২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

আত-তাওহিদ : চিন্তাক্ষেত্রে ও জীবনে এর অর্থ ও তাৎপর্য

-

ইসমাঈল রাজী আল ফারুকীর বই ‘আত তাওহীদ : চিন্তাক্ষেত্রে ও জীবনে এর অর্থ ও তাৎপর্য’ ইংরেজি ও বাংলায় বারবার পড়লাম। কয়েক জায়গায় বইটি নিয়ে আলোচনাও করেছি। এ গ্রন্থখানি বাংলায় বেশি প্রচারিত হয়নি। অথচ এর লাখ লাখ কপি ছড়ানো দরকার ছিল। বইটি প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইসলামিক থ্যট (বিআইআইটি)। বাড়ি ৪, রাস্তা ২, সেক্টর ৯, উত্তরা, ঢাকা-১২৩০। ফোন : ০২-৫৮৯৫৪২৫৬, ০২-৫৮৯৫৭৫০৯। তাওহিদভিত্তিক জীবন কেমন, তার রূপরেখা কী- এর ওপর এর চেয়ে উন্নতমানের বই কোনো ভাষায় নেই বলেই মনে হয়। এর লেখক গত ১০০ বছরের ইসলামী চিন্তাবিদ ও দার্শনিকদের প্রথম ১০ জনের মধ্যে একজন বলেই আমরা মনে করি।

এ বইয়ের সারমর্ম জনগণের সামনে উপস্থাপন করছি। লেখক প্রথম অধ্যায়ে বলেছেন, ফরাসি বিপ্লবের পর একদল দার্শনিক বলে থাকেন, জগৎ সৃষ্টির পর স্রষ্টা কতগুলো প্রাকৃতিক আইন দিয়ে দিয়েছেন, বিশ্ব ও আকাশমণ্ডল এর ভিত্তিতেই চলছে, এখন স্রষ্টার কোনো কাজ নেই, তাকে অলস বা কর্মহীন বলা যায়। লেখক আল ফারুকী এমন ধারণা প্রত্যাখ্যান করে বলেছেন, স্রষ্টা সব সময়ই তার কাজ করছেন, নিজে অথবা অন্য কারো মাধ্যমে।

দ্বিতীয় অধ্যায়ে ইসমাঈল রাজী আল ফারুকী বলেছেন, তাওহিদ হচ্ছে ইসলামের সার বা নির্যাস। তাওহিদের অর্থ হচ্ছে- স্রষ্টা মাত্র একজন, অন্য সব কিছু তারই সৃষ্টি। আল্লাহর পুত্রের ধারণা এবং দেবদেবীর ক্ষমতার ধারণা ইসলাম প্রত্যাখ্যান করেছে। তৃতীয় অধ্যায়ে ইতিহাসের মৌলনীতি আলোচনা করতে গিয়ে তিনি বলেছেন, ইসলাম মানুষকে দিয়েছে কর্মবাদ এবং আল্লাহ মানুষকে দিয়েছেন সব ধরনের যোগ্যতা। সুতরাং মানুষকে কর্মের মাধ্যমে সভ্যতা সৃষ্টি করতে হবে; ইতিহাস সৃষ্টি করতে হবে- এটাই আল্লাহর অভিপ্রায়। রাসূল সা: এবং সাহাবিরা এটাই করেছিলেন। আল্লাহ রাসূল সা:কে হুকুম দিয়েছেন যেন কর্মের মাধ্যমে তিনি মানুষকে এবং ইতিহাসকে নতুন রূপ দেন।

চতুর্থ অধ্যায়ে লেখক জ্ঞানের মূল সূত্র তুলে ধরেছেন। ঈমান শব্দটি আলিফ মিম নুন থেকে এসেছে। এর অর্থ সাধারণ বিশ্বাস নয়, সুদৃঢ় বিশ্বাস বা Conviction। ইসলামের বিশ্বাসের সাথে সত্যিকার অর্থে যুক্তির কোনো বিরোধ নেই। বিরোধ আছে মনে হলে বারবার বুঝতে চেষ্টা করতে হবে, আমি কি ওহি সঠিকভাবে বুঝেছি কিংবা যাকে যুক্তি বলছি, তা কি সত্যিই যুক্তিসঙ্গত? তাহলে এসব আপাত বিরোধ আর থাকবে না।

পঞ্চম অধ্যায়ে লেখক বলছেন, কোনো কোনো ধর্ম সৃষ্টিকে ‘দুর্ঘটনা’ মনে করে থাকে। তারা মনে করেন, জগৎ থেকে পরিত্রাণ পাওয়াই মানবজাতির আসল লক্ষ্য হতে হবে। ইসলামে প্রকৃতি হচ্ছে সৃষ্টি, কিন্তু উদ্দেশ্যময়। সব কিছুর উদ্দেশ্য আছে। আল্লাহ তায়ালা প্রাকৃতিক আইন দিয়েছেন। এসব আইনের ফলে যা ঘটে, তা একইভাবে ঘটে থাকে; ভিন্ন ভিন্নভাবে নয়। ফলে বিজ্ঞানীরা সৃষ্টির পেছনে যেসব নিয়ম আছে, তা বের করতে পেরেছেন। ইসলাম বিজ্ঞানের শত্রু নয়, বরং আল্লাহ প্রাকৃতিক আইন দিয়েছেন বলেই বিজ্ঞান সৃষ্টি হয়েছে। Allah is the condition of science.
.
ষষ্ঠ অধ্যায়ে আল ফারুকী নৈতিকতার ভিত্তি ও মূলনীতি আলোচনা করেছেন- যা প্রাকৃতিক আইনে হয়, তাতে নৈতিকতার কোনো প্রশ্ন ওঠে না। যেখানে মানবিক স্বাধীনতা রয়েছে, সেসব ক্ষেত্রে কাজের মাধ্যমেই মানুষের নৈতিকতা বিবেচিত হয়। মানুষ জন্মগত পাপী নয়, যেমন কোনো কোনো ধর্ম বলেছে। ইসলাম বিশ্বজনীন; এখানে গোত্রবাদ কিংবা দেশপূজা নেই।

সপ্তম অধ্যায়ে তিনি সমাজব্যবস্থার মূলনীতি দিয়েছেন। ইসমাঈল রাজী আল ফারুকী বলেছেন, সমাজব্যবস্থা হচ্ছে ইসলামের হৃৎপিণ্ড। সমাজের মাধ্যমেই কার্যকর হয় আল্লাহর অভিপ্রায়। ইসলামী সমাজ ইহুদি ধর্মের মতো গোত্রীয় (tribal) নয়। সেকুলারিজম সমাজকে নীতিবোধ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। সেকুলারিজমের কোনো মূল্যবোধ নেই। এর একমাত্র লক্ষ্য হচ্ছে ধর্ম থেকে দূরে থাকা, এই negative মূল্যবোধ। তিনি বলেন, আল্লাহর অভিপ্রায় হচ্ছে সমাজমুখী বা সমাজকেন্দ্রিক। ইসলাম প্রত্যেক ব্যক্তিকে দায়িত্বশীল বা মুকাল্লিফ হতে বলেছে।

অষ্টম অধ্যায়ে তিনি মুসলিম উম্মাহ বা মুসলিম বিশ্বসমাজের মূলনীতি উল্লেখ করছেন। উম্মাহ আধুনিক অর্থে কোনো গ্রুপ নয় বা গোষ্ঠী নয়; উম্মাহ বিশ্বজনীন। মুসলিম উম্মাহ একটি শরীরের মতো, তার এক অঙ্গে ব্যথা লাগলে অন্য স্থানেও ব্যথা লাগে। উম্মাহর সম্ভাবনা অনেক। এটি গতিশীল ছিল। কিন্তু মুসলিম শাসক ও ফিকাহবিদেরা এটাকে স্থবির করে ফেলেছেন।

নবম অধ্যায়ে আল ফারুকী ইসলামের পরিবারব্যবস্থার মূলনীতি নিয়ে আলোচনা করছেন। কমিউনিস্টরা পরিবারব্যবস্থা তুলে দিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু পারেননি। পাশ্চাত্যেও নানা কারণে পরিবার দুর্বল হয়ে গেছে, এটা এখন না থাকার মতো। নৃতত্ত্ববিদেরা (anthropologists) তাদের ভুল তত্ত্ব দিয়ে মানব পরিবারকে দুর্বল করে ফেলেছেন। তারা মানুষকেও অন্য পশুদের মতো একটা পশুমাত্র মনে করেন। সুতরাং পশুর যেমন পরিবারের দরকার নেই, তেমনি মানুষেরও পরিবার দরকার নেই বলে তারা মনে করেন। ইসলামে পরিবার একক হতে পারে (পিতা-মাতা এবং সন্তানেরা) এবং extendedও হতে পারে, যে পরিবারে দাদা-দাদীসহ কয়েকজন আত্মীয় থাকতে পারেন। নারী ও পুরুষকে আল্লাহ ধর্মীয়, নৈতিক ও নাগরিক অধিকার ও দায়িত্বের ক্ষেত্রে সমান করে সৃষ্টি করেছেন। এ ব্যাপারে লেখক কুরআনের ৩:১৯৫, ৯:৭১-৭২, ১৬:৯৭, ৬০:১২, ৫:৩৮, ২৪:২ এবং ৪:১২ আয়াতে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, ৪:৩৪ আয়াতে নারীকে কোনোভাবে ছোট করা হয়নি। তিনি নারী-পুরুষের মধ্যে কিছু ক্ষেত্রে ভিন্নতার উল্লেখ করেছেন। যেমন- নারীর ক্ষেত্রে মাতৃত্ব, গর্ভধারণ এবং সন্তান লালন-পালন গুরুত্বপূর্ণ। আবার পুরুষের ক্ষেত্রে পিতৃত্ব, ভরণপোষণের দায়িত্ব, রোজগার করা গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেছেন, যদিও বেশির ভাগ নারী মাতৃত্বের কঠিন দায়িত্ব এবং গৃহকর্মে ব্যস্ত থাকেন, তা সত্ত্বেও নারীর জন্য শিক্ষা লাভ এবং বাইরে কাজের সব সুযোগ থাকতে হবে। মধ্যবয়সের পর নারীদের মাতৃত্বের দায়িত্ব কমে যায়। সে ক্ষেত্রেও যাতে তারা বাইরে কাজ পেতে পারেন, সমাজকর্মে নিয়োজিত হতে পারেন তার ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন।

দশম অধ্যায়ে তিনি রাজনৈতিক ব্যবস্থার মূলনীতি আলোচনা করেছেন। তিনি বলেছেন, উম্মাহর এক বা একাধিক রাষ্ট্র থাকতে হবে। ইসলামের খিলাফত বা রাষ্ট্রব্যবস্থার মূলনীতি হচ্ছে- জনগণের বাছাই করা বা নির্বাচিত শাসক থাকা, পরামর্শভিত্তিক শাসন (সেজন্য বর্তমান যুগে পার্লামেন্ট থাকা) এবং রাষ্ট্রের মূল আইন ইসলামভিত্তিক হওয়া। বিচারব্যবস্থা স্বাধীন হওয়া এবং সব নাগরিকের নাগরিক অধিকার থাকা। মুসলিম সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে সবার বৈষয়িক ও শিক্ষাগত প্রয়োজন পূরণ করা।

একাদশ অধ্যায়ে এই লেখক অর্থব্যবস্থার মূলনীতি নিয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি বলেছেন, ইসলামে এই জীবন ও পরজীবনের সমান অগ্রাধিকার রয়েছে। ইসলাম কর্মবাদে বিশ্বাস করে। এখানে সন্ত্রাসবাদ নেই। কোনো গোষ্ঠীর নয়, সবার কল্যাণ করাই ইসলামী অর্থব্যবস্থার লক্ষ্য। এ ব্যবস্থায় কাউকে শোষণ করা হবে না; কিছু দেশ কর্তৃক অন্য সব দেশকে নানা কায়দায় বঞ্চিত করা যাবে না। হজরত উমর রা: তার অধীন সব দেশের অভ্যন্তরীণ মালামাল চলাচলের ওপর শুল্ক তুলে দিয়েছিলেন। ফলে মুসলিম বিশ্ব একটি সাধারণ বাজারে (পড়সসড়হ সধৎশবঃ) পরিণত হয়েছিল। উৎপাদনের নীতি হচ্ছে ক্ষতিকর কিছু তৈরি করা যাবে না; কেবল মুনাফার জন্য উৎপাদন নয়, তা জনহিতকরও হতে হবে। ভোগের ক্ষেত্রে নীতি হচ্ছে, অপচয় না করা এবং একচেটিয়া বাণিজ্য ও মজুদদারিমুক্ত হওয়া, সেই সাথে জাকাত দেয়া।

দ্বাদশ অধ্যায়ে তিনি আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার মূলনীতি কী হবে, তা ইসলামের আলোকে উল্লেখ করেছেন। হিজরতের পর রাসূল সা: ‘মদিনার সনদ’ ঘোষণা করেছিলেন, যা ছিল বিশ্বের প্রথম এবং সবচেয়ে নৈতিক সংবিধান। সেই সনদে সব জাতিগোষ্ঠীর সমান অধিকার দেয়া হয়েছে। রাসূল সা: গোত্রীয় পরিচয় তুলে দেন এবং সব মুসলিমকে এক উম্মাহর অংশ বলে ঘোষণা করেন। ইহুদিদেরকে অন্য একটি উম্মাহ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। পরে রাসূল সা: নাজরানের খ্রিষ্টানদের এক উম্মাহ ঘোষণা করেন। পরবর্তী শাসকেরা হিন্দু ও বৌদ্ধদেরও আলাদা আলাদা ‘উম্মাহ’ হিসেবে বিবেচনা করেছেন।

ত্রয়োদশ অধ্যায়ে লেখক ইসলামী আর্ট ও চিত্রশিল্পের মূলনীতি তুলে ধরেন। তিনি সঙ্গীত ও বাদ্য নিয়ে এ অধ্যায়ে আলোচনা করেননি। এ বিষয়টি ড. ইউসুফ কারজাবির ‘হালাল ও হারাম’ গ্রন্থে দেখা যেতে পারে। পাশ্চাত্য গ্রিকদের অনুকরণে প্রতিমা তৈরি ও অঙ্কনকেই প্রধান শিল্প মনে করা হয়। কিন্তু ইসলাম কোনো ধরনের প্রতিমাকে গ্রহণ করেনি। ইসলামী শিল্পীরা লতাপাতা ও জ্যামিতির বিভিন্ন রেখা ও ফর্মের পুনরাবৃত্তির মাধ্যমে চিত্রশিল্প তৈরি করেছেন যা বিভিন্ন স্থাপত্যে, মসজিদে, দেয়ালে, গ্রন্থের প্রচ্ছদ ইত্যাদিতে দেখা যায়। একে স্টাইলাইজেশন বা অ্যারাবেক্স বলা হয়। এ ছাড়া, মুসলিম শিল্পীরা কুরআনের সুন্দর তিলাওয়াতকে শিল্প মানে উত্তীর্ণ করেছেন। আরবি লেখাকে সুন্দর করে Calligraphy তৈরি করা হয়।
পরিশেষে বলা যায়, ওপরের সারসংক্ষেপ তাদের সাহায্য করবে, যারা এ মহৎ গ্রন্থটি পড়ার সুযোগ পাননি।
লেখক : সাবেক সচিব, বাংলাদেশ সরকার


আরো সংবাদ



premium cement
দেশের উন্নয়নে পাকিস্তান প্রশংসা করে, অথচ বিরোধী দল দেখে না : কাদের আশুলিয়ায় বাঁশবাগান থেকে নারী পোশাক শ্রমিকের রক্তাক্ত লাশ উদ্ধার মিয়ানমারের কর্মকর্তারা ফেরত গেলেন, কিন্তু রোহিঙ্গা সঙ্কট কি আরো জটিল হচ্ছে দিনাজপুরে দুই ট্রাকের সংঘর্ষ, চালক-হেলপার নিহত মানিকগঞ্জে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ২ সখীপুরে বৃষ্টির জন্য অঝোরে কাঁদলেন মুসল্লিরা দক্ষিণ ভারতে কেন কাজ করেনি বিজেপির হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি জাতীয়তাবাদী ওলামা দলের নতুন আংশিক কমিটি বাংলাদেশের হাসপাতাল ও চিকিৎসায় বিনিয়োগ সম্ভাবনা অন্বেষণে থাইল্যান্ডের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর আহ্বান ট্রাম্পের বিচার নিয়ে বিভক্ত যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্ট চুয়েট শিক্ষার্থীদের আন্দোলন স্থগিত, ক্লাসে ফেরার সিদ্ধান্ত

সকল