতে পারব না; তাই অন্যদের সাহায্য প্রয়োজন। কিন্তু দূষিত রাজনৈতিক পরিবেশে, পরিবর্তনে আগ্রহী বন্ধু পাওয়া অসম্ভব না হলেও কঠিন। এইরূপ আশা-নিরাশার সন্ধিক্ষণে মহান আল্লাহ তায়ালার একটি বাণী বারবার মনে আসে। পবিত্র কুরআনের ৩৯ নম্বর সূরার নাম সূরা আয-জুমার। এই সূরার ৫৩ নম্বর আয়াতের মাঝখানে বলা আছে : লা তাকনাতু মির রাহমাতিল্লাহি। পুরো আয়াতের অর্থ এরূপ : ‘বলুন, হে আমার বান্দারা যারা নিজেদের ওপর জুলুম করেছ, তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ সমস্ত গোনাহ মাফ করেন। তিনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’

আমি আশাবাদী যে, আমরা বাংলাদেশের মানুষ, যারা মহান আল্লাহ তায়ালা এবং তাঁর নির্দেশাবলিতে বিশ্বাস করি এবং ওই মর্মে চলতে চাই, আমরা আশাবাদী হবো পরিবর্তনের ব্যাপারে। জুলুম বন্ধ হবে, ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হবে, নিষ্ঠুরতা বন্ধ হবে, দয়া প্রতিষ্ঠিত হবে। আমরা নিরাশ হতে চাই না। আমরা মনে করি, অনেক কষ্টের কারণে, অনেক বঞ্চনার কারণে নিশ্চয়ই বাংলাদেশের মানুষ একটি পরিবর্তন চান। তাই সাধারণ মানুষ তথা ভোটারগণকেও পরিশ্রম করতে হবে। সে জন্যই একটি কথায় জোর দিচ্ছি। দুর্নীতি পরিহার করে সুনীতি যদি আনতে চাই, অনৈতিকতা পরিহার করে নৈতিকতা যদি আনতে চাই, পররাষ্ট্রনীতিতে পরনির্ভরশীলতা পরিহার করে যদি আত্মনির্ভরশীলতা আনতে চাই, তাহলে ওই রকম সাহসী পরিবর্তনে আগ্রহী মানুষের সংসদ বা পার্লামেন্ট প্রয়োজন। এ কথায় বিশ্বাস করি বলেই আমরা বিগত সংসদ নির্বাচনে গিয়েছিলাম।

পরিবর্তনের প্রক্রিয়া
পরিবর্তনের জন্য বা পরিবর্তন আনার জন্য যে প্রক্রিয়া অবলম্বন করা যায় বা যেগুলো মানুষের কাছে সুপরিচিত, তা নিয়ে বহুবার আলোচনা করেছি। স্বাভাবিক ও শান্তিপূর্ণ পদ্ধতিতে তথা ব্যালটের মাধ্যমে পরিবর্তন আসুক বা পরিবর্তনের জন্য প্রেক্ষাপট প্রস্তুত হোক বা পরিবর্তনে সহায়তা করবে এমন শক্তি নির্বাচিত হোক, সেই কামনা করি। তার জন্য সংসদের ভেতরে এবং বাইরে যেসব সচেতন রাজনৈতিক দল আছে, তাদের সবার সক্রিয় ভূমিকা প্রয়োজন। একটি উদাহরণ দিই। পার্লামেন্টে যাওয়ার প্রয়োজন এবং আগ্রহের কারণেই নিজে বিগত সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছিলাম, আমার আসন হলো চট্টগ্রাম-৫ (হাটহাজারী উপজেলা পূর্ণাঙ্গ এবং সাথে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ১ নম্বর ও ২ নম্বর ওয়ার্ড)। নির্বাচনের জন্য সাত বছর ধরে (২০১২ সালের এপ্রিল মাসের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে) এলাকায় সময় ব্যয় করেছি, নির্বাচনী এলাকার রাজনৈতিক কর্মীরাও সময়, মেধা ও শ্রম ব্যয় করেছিলেন; কিন্তু সব কিছুর ফলাফল শূন্য।

এর কারণ ক্ষমতাসীনেরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তায় বা তাদেরকে ব্যবহার করে এবং নিজ দলের অতি ক্ষুদ্র একটি অংশকে ব্যবহার করে নির্বাচনটিকে প্রহসনে পরিণত করেছিলেন; ৩০ ডিসেম্বর দিনের বেলার জন্য নির্ধারিত সংসদ নির্বাচনটিকে ২৯ ডিসেম্বর দিবাগত রাতেই প্রায় সমাপ্ত করে ফেলা হয়েছে। এবার সংসদ নির্বাচনটি বহু দলের অংশগ্রহণমূলক ছিল বটে, কিন্তু কোনোমতেই সৎ ও আন্তরিকতাপূর্ণ ছিল না। এটা জাতির জন্য ভয়ঙ্কর। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া প্রয়োজন। এটি রাজনৈতিক অঙ্গনের একটি মারাত্মক অসুস্থতা। এর আশু চিকিৎসা প্রয়োজন; একজন রোগীর চিকিৎসা শুরু করতে দেরি হয়েছে বলেই চিকিৎসা আর শুরু করা যাবে না, এ কথা গ্রহণযোগ্য নয়।

ইংরেজিতে একটি প্রবাদবাক্য আছে- ‘ইট ইজ নেভার টুউ লেইট টু স্টার্ট সামথিং গুড।’ অর্থাৎ কোনো ভালো কাজ শুরু করার জন্য কোনো সময়কে খুব বেশি বিলম্ব বলা যায় না। ভালো কাজটি হলো, বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকারকে রাজনীতির সৎপথে আসতে বাধ্য করা অথবা সরকার পরিবর্তনের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করা; এবং যুগপৎ ভবিষ্যতের ক্ষমতাসীনদের মধ্যে গুণগত পরিবর্তন আনা। ভবিষ্যতের ক্ষমতাসীনদের প্রসঙ্গে এটা বলাই বাহুল্য, তারা নিজেদের অতীত থেকে শিক্ষা নেবেন এবং বর্তমান ক্ষমতাসীনদের ভুলভ্রান্তি থেকে শিক্ষা নেবেন। বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি বা ইবরাহিম সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে, রেখেই যাচ্ছে।

৭ এপ্রিল গণ-অনশন
বিগত বছরের সেপ্টেম্বরের পরে বিএনপির কোনো অনুষ্ঠানে পুনরায় দাওয়াত পেলাম। এই অনুষ্ঠানটির উদ্দেশ্য সার্বজনীন : বিএনপি চেয়ারপারসনের সুচিকিৎসা ও মুক্তির দাবিতে গণ-অনশন। ছয়-সাত-আট-দশ মাস আগে এরূপ গণ-অনশন, মানববন্ধন ইত্যাদিতে নিয়মিত উপস্থিত থাকতাম। ৭ এপ্রিল ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনের বড় মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত গণ-অনশনে কল্যাণ পার্টির পক্ষ থেকে সংহতি বা একাত্মতা প্রকাশ করতে গিয়েছিলাম। অনুষ্ঠানটি ছিল সকাল ১০টা থেকে, কিন্তু অনিবার্য কারণে সকালে যেতে পারিনি; পৌঁছেছিলাম বেলা পৌনে ৩টায়। বিএনপির এবং ঐক্যফ্রন্টের সব বক্তার আগে কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যানকে শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখার জন্য আহ্বান জানানো হয়। অর্থাৎ ২০ দলীয় জোট বক্তব্য রাখার পর বিএনপি এবং ঐক্যফ্রন্ট বক্তব্য রাখে। সেখানে অনুষ্ঠান সমাপ্ত হওয়ার আগে এক ঘণ্টা তিরিশ মিনিট ধরে বিএনপি ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের জ্যেষ্ঠ নেতাদের বক্তব্য শুনেছি।

জ্যেষ্ঠ নেতাদের বক্তব্যের সারমর্ম দশটি পয়েন্টে উল্লেখ করছি। এক. বেগম জিয়াকে মুক্ত করতে হবে; দুই. সরকারের কাছে দাবি জানিয়ে লাভ নেই, কারণ এই সরকার আমাদের দাবি শুনছে না; তিন. এরূপ ঘরোয়া অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বেগম জিয়ার মুক্তি আদায় করা যাবে না; চার. সরকারের দয়াদাক্ষিণ্যের ওপর নির্ভর করে তার মুক্তি কামনা করা যাবে না (প্রসঙ্গ প্যারোল); পাঁচ. রাজপথে আন্দোলন করতে হবে; ছয়. আন্দোলন করতে হলে নেতাকর্মীদের রাজপথে নামতে হবে; সাত. বিএনপির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে লাখ লাখ মামলা আছে। মামলার জন্য কোর্টে হাজিরা দিতে হয় এবং জমায়েত হতেই হয়; অনুরূপ জমায়েত কি অন্যত্র তথা রাজপথে করা যায় না? আট. রাজপথে নামতে হলে নেতাকর্মীদের মামলা-মোকদ্দমা ইত্যাদি মোকাবেলা করে বা উপেক্ষা করে এবং পুলিশের বাধা আসবে, এটা জেনেশুনেই নামতে হবে; নয়. ৭ এপ্রিল দিনব্যাপী গণ-অনশনের কর্মসূচিতে বিএনপির নেতাকর্মীদের অংশগ্রহণ তিন হাজারের বেশি নয়, তাই প্রশ্ন আসে যে, নেতাকর্মীরা কতটুকু আগ্রহ নিয়ে নামবেন; দশ. অতএব নেতাকর্মীদের উৎসাহিত, উদ্দীপ্ত ও সংগঠিত করাও গুরুত্বপূর্ণ।

বক্তব্যের মধ্যে ব্যতিক্রমী পয়েন্ট ছিল দু’টি যথা- এক. আইনি পন্থায় বেগম জিয়াকে মুক্ত করা সম্ভব, কিন্তু সরকার সেটি হতে দিচ্ছে না; দুই. ধৈর্য ধরে সংগঠিত হয়ে আন্দোলন করতে হবে। সেই অনুষ্ঠানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ১৯৪৩ সালের একটি ঘটনা বলেছিলাম। অতঃপর শ্রোতামণ্ডলীর কাছে একটি প্রশ্ন রেখেছিলাম।

১৯৪৩ সালের ঐতিহাসিক ঘটনা : ‘ডু অর ডাই’
উত্তর আফ্রিকা : ভূমধ্যসাগরের দক্ষিণ তীরবর্তী দেশগুলো যথা- মরক্কো, আলজেরিয়া, তিউনিসিয়া, লিবিয়া ও মিসর। সময় ১৯৪০ থেকে ১৯৪২। জার্মানির সর্বাধিনায়ক ও রাষ্ট্রপ্রধানের নাম এডলফ হিটলার। উত্তর আফ্রিকায় নিয়োজিত জার্মান সেনাবাহিনীর অধিনায়কের নাম জেনারেল রোমেল। উত্তর আফ্রিকার পশ্চিম দিক থেকে রোমেল এক-একটি দেশ ও ভূখণ্ড জয় করতে করতে পূর্ব দিকে আগাচ্ছিলেন। অপরপক্ষে, পরাজিত হয়ে হয়ে উত্তর আফ্রিকায় মোতায়েনরত ব্রিটিশ সেনাবাহিনী পেছনে হটতে হটতে মিসরের রাজধানী কায়রোর অতি নিকটে চলে আসে। ব্রিটিশ সরকার তথা প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল প্রমাদ গোনেন। যেকোনো সঙ্কটে নেতৃত্বই প্রধান- এই নীতিবাক্য ব্রিটিশ সরকার স্মরণ করে। ব্রিটিশ সরকার, উত্তর আফ্রিকায় নিয়োজিত ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর প্রধান তথা উত্তর আফ্রিকার জন্য কমান্ডার ইন চিফকে পরিবর্তন করে। লেফটেন্যান্ট জেনারেল উইলিয়াম মন্টগোমারিকে নেতৃত্বে আসীন করা হয়। মন্টগোমারি দায়িত্ব নেয়ার তিন সপ্তাহের মধ্যে প্রথমবারের মতো জ্যেষ্ঠ অফিসার ও জ্যেষ্ঠ সৈনিকদের ময়দানি দরবারে বক্তব্য রাখেন। সংক্ষিপ্ত বক্তব্য।

তিনি উপস্থিত অফিসার ও সৈনিকদের মনে করিয়ে দেন, ‘আগামী যেকোনো যুদ্ধে যদি আপনারা পরাজিত হন, মানে আমরা পরাজিত হই, তাহলে আমাদেরকে ভূমধ্যসাগরে ডুবে মরতে হবে এবং আমরা আমাদের সবচেয়ে সমৃদ্ধ নগরী ও দেশ কায়রো ও ইজিপ্ট হারাব। অতএব, আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে, এই স্থানে আগামী যুদ্ধ যেটি হবে সেটিতে হয় মরব নয়তো আক্রমণকারীদের পরাজিত করব। আমরা সবাই মরব অথবা শত্রুকে পরাজিত করব। আমরা পেছনের দিকে যাওয়ার সব পরিকল্পনা বাতিল করলাম। আপনাদের কমান্ডার হিসেবে আমি হুকুম দিচ্ছি, আপনারাও এখানেই যুদ্ধ করবেন এবং হয় জয়ী হবেন অথবা আমরা এখানে মৃত্যুবরণ করব। আপনাদের সাথে মরতে চাই অথবা আপনাদেরকে সাথে নিয়ে শত্রুদেরকে পরাজিত করতে চাই।

আপনাদের মধ্যে যারা আমার এই আদেশ আনন্দচিত্তে এবং সাহস নিয়ে পালন করতে পারবেন, তারা আমার অধীনে থাকুন; অন্যরা সম্মানের সাথে অন্যান্য যুদ্ধক্ষেত্রে চলে যেতে পারেন; যেতে চাইলে সে ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।’ মন্টগোমারির এই কঠোর কিন্তু উদ্দীপনাময় ভাষণের ফলে তার অধীনস্থ সেনাবাহিনীর প্রত্যেক সদস্যের মনে বিরাট পরিবর্তন এসেছিল। ইতিহাস সাক্ষী দেয়, মন্টগোমারির নেতৃত্বের কারণেই ঠিক পরবর্তী যুদ্ধটিতে আক্রমণকারী রোমেল বাহিনী জয়ী হতে পারেনি; প্রতিরক্ষায় ব্রিটিশ বাহিনী স্থির ছিল এবং সেখান থেকেই ব্রিটিশ বাহিনী রোমেল বাহিনীকে পিছু হটতে বাধ্য করে। পরবর্তী আঠারো মাসের মাথায় পুরো রোমেল বাহিনী উত্তর আফ্রিকা থেকে হটে যেতে বাধ্য হয়। এ কথাগুলোই ৭ এপ্রিল বিকেলে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনের মিটিংয়ে বলেছি। বক্তব্য শেষ করার আগে প্রশ্ন রেখেছি, আমরা তথা বিএনপি তথা ২০ দলীয় জোট তথা জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতাকর্মীরা এরূপ সিদ্ধান্ত কি নিতে পারব যে : অবস্থান নিলাম, সরব না। মারো আর কাটো, আমি বা আমরা কিন্তু সরব না।’

দু’টি না বলা কথা
যে দু’টি গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু ছোট কথা ৭ তারিখ বিকেলে বলিনি সময় বাঁচানোর জন্য, সেগুলো এখন বলছি। আনুষ্ঠানিকভাবে ২০ দলীয় জোটের বয়স সাত বছর শেষ হচ্ছে। এই সাত বছরে অনেক ঘটনার মুহূর্ত গিয়েছে যখন আমি বা আমার মতো কয়েকজনের মতে, উপযুক্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ বিলম্ব হয়েছে। একটি ঘটনা হলো, একদিন পুলিশ অতর্কিতে নয়াপল্টনে অবস্থিত বিএনপির প্রধান কার্যালয়ে হামলা করেছিল- শহীদ জিয়ার ছবির অমর্যাদা করেছিল, খালেদা জিয়ার ছবিকে অপমান করছিল- কম্পিউটার থেকে সব ফাইল নিয়ে গিয়েছিল; এরূপ সময়ে কী প্রতিক্রিয়া হবে সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে অনেক দেরি হয়েছে। দ্বিতীয় ঘটনা হলো, একদিন রাতে অতর্কিতে পুলিশ নয়াপল্টনে বিএনপি প্রধান কার্যালয়ে বাইরে থেকে মই বা সিঁড়ি বেয়ে উঠে দরজা বা জানালা ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে, কয়েকজনকে গ্রেফতার করে, বিভিন্ন দ্রব্য ও কাগজপত্র জব্দ করে; সেই সময়ও প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করতে দেরি হয়েছে।

তৃতীয় উদাহরণ, শাপলা চত্বরে ২০১৩ সালের ৪ মে মিটিং কতক্ষণ চলবে, সেই সিদ্ধান্ত নিতে অনেক বিলম্ব হয়েছে। চতুর্থ উদাহরণ হলো, বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশান অফিসকে যখন সরকার বালুভর্তি ট্রাক দিয়ে অবরুদ্ধ করে ফেলেছিল, তখনো প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করতে বা সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে বিলম্ব হয়েছিল। তখন দেশনেত্রী ও গণতন্ত্রের মা বেগম জিয়া নেতৃত্বে সক্রিয় ছিলেন। অপরপক্ষে আজ তিনি কারাগারে অন্তরীণ। বেগম জিয়া অন্তরীণ হওয়ার কারণে বিএনপির সিদ্ধান্ত গ্রহণপ্রক্রিয়া পরিবর্তিত হয়েছে। অতএব, রাজনীতিরএই ক্রান্তিলগ্নে করণীয় বা কর্মসূচি স্থির করা কোনোমতেই সহজ কাজ নয়। সহজ যে নয়, এটা মেনে নিয়েই বলছি, সময় কারো জন্য অপেক্ষা করে না। ৭ এপ্রিল বিকেলে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে অনুষ্ঠান চলাকালে ২০ দলীয় জোটের সমন্বয়ক ও বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খানের পাশে বসেছিলাম।

সেখানে মৌখিকভাবে জানতে পারি এবং পরবর্তীকালে বিএনপি গুলশান কার্যালয়ের সম্মানিত দায়িত্বপ্রাপ্তদের কাছ থেকে জেনেছি, ৮ এপ্রিল সন্ধ্যায় বিএনপির গুলশান কার্যালয়ে ২০ দলীয় জোটের সভা অনুষ্ঠিত হবে। ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের আগে দেড়-দুই মাস জোটের মিটিং হয়নি। ৩১ ডিসেম্বর তারিখে জরুরি ভিত্তিতে আহূত জোটের মিটিংয়ে বেশির ভাগ গুরুত্বপূর্ণ দলগুলোর শীর্ষ নেতারা আসতে পারেননি। তাই তিন মাস ছয় দিন পর পুনরায় জোটের মিটিং গুরুত্বপূর্ণ মনে করলাম। ১৭ এপ্রিল তারিখের কলামে ইনশা আল্লাহ জোটের ব্যাপারে আরো দু-একটি কথা বলব এবং বর্তমান বাস্তবতার নিরিখে ১৭ এপ্রিল ১৯৭১ সালের স্মৃতি রোমন্থন করব।

লেখক : মেজর জেনারেল (অব:); চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি
ই-মেইল : mgsmibrahim@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement