২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

কূটনীতিতে স্বামী-স্ত্রী তত্ত্ব

-

পৃথিবীর প্রাচীনতম প্রতিষ্ঠান পরিবার। সংগঠন হিসেবে এটিই এখনো সবচেয়ে টেকসই ও শক্তিশালী। ঐশী জ্ঞানের আলোকে, ভূপৃষ্ঠে প্রথম পরিবারের গোড়াপত্তন করেছিলেন আদম আ: ও তাঁর স্ত্রী হাওয়া। তাঁরাই পৃথিবীর প্রথম মানব-মানবী। সেই থেকে দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে বৈচিত্র্যময় সব মানবধারা। আজো তা বহমান। আল্লাহ যত দিন চাইবেন, তত দিন এ ধারা টিকে থাকবে। বিশ্বাসের এমন বেলাভূমিতে দাঁড়ানো বিশ্বাসী মন। আদি পিতা-মাতার সম্পর্ক ছিল শান্তিময়। ছিলেন দু’জন দু’জনার। তাঁরাই পারিবারিক জীবনে আমাদের ‘আইকন’।

বিবাহবন্ধনে গড়ে ওঠে পরিবার। বৈবাহিক সম্পর্ক একটি আইনি বন্ধন। দু’জন মানব-মানবী একাত্ম হয়ে হন অঙ্গীকারবদ্ধ। এটি রচিত হয় আল্লাহপ্রদত্ত সীমারেখায়। এমন একটি পবিত্র বন্ধন পড়ে গেছে কূটনৈতিক গ্যাঁড়াকলে! স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কটি কূটনৈতিকপাড়ায় ঢুকে পড়েছে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি। কলকাতা থেকে প্রকাশিত ‘আজকাল’ পত্রিকায় দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ককে আমাদের নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এম এ মোমেন তুলনা করেছেন স্বামী-স্ত্রীর অম্ল-মধুর সম্পর্কের সাথে। তিনি বলেছেন, উভয় দেশের সম্পর্ক খুবই ভালো। অনেকটা স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের মতো। টুকটাক মতানৈক্য থাকলেও মিটে যায়। তিস্তার পানি বণ্টন বিষয়ে তার ভাষ্য- ‘এটি সামান্য বিষয়। উভয় দেশই বিষয়টি মিটিয়ে নিতে সক্ষম।’

আন্তঃদেশীয় বিষয়ের ক্ষেত্রে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক উপমা হওয়ায় সত্যিই সবার নজর কেড়েছে। সৃষ্টি হয়েছে কৌতূহল। বাড়তি আগ্রহের কারণ হয়েছে। উদাহরণটি নজিরবিহীন ও অভূতপূর্ব।

কোনো কিছুতে ব্যতিক্রম দেখলেই চার দিকে হইচই পড়ে যায়। সবাই যেন হুমড়ি খেয়ে পড়ে। সে বিষয়ের পেছনে লাগা ‘নেটিজান’দের মজ্জাগত অভ্যাস, যা দুর্বলতা। বদ অভ্যাস। তাদের মাতামাতি দৃষ্টিকটু। অথচ কে না জানে, দুনিয়ার তাবৎ মহৎ কবিতায় উপমার ছড়াছড়ি, যা আসলে পাঠকের কাছে হয় হৃদয়গ্রাহী। চিত্তাকর্ষক। কবিতায় যুতসই উপমা ব্যবহার শিল্পোত্তীর্ণ হলে সাহিত্য বোদ্ধাদের কাছে হয় আদৃত। যে কবিতায় উপমার প্রয়োগে কবি মুন্সিয়ানার পরিচয় দেন, সেই কবিতা হয়েছে তত আলোচিত। পেয়েছে পাঠকপ্রিয়তা। আর কবি নিজে সবার কাছে হয়ে উঠেছেন গ্রহণীয়। যেমন- আমরা বাংলাভাষীরা; সমকালীন বাংলা কবিতায় সম্প্রতি পরকালের অধিবাসী আল মাহমুদকে অন্যতম প্রধান কবি হিসেবে মেনে নিয়েছি। তিনি হয়ে উঠেছেন সবার কাছে গ্রহণীয়। তার কবিতা সমীহ করার মতো।

এ দিক দিয়ে দেখলে আমাদের নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কর্তৃক স্বামী-স্ত্রীর উপমার ব্যবহার কূটনৈতিক ভাষায় এনেছে ভিন্নমাত্রা। অন্য ব্যঞ্জনা। এমন ভাষারীতি সবার নজর কেড়েছে। কূটনৈতিক ভাষা হয়েছে পরিপুষ্ট। বলা অত্যুক্তি হবে না, আমাদের নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীর্ঘ দিন ছিলেন পরবাসী। ছিলেন জাতিসঙ্ঘে দেশের স্থায়ী প্রতিনিধি। হয়তো এতে করে তার শব্দভাণ্ডার সমৃদ্ধ হয়েছে।

বলছিলাম, কূটনৈতিক বিষয়ে স্বামী-স্ত্রীর উপমা নিয়ে নাক সিঁটকানোর কিছু নেই। কারো যদি এ নিয়ে আপত্তি থাকে, তারা ভিন্ন আঙ্গিকে ভাবলে বিষয়টি আর খারাপ লাগবে না। দীর্ঘ দিন বিদেশে থাকলে যে কেউ মাতৃভাষায় একটু-আধটু ভুল করতে পারেন। এটি স্বাভাবিক। বিদেশ-বিভুঁইয়ে সব সময় তো মাতৃভাষায় কথা বলার সুযোগ থাকে না। মায়ের বুলি লুকিয়ে থাকে মনের গহিনে। ব্যবহারিক জীবনে থাকে আড়ালে। সেখানে নিতে হয় পরভাষার আশ্রয়। আর কূটনীতিকেরা দেশের স্বার্থে স্বজনবিনে কাটান পরবাসী জীবন। এরপরও অনেকে মুখটিপে হাসছেন আর বলছেন- তাই বলে কূটনীতিতে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের কথা ভাবা যায়! তাদের ভাষায়, প্রতিবেশীর সাথে সম্পর্ক হতে হয় দোস্ত-দুশমনের। অনুকূল পরিবেশে জানি দোস্ত। বৈরী হলে শত্রু।

মুশকিল হলো- স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক আগের মতো মজবুত নেই। হয়ে পড়েছে নড়বড়ে। উদাহরণ চাইলে দেয়া যায় ভূরি ভূরি। পৃথিবী পাড়ি দিয়েছে প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে পাথর ও ব্রোঞ্জ যুগ, হিমযুগ, প্রস্তর, তাম্র, লৌহযুগসহ আরো কত যুগ। উত্তরাধুনিককালে এসেছে প্রযুক্তি আর রোবট যুগ। হাইটেক অনুপ্রবেশ করেছে হাই-হ্যালো আর সেলফোনের যুগে। এসব বিবিধ যুগ শেষে মানবজাতি এখন খেলনা যুগের বেলাভূমিতে। এ যুগের বৈশিষ্ট্য- সব কিছু ক্ষণস্থায়ী, ভঙ্গুর আর ঠুনকো। খেলনা যুগে সব কিছু একবারই ব্যবহারযোগ্য। প্রেমিক বা প্রেমিকা হয় ওয়ানটাইম। এক রকম টিস্যুপেপার আর কি। বলপেন ফুরিয়ে গেলেই শেষ। এখন প্রেমিক ভালোবেসে করে প্রেমিকার সর্বনাশ। ছলনায় ভুলিয়ে প্রেমিকা করে প্রেমিককে ফতুর। যুগ আছর ফেলেছে কবিতায়ও। এতে কবিতায় এসেছে বাকবদল, ‘তোমার ওপর ছিল আমার আস্থা, এখন দেখি তুমি খুব সস্তা।’ এমন পঙ্ক্তি। খেলনা যুগে অনেকের দাম্পত্য সম্পর্কও হয়ে পড়ছে সংক্ষিপ্ত। দু-একটি উদাহরণ দিই।

জর্ডানের রাজধানী আম্মান। আদনান আর জামিলা। আলাদা রুমে ভিন্ননামে মনের আনন্দে পরস্পর চ্যাট করে চুটিয়ে। চ্যাটে জামিলা অবিবাহিতা। তিন মাসের চ্যাটেই হয়ে যায় একে অন্যের পরানের পরান। মহব্বত এমন পর্যায়ে পৌঁছে যায় যে, দু’টি হৃদয় দেখে ঘর বাঁধার স্বপ্ন। প্রথম দেখার আগে উভয় হৃদয়ে বইতে থাকে মৃদুমন্দ হাওয়া। অপেক্ষার প্রহর গুনতে থাকে আদনান। দর্শন দেয় কাক্সিক্ষত জামিলা। কিন্তু একি! এ তো তার স্ত্রী সানা। জামিলা পরিচয়ের সানা দেখে, সামনে দাঁড়িয়ে সাক্ষাৎ তার স্বামী আদনান নামের বকর। দু’জনেই লজ্জায় রাঙা হয়ে ওঠে। লজ্জাবতী লতার মতো দু’টি হৃদয় যায় তাৎক্ষণিক গুটিয়ে। ধাক্কা সামলে ক্রুদ্ধ বকর তৎক্ষণাৎ সিংহের মতো ওঠে গর্জে। স্ত্রীকে দেয় তালাক। ভেঙে যায় সুখের সংসার।

আরেকটি ঘটনা। বিয়ের ৯০ মিনিটের মাথায় বুঝে যায় তাদের জন্ম একে অপরের জন্য নয়। ট্যাবলয়েড পত্রিকা ‘দ্য সানের’ প্রতিবেদনে বলা হয়, বিয়ের এক ঘণ্টা যেতে না যেতেই লন্ডনের একটি পানশালায় কলহের সূত্রপাত। অতিরিক্ত মদপানে মাতাল বর নববধূর বান্ধবীদের সাথে করছিল মাতলামি। এই বেহায়াপনা সইতে পারেনি নববধূ। ক্ষিপ্ত হয়ে স্বামীর মাথায় আঘাত করলে বর টেবিলে লাফিয়ে উঠে হাতের কাছে যা পাচ্ছিল, তা-ই ছুড়ে মারছিল। অবশেষে পুলিশ এসে বরকে সোজা নিয়ে যায় শ্রীঘরে। আদালত ৯০ ঘণ্টা গৃহবন্দী থাকার আদেশ দেন। বিচ্ছেদেই নববধূ খুঁজে পেল শান্তি।

ঘটনাস্থল ভারতের বিজনৌর কারোন্ডা পাচদু গ্রাম। বরযাত্রীসহ ইমরান বিয়ে করতে কনের বাড়িতে আসার কিছুক্ষণ পরই গণ্ডগোলের সূত্রপাত। মেয়েপক্ষের অভিযোগ, বিয়েবাড়ির আলমারি থেকে দেড় লাখ টাকা আর গয়না খোয়া গেছে। সন্দেহের তীর গিয়ে পড়ে বরের দুই আত্মীয়ের দিকে। এ নিয়ে দু’পক্ষের বিবাদ। পরিস্থিতি এমন হয়, সারা রাত বরসহ বরযাত্রীদের আটকে রাখা হয়। সকালে পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। রাতভর আটক থাকার পর মুক্তি পেয়ে ইমরান ঘণ্টা কয়েক আগে বিয়ে করা স্ত্রীকে তালাক দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।

প্যারাগুয়েতে এক ব্যক্তির স্ত্রীর সাথে সম্পর্ক ছিন্নে দায়ী হতচ্ছাড়া গুগল ম্যাপ। গুগল ম্যাপে ট্রাফিক আপডেট দেখতে গিয়ে চোখ ছানাবড়া হয়ে ওঠে স্বামীর। দেখে, পথেই স্ত্রীর কোলে মাথা রেখে সুখ সাগরে ভাসছে বেগানা এক যুবক। এতে দু’জনার দু’টি পথ দু’দিকে যায় বেঁকে।

সংযুক্ত আরব আমিরাতে নতুন বিয়ে করা ব্যক্তি প্রসাধন ছাড়া প্রথম বধূয়ার মুখ দেখে হয়ে পড়ে বিমূঢ়। মেকআপবিহীন স্ত্রীর চেহারা মোবারক প্রথমে চিনতেই পারেনি গোবেচারা স্বামী। শারজার আল মানজার সৈকতে জলকেলির সময় প্রসাধন ধুয়ে মুছে ছাফ হয়ে যায়। বেচারির আসল চেহারা যায় বেরিয়ে। স্ত্রীর সুরত দেখে হতভম্ব স্বামী। প্রতারণার অভিযোগে দেয় বাইন তালাক। সাগরের উদারতাও টেকাতে পারেনি বন্ধন। তাই বলছিলাম, এমন একটি সম্পর্কের বিষয় কূটনীতিতে টেনে আনায় অনেকে হয়েছেন সমালোচনামুখর।

অন্য দিকে, তিস্তার পানি তেমন কোনো সমস্যা নয় বলে উল্লেখ করায় দেশের প্রেমিক-প্রেমিকারা হয়েছে বেজায় খুশি। গত শতাব্দীর সত্তরের দশকে ভারত বাংলাদেশের উজানে গঙ্গায় ফারাক্কা বাঁধ দেয়ায় পদ্মায় পানিপ্রবাহ কমে নদীতে পড়ে যায় ধু-ধু বালুচর। এতে প্রেমিক-প্রেমিকারা মহাসুখে তাদের সাধের ঘর বাঁধেন গহিন বালুচরে। ওই সময় আমাদের দেশের লোকসংখ্যা ছিল এখনকার অর্ধেক। প্রেমিক-প্রেমিকার সংখ্যা এত দিনে গেছে বহুগুণে বেড়ে। ফলে তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা দ্রুত পেলে বালুচর সঙ্কটে প্রেমিক-প্রেমিকার ঘর বাঁধার স্বপ্নসাধ যাবে ভেসে। তরুণ হৃদয় ভাঙার এমন শঙ্কা থেকে আপাতত পাওয়া গেল রক্ষা।

মুজিব পরদেশীর জনপ্রিয় গান- ‘আশা ছিল মনে মনে/ ঘর বাঁধিব তোমার সনে/ গহিন বালুচরে।’ তাই উজানে বাঁধের কারণে ভাটির দেশের নদ-নদী পানিশূন্য হলেও প্রেমিক-প্রেমিকার ঘর বাঁধায় যাতে কোনো বাধার সৃষ্টি না হয়, এটি প্রতিবেশী দেশ খেয়াল রাখছে ভেবে মন পুলকিত হয়ে ওঠে। এটিই বা কম কী!

এ ছাড়া, নদীতে পানি কম থাকলে রবীন্দ্রনাথের বহুলপঠিত কবিতার চিত্রকল্প মনে ভেসে উঠবে আমাদের মানসপটে। কবিতাটি শিশুমনে দেয় দোলা- ‘আমাদের ছোট নদী/ চলে বাঁকে বাঁকে/ বৈশাখ মাসে তার হাঁটুজল থাকে/ পার হয়ে যায় গরু, পার হয় গাড়ি/ দুই ধার উঁচু তার, ঢালু তার পাড়ি।’ এতে সবার মন ভরে ওঠে নস্টালজিয়া সুখে। তাই পানি না পেলেও আর কোনো আক্ষেপ থাকবে না মনে। হ
camirhamza@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement
‘এখন আমি কী নিয়ে বাঁচব’ যদি বন্ধু হও, সীমান্তে অহরহ গুলি কেন : ভারতকে ফারুক সাহারা মরুভূমির গরমের মতো অনুভূত হচ্ছে : সরকারকে দায়ী করে রিজভী মধুখালীর পঞ্চপল্লীতে ২ ভাইকে হত্যার প্রতিবাদে সমাবেশ শ্রীলঙ্কাভিত্তিক এয়ারলাইন্স ফিটসএয়ারের ঢাকা-কলম্বো সরাসরি ফ্লাইট চালু রোহিঙ্গা ইস্যুতে একসাথে কাজ করবে ঢাকা-ব্যাংকক : পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসরাইলি হামলায় আহত শিশুর মুখে ২০০ সেলাই বিষখালীতে মৎস্য বিভাগের অভিযান : জেলে নিখোঁজ, আহত ২ দক্ষিণ এশিয়ার যে শহরগুলোর তাপমাত্রা এখন সর্বোচ্চ গাজীপুরে দাঁড়িয়ে থাকা কাভার্ডভ্যানে অটোরিকশার ধাক্কায় হতাহত ৫ চৌগাছায় সিদ কেটে স্বর্ণের দোকানে চুরি

সকল