২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

আচরণবিধি মেনে না চলা সুষ্ঠু নির্বাচনের অন্তরায়

আচরণবিধি মেনে না চলা সুষ্ঠু নির্বাচনের অন্তরায় - ছবি : সংগৃহীত

সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীদের জন্য নির্বাচন কমিশন প্রণীত আচরণ বিধিমালা মেনে চলা অত্যাবশ্যক। স্বভাবতই প্রশ্ন দেখা দেয়, সাধারণ নির্বাচন ও উপনির্বাচনের ক্ষেত্রে কোন সময়কাল পর্যন্ত আচরণবিধি মেনে চলতে হবে। ২০০৮ সালে প্রণীত আচরণ বিধিমালায় একটি সময়কালকে নির্বাচনপূর্ব সময় হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছিল। এ বিধিমালায় সাধারণ নির্বাচনের ক্ষেত্রে এ সময়কালটি হলো সংসদের মেয়াদ উত্তীর্ণ কিংবা সংসদ ভেঙে যাওয়ার পর থেকে পরবর্তী সংসদ নির্বাচনের ফলাফল সরকারি গেজেটে প্রকাশের তারিখ পর্যন্ত। অপর দিকে উপ-নির্বাচনের ক্ষেত্রে সংসদের কোনো আসন শূন্য ঘোষণা হওয়ার পর থেকে ওই আসনের জন্য অনুষ্ঠিত উপ-নির্বাচনের জন্য ফলাফল সরকারি গেজেটে প্রকাশের তারিখ পর্যন্ত সময়কাল।

২০১৩ সালে নির্বাচনপূর্ব সময়ের সংজ্ঞা প্রতিস্থাপনপূর্বক সংশোধনীর মাধ্যমে বলা হয়- নির্বাচনপূর্ব সময় অর্থ জাতীয় সংসদের সাধারণ নির্বাচন কিংবা কোনো শূন্য আসনে নির্বাচনের ক্ষেত্রে কমিশন নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার দিন থেকে নির্বাচনের ফলাফল সরকারি গেজেটে প্রকাশের তারিখ পর্যন্ত সময়কাল।
রাজনৈতিক দল ও প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের জন্য প্রতিপালনীয় আচরণবিধিটি ২০০৮ সালে প্রণীত হয়। আচরণবিধি প্রণয়নকালীন সংসদের সাধারণ নির্বাচন বিষয়ে যে বিধান ছিল তাতে উল্লেখ ছিলÑ মেয়াদ অবসানের কারণে অথবা মেয়াদ অবসান ছাড়া অন্য কোনো কারণে সংসদ ভেঙে যাওয়ার পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে সংসদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।

সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংসদের সাধারণ নির্বাচন বিষয়ে আগের বিধানের পরিবর্তে নতুন বিধান প্রণীত হয়। নব প্রবর্তিত বিধানে বলা হয় মেয়াদ অবসানের কারণে সংসদ ভেঙে গেলে ভেঙে যাওয়ার পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে এবং মেয়াদ অবসান ব্যতীত অন্য কোনো কারণে সংসদ ভেঙে গেলে ভেঙে যাওয়ার পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে সংসদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।

সংসদের সাধারণ নির্বাচন-পরবর্তী প্রথম বৈঠকের তারিখ থেকে পাঁচ বছর অতিবাহিত হলে সংসদ ভেঙে যায়, যদিও রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে নির্ধারিত সময়কালের পূর্বেও সংসদ ভেঙে দিতে পারেন। দশম সংসদের প্রথম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয় ২৯ জানুয়ারি, ২০১৪ সালে। সে হিসাবে পাঁচ বছর পূর্তিতে দশম সংসদ ভেঙে যাবে ২৮ জানুয়ারি ২০১৯ সালে।

সংসদের সাধারণ নির্বাচনবিষয়ক পঞ্চদশ সংশোধনী-পূর্ববর্তী বিধান কার্যকর থাকাকালীন মেয়াদ অবসানের ক্ষেত্রে অথবা মেয়াদ অবসান ব্যতীত অন্য যেকোনো ক্ষেত্রে সংসদ ভেঙে যাওয়ার পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতো। সুতরাং নির্বাচনপূর্ব সময়টির গণনা সংসদ ভেঙে যাওয়ার পর থেকেই শুরু হতো। কিন্তু বর্তমানে মেয়াদ পূর্তির ক্ষেত্রে সংসদ বহাল থাকাবস্থায় মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কারণে নির্বাচনপূর্ব সময়ের গণনা নির্বাচন কমিশনের তফসিল ঘোষণার তারিখ থেকে শুরু হয় যদিও নির্বাচন অনুষ্ঠানকালীন ৯০ দিনের সময় গণনা তফসিল ঘোষণার আগেই শুরু হয়ে যায়। যেমন আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ক্ষেত্রে পূর্ববর্তী ৯০ দিনের সময় গণনা শুরু হয় ৩১ অক্টোবর, ২০১৮ এবং এটি অব্যাহত থাকবে ২৮ জানুয়ারি, ২০১৯ অবধি কিন্তু কমিশন কর্তৃক ৮ নভেম্বর, ২০১৮ তফসিল ঘোষণা করায় দেখা যায় নির্বাচনপূর্ব সময়ের গণনা শুরু হওয়ার আট দিন পর তফসিল ঘোষণা করা হয়।

আচরণবিধি অনুযায়ী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ কোনো রাজনৈতিক দল কিংবা এরূপ রাজনৈতিক দল মনোনীত প্রার্থী বা কোনো স্বতন্ত্র প্রার্থী বা তাদের পক্ষে অন্য কোনো ব্যক্তি ভোট গ্রহণের জন্য নির্ধারিত দিনের তিন সপ্তাহ সময়ের পূর্বে কোনো ধরনের নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করা থেকে বারিত। নির্বাচন কমিশন ঘোষিত মতে, ৩০ ডিসেম্বর ২০১৮ ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হলে ৯ ডিসেম্বর থেকে নির্বাচনী প্রচারণার সময়কাল শুরু হবে। নির্বাচনী প্রচারণার সময় মাইকের ব্যবহার দুপুর ২টা থেকে রাত ৮টার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে হয়।

নির্বাচনী প্রচারণায় কোনো গেট বা তোরণ নির্মাণ করা যায় না। নির্বাচনী প্রচারণায় প্যান্ডেলের আয়তন সর্বোচ্চ ৪০০ বর্গফুট। নির্বাচনী প্রচারণার অংশ হিসেবে বিদ্যুতের সাহায্যে কোনো ধরনের আলোকসজ্জা করা যায় না। কোনো সড়ক বা জনগণের চলাচল বা সাধারণ ব্যবহারের জন্য নির্ধারিত স্থানে নির্বাচনী ক্যাম্প স্থাপন করা যায় না। একজন প্রার্থীর জন্য প্রতিটি ইউনিয়নে সর্বোচ্চ একটি এবং প্রতিটি পৌরসভা বা সিটি করপোরেশন এলাকার প্রতি ওয়ার্ডে একটির অধিক নির্বাচনী ক্যাম্প স্থাপন বারিত। নির্বাচনী প্রচারণার জন্য প্রার্থীর ছবি বা প্রার্থীর পক্ষে প্রচারণামূলক কোনো বক্তব্য বা কোনো শার্ট, জ্যাকেট, ফতুয়া ইত্যাদির ব্যবহার বারিত। নির্বাচনী ক্যাম্পে ভোটারদের কোনোরূপ কোমল পাণীয় বা খাদ্য পরিবেশন বা উপঢৌকন দেয়া নিষিদ্ধ।

ট্রাক, বাস, মোটরসাইকেল, নৌযান, ট্রেন কিংবা অন্য কোনো যান্ত্রিক যানবাহনসহকারে মিছিল কিংবা মশাল মিছিল নিষিদ্ধ। মনোনয়নপত্র দাখিলের সময় কোনো ধরনের মিছিল বা শোডাউন নিষিদ্ধ। নির্বাচনী প্রচার কাজে হেলিকপ্টার বা অন্য কোনো আকাশযান ব্যবহার নিষিদ্ধ; তবে দলীয় প্রধানের যাতায়াতের ক্ষেত্রে এর ব্যবহার বারিত না হলেও এরূপ যাতায়াতের সময় হেলিকপ্টার হতে লিফলেট, ব্যানার বা অন্য কোনো প্রচার সামগ্রী প্রদর্শন বা বিতরণ নিষিদ্ধ।
রাজনৈতিক দল বা প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর প্রচারণার জন্য সভা-সমাবেশের আয়োজনে নির্বাচন কমিশন সমসুযোগ দেবে এবং একপক্ষ অপর পক্ষের সভা-সমাবেশে কোনো ধরনের বিঘœ বা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা থেকে বিরত থাকবে।
পোস্টার, লিফলেট ও হ্যান্ডবিল শুধু নির্ধারিত স্থানেই লাগানো যাবে। পোস্টার এবং ব্যানার সাদা-কালো রঙের হতে হবে এবং এগুলোর আয়তন যথাক্রমে সর্বোচ্চ ৬০ সেমি. বাই ৪৫ সেমি. এবং ৩ মিটার বাই ১ মিটার। এরূপ পোস্টার বা ব্যানারে একজন প্রার্থী তার প্রতীক ও নিজের ছবি ছাড়া অন্য কোনো ব্যক্তির ছবি ব্যবহার করতে পারবেন না।

দেয়ালে লিখে কোনো ধরনের নির্বাচনী প্রচারণা চালানো যাবে না। কোনো দালান, থাম, বাড়ি বা ঘরের ছাদ, সেতু, সড়কদ্বীপ, রোড ডিভাইডার, যানবাহন বা অন্য কোনো স্থাপনায় প্রচারণামূলক কোনো লিখন বা অঙ্কন করা যাবে না। নির্বাচনী প্রচারণার ক্ষেত্রে প্রতীক হিসেবে জীবন্ত প্রাণী ব্যবহার করা যাবে না।
নির্বাচনী প্রচারণাকালে ব্যক্তিগত চরিত্র হনন করে বক্তব্য প্রদান বা কোনো ধরনের তিক্ত বা উসকানিমূলক বা মানহানিকর বা নারী-পুরুষ হওয়ার কারণে কিংবা সাম্প্রদায়িকতা বা ধর্মানুভূতিতে আঘাত লাগে এমন কোনো বক্তব্য দেয়া যাবে না। মসজিদ, মন্দির, গির্জা বা অন্য কোনো ধর্মীয় উপাসনালয় কোনো প্রকার নির্বাচনী প্রচারণার উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা যাবে না।

সরকারি সুবিধাভোগী অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি তার নিজের বা অন্যের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণায় সরকারি যানবাহন বা অন্য কোনো ধরনের সরকারি সুবিধা ভোগ করতে পারবেন না এবং এতোদ্দেশ্যে সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারী বা কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক বা কর্মকর্তাকে ব্যবহার করতে পারবেন না।

কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী নির্ধারিত নির্বাচনী ব্যয়সীমা কোনো অবস্থাতেই অতিক্রম করতে পারবেন না। রাজনৈতিক দলের বা প্রতিদ্বন্দ্বী দলের কর্মীরা ভোটকেন্দ্রের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে পারবেন না।
সরকারি ডাকবাংলো, রেস্ট হাইজ, সার্কিট হাউজ বা কোনো সরকারি কার্যালয়কে কোনো দল বা প্রার্থীর পক্ষে বা বিপক্ষে প্রচারের স্থান হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না।

উপরোল্লিখিত বিধিবিধানের যেকোনো ধরনের ব্যত্যয় নির্বাচনপূর্ব অনিয়ম হিসেবে গণ্য হবে এবং এরূপ অনিয়ম দিয়ে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি বা নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল প্রতিকার চেয়ে নির্বাচনী তদন্ত কমিটি বা কমিশন বরাবর দরখাস্ত পেশ করতে পারবে। নির্বাচনপূর্ব সময়ে এরূপ বিধিবিধানের লঙ্ঘন হলে অনধিক ছয় মাসের কারাদণ্ড অথবা অনধিক ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ড দেয়ার বিধান রয়েছে।

আচরণবিধিতে উল্লিখিত বিধানাবলি নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীরা সঠিকভাবে মেনে চললে নির্বাচনের শান্তিপূর্ণ প্রচারণা কোনোভাবে বিঘিœত হওয়ার অবকাশ নেই, কিন্তু অতীতের অভিজ্ঞতা বলে দেয় নির্বাচন কমিশনের সঠিক নজরদারির অভাবে হরহামেশা নির্বাচনপূর্ব অনিয়মগুলো প্রভাবশালী দল ও ব্যক্তি কর্তৃক প্রতিকারবিহীনভাবে লঙ্ঘিত হয়ে আসছে। বর্তমান নির্বাচন কমিশনের কার্যকলাপ দৃষ্টে আচরণবিধির সুষ্ঠু ও কার্যকর প্রয়োগে তারা যে একনিষ্ঠ এমন কোনো প্রত্যয় আপাতত দৃষ্টিগ্রাহ্য নয়। এ বাস্তবতায় আচরণবিধির প্রয়োগে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে নির্বাচন কমিশন কতটুকু আন্তরিক তা অনাগত দিন বলে দেবে।

লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনীতি ও অর্থনীতি বিশ্লেষক
E-mail: iktederahmed@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement
লালমনিরহাটে বিএসএফের গুলিতে বাংলাদেশী যুবক নিহত এখনো শেষ হয়নি বিতর্কিত আউটের রেশ, ব্যতিক্রমী প্রতিবাদ মুশফিকের ‘ফ্রি ভিসার গল্প’ আর শূন্য হাতে ফেরা লাখো শ্রমিক নোয়াখালীতে প্রবাসীর স্ত্রীর ব্যক্তিগত ছবি দেখিয়ে চাঁদা আদায় দেশের উন্নয়নে পাকিস্তান প্রশংসা করে, অথচ বিরোধী দল দেখে না : কাদের আশুলিয়ায় বাঁশবাগান থেকে নারী পোশাক শ্রমিকের রক্তাক্ত লাশ উদ্ধার মিয়ানমারের কর্মকর্তারা ফেরত গেলেন, কিন্তু রোহিঙ্গা সঙ্কট কি আরো জটিল হচ্ছে দিনাজপুরে দুই ট্রাকের সংঘর্ষ, চালক-হেলপার নিহত মানিকগঞ্জে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ২ সখীপুরে বৃষ্টির জন্য অঝোরে কাঁদলেন মুসল্লিরা দক্ষিণ ভারতে কেন কাজ করেনি বিজেপির হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি

সকল