২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

কাশ্মিরে ডেভিড ও গলিয়াথের নতুন যুদ্ধ

কাশ্মিরে ডেভিড ও গলিয়াথের নতুন যুদ্ধ - ছবি : নয়া দিগন্ত

তিন বছর আগে নরেন্দ্র মোদির বিজেপির সাথে পিপলস ডেমোক্র্যাটিক পার্টির (পিডিপি) বাঁধা জোট থেকে বিজেপির প্রত্যাহারের ফলে জম্মু ও কাশ্মিরের মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে মেহবুবা মুফতিকে সম্প্রতি পদত্যাগ করতে হলো। এর ফলে জম্মু ও কাশ্মিরের রাজনীতি অধিকতর অনিশ্চিত চক্রে প্রবেশ করল। তিন বছর আগে বিজেপির সাথে মেহবুবা মুফতির হাত মেলানোর সময় এ জোট সম্পর্কে অনেকেই বিস্মিত হয়েছিলেন। বিজেপি বলছে, এই জোট থেকে তাদের প্রত্যাহার করার বিষয়টি মোদি সরকারের জন্য কৌশলগতভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কারণ, বেড়ে যাওয়া সন্ত্রাসের প্রেক্ষাপটে পিডিপির সাথে জোট আর টেকসই অবস্থায় নেই। সহজেই অনুমেয় মাত্র আর কয়েক মাস পর ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে বিজেপি চায় অন্য কারো সাথে জোট গঠন করতে। সে পথে পিডিপি যাতে কোনো বাধা হয়ে না দাঁড়ায়, সেজন্যই এটি হচ্ছে বিজেপির হাত সাফ করে নেয়া।

এ দলটি ভালো করেই জানে, এটি গত দুই বছরে জম্মুতে এর জনভিত্তি হারিয়েছে, ঠিক একইভাবে পিডিপি কাশ্মিরে এর জন-আস্থা ও জনসমর্থন হারিয়েছে কাশ্মির উপত্যকায়। এ সময়ে সেখানে অস্থিতিশীলতা বেড়েছে, বেড়েছে সামাজিক সঙ্কট। যেমন- বেকারত্ব ও অর্থনৈতিক স্থবিরতা বেড়ে গেছে। মেহবুবা মুফতির পদত্যাগের পর সেখানে চালু হয়েছে কেন্দ্র তথা গভর্নরের শাসন এবং নতুন করে কার্যকর করা হয়েছে Armed Forces Special Powers Act (AFSPA)। এর ফলে জম্মু ও কাশ্মির রাজ্যে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা আরো শতগুণে বেড়ে যাবে বলেই মনে হয়। প্রশ্ন হচ্ছে- এরপর এই রাজ্যে বিশেষ করে কাশ্মির উপত্যকায় কী ঘটতে যাচ্ছে? মনে হচ্ছে, সেখানে এবার সেই বাইবেলীয় ডেভিড ও গলিয়াথের যুদ্ধের খেলাই শুরু হবে। ডেভিড ও গলিয়াথের সেই গল্প আমাদের শিক্ষা দেয় সাহস ও সুদৃঢ় বিশ্বাস থাকলে অনেক অসম্ভবকে সম্ভব করে তোলা যায়। ডেভিড ও গলিয়াথের অসম যুদ্ধে ডেভিড হচ্ছে শক্তিতে দুর্বল অথচ অদম্য সাহস আর সুদৃঢ় আস্থার প্রতীক। আর গলিয়াথ হচ্ছে অসাধারণ শক্তিমত্তার অধিকারী। কিন্তু ডেভিড তার অসীম সাহস আর সুদৃঢ় বিশ্বাসকে কাজে লাগিয়ে ঘায়েল করে গলিয়াথকে। কাশ্মিরে ডেভিড হচ্ছে স্বাধীনতাকামী কাশ্মিরি জনগণ আর গলিয়াথ হচ্ছে ভারত সরকার। ভারত চায় গায়ের জোরে কাশ্মিরের রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান টানতে। রমজানে অস্ত্রবিরতি বাতিল ও নতুন করে এএফএসপিএ কার্যকর করার মধ্যে সে বিষয়টি আবারো নতুন করে প্রমাণিত হলো। তা ছাড়া, এ ঘটনা থেকে এটুকু স্পষ্ট, কাশ্মির প্রশ্নে নয়াদিল্লি হার্ডলাইনে চলার অবস্থানই নিয়েছে। এই হার্ডলাইনের মধ্যমেই নয়াদিল্লি কাশ্মিরের ওপর ভারতের সার্বভৌমত্ব জোর করে কায়েম করতে চায়, অস্বীকার করতে চায় কাশ্মিরি জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার; যার প্রতিশ্রুতি নেহরু থেকে শুরু করে ভারতীয় অনেক নেতাই দিয়েছিলেন। কিন্তু কেউ কথা রাখেননি। নতুন করে এএফএসপিএ কার্যকরের ঘোষণার অর্থ হচ্ছে, পুরো কাশ্মির উপত্যকাকে ভারত একটি যুদ্ধাঞ্চল হিসেবে বিবেচনা করবে। ভারতের যুক্তি হচ্ছে, ভারতের নিয়ন্ত্রিত কিংবা দখল করে রাখা এই রাজ্য তথা এই রেস্টিভ স্টেটের পুরো জনগোষ্ঠী হচ্ছে অ্যান্টি-ন্যাশনাল। তাই সেখানে সশস্ত্রবাহিনীকে ক্ষমতা দেয়া হয়েছে ‘কর্ডন ও সার্চের’ এবং লক্ষ্যস্থল ‘বিচ্ছিন্ন ও ধ্বংস’ করে দেয়ার। এর অপর অর্থ পুরো কাশ্মির উপত্যকাকে একটি যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত করা।

মজার ব্যাপার হলো জম্মু ও কাশ্মিরে এই পরিবর্তন তখনই ঘটছে, যখন ভারত যেন মরিয়া হয়ে উঠেছে ভারতকে একটি হিন্দুরাষ্ট্রে রূপ দিতে। এরা এ কাজটি সম্পন্ন করতে চায় উপনিবেশবাদীদের মতো পেশিশক্তির সাহায্যে কাশ্মিরি জনগণের জাতীয়তাবাদী চেতনাকে অবদমনের মাধ্যমে। ঠিক একইভাবে ব্রিটিশরা চেষ্টা করেছিল ভারতীয় স্বাধীনতার চেতনা অবদমনের মাধ্যমে উপনিবেশ কায়েম রাখতে। কিন্তু তা হওয়ার নয়। কারণ, মানুষের স্বাধীনতার জাতীয়তাবাদী চেতনাকে কখনোই দমানো যায় না। সাময়িকভাবে এর চেষ্টা চলতে পারে; কিন্তু চূড়ান্ত বিবেচনায় তা ব্যর্থ হতে বাধ্য। ইতিহাস এর প্রমাণ।
কিন্তু সেখানে যেসব ঘটনা ঘটছে তাতে মনে হচ্ছে, সেখানে ডেভিড ও গলিয়াথের যুদ্ধ নতুন করে শুরুর পথে। সেখানে নিয়ন্ত্রিত বা দখলে রাখা কাশ্মিরের কাশ্মিরি জাতীয়তাবাদ ধ্বংস করে হিন্দু জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠার ব্যর্থ প্রয়াস চালাচ্ছে ভারত। এ ক্ষেত্রে ভারত স্পষ্টত অবতীর্ণ হয়েছে গলিয়াথের ভূমিকায়। অপর দিকে কাশ্মিরিদের আমরা দেখতে পাচ্ছি দুর্বল, ভঙ্গুর ও অসহায় ডেভিডের প্রতীক হিসেবে। তবে তাদের আছে অদম্য সাহস, অবিচল আস্থা ও বিশ্বাস; যা কাজে লাগিয়ে গলিয়াথ ভারতের বিরুদ্ধে লড়ে একদিন এরা কাশ্মিরের মাটিতে উড়াবে স্বাধীনতার পতাকা। এই ডেভিড কী করে গলিয়াথকে পরাজিত করে চলেছে তা গোটা বিশ্বের লাখ লাখ মানুষ প্রতিদিন টেলিভিশন সেটে দেখছে। জম্মু ও কাশ্মিরের রয়েছে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট। জাতিসঙ্ঘের প্রতিটি সদস্য দেশের তা জানা আছে। সেসব ঐতিহাসিক সত্যকে ভারত বিকৃত করতে চায়, উপস্থাপন করতে চায় কাশ্মিরকে ভারতভুক্তির। নিজস্ব সংস্করণের ইতিহাস তুলে ধরতে চায়, যা বাকি দুনিয়া মেনে নিতে নারাজ। ভারত ধরে নিয়েছে জম্মু ও কাশ্মির রাজ্যে ভারতের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা এখন পূর্ণতা পেয়েছে। ভারত ইতিহাসপরম্পরা ছিন্ন করে অস্বীকার করতে চায়, ভারত বিভাগ হয়েছিল ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে। বলতে চায় জম্মু ও কাশ্মিরে যে মানবিক প্রতিরোধ তা হচ্ছে সন্ত্রাস। আর ভারত লড়াই করছে সন্ত্রাসের কারখানার বিরুদ্ধে। আর ভারত বিশ্বসমাজকে আহ্বান জানিয়েছে এই সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়তে।

ভারত পুরোপুরি অস্বীকার করছে জম্মু ও কাশ্মির প্রশ্নে জাতিসঙ্ঘের ৭০ পৃষ্ঠার মানবাধিকার লঙ্ঘনের রিপোর্ট। তা অস্বীকার করার অর্থ কাশ্মিরের ওপর দেশটির দাবির প্রতি অনড় থাকারই নামান্তর। তা ছাড়া, ভারত অস্বীকার করেছে কাশ্মির সমস্যার সমাধানের প্রশ্নে চীনের প্রস্তাবও। চীন প্রস্তাব দিয়েছে পাকিস্তানের সাথে বসে এ সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নিতে। সন্দেহ নেই, বর্তমান সরকার জম্মু ও কাশ্মিরে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে। এই ধ্বংসযজ্ঞ থেকে বেরিয়ে আসার একমাত্র উপায় সংলাপ প্রক্রিয়া শুরু করা।
বিজেপির উল্লিখিত জোট থেকে প্রত্যাহার ছিল অপ্রত্যাশিত। কেন্দ্রের অস্ত্রবিরতি বাতিল করার এক দিন পর বিজেপির এই জোট থেকে প্রত্যাহারের ঘোষণা আসে। রমজানের শুরুতে এই অস্ত্রবিরতি শুরু হয়েছিল। খবরে প্রকাশ, মেহবুবা মুফতি বলেছিলেন কাশ্মির উপত্যকায় এই অস্ত্রবিরতি অব্যাহত রাখার জন্য। কিন্তু কেন্দ্র তার এই কথা রাখেনি বলেই দৃশ্যত মনে হয়। আর বিজেপির মাথায় এখন নতুন জোট গঠনের চিন্তা। মেহবুবা মুফতির পদত্যাগের মাত্র কয়েক দিন আগে বিখ্যাত সাংবাদিক ও ‘রাইজিং কাশ্মির’-এর সম্পাদক সুজাত বুখারিকে ঈদের প্রাক্কালে বন্দুকধারীরা তার অফিসের বাইরে নির্মমভাবে হত্যা করে। এই খুনের ঘটনা মেহবুবা মুফতির সরকার ব্যাপক আস্থাসঙ্কটের মুখে পড়ে। কারণ, বুখারির ভাই ছিলেন তার মন্ত্রিসভার সদস্য। ঘটনাক্রমে একই দিনে জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার-সংক্রান্ত হাইকমিশনারের অফিস থেকে প্রকাশ করা হয় জম্মু-কাশ্মির ও আজাদ কাশ্মির-সম্পর্কিত মানবাধিকার রিপোর্ট। এ রিপোর্টে বিগত দুই বছরের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ক্যাটালগ প্রকাশিত হয়। এই রিপোর্টে জম্মু-কাশ্মির ও আজাদ কাশ্মিরের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ব্যাপারে স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠনের আহ্বান জানানো হয়েছে। ভারত সেই আহ্বান প্রত্যাখ্যান করে বলেছে- এটি ভারতের সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তার ওপর হস্তক্ষেপ। ভারত এই রিপোর্টকে ভ্রান্তিমূলক, উদ্দেশ্যতাড়িত ও প্রভাবিত বলে দাবি করেছে। ভারতের ইউনিয়ন সরকার আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থার এ ধরনের রিপোর্ট ও বিবৃতি প্রত্যাখ্যান এই প্রথমবার করেনি। জম্মু-কাশ্মিরের প্রতিটি সঙ্কটের সময় এতে বিদেশীদের হাত থাকার কথা বলে সঙ্কট ও মৌলিক সমস্যাগুলো নিরসনের বিষয় প্রতিটি সরকার এড়িয়ে গেছে। বিভিন্ন মহল বলছে, সুজাত বুখারির হত্যার বিষয়টির পেছনে বিজেপির হাত রয়েছে। কেউ কেউ বলছেন, গান্ধীকে যারা হত্যা করেছিল, সুজাতকে তারাই হত্যা করেছে।

পর্যবেক্ষকেরা বলছেন, বিজেপি-পিডিপি জোট সমস্যাকর ছিল শুরু থেকেই। এর কারণ, এ দু’টি দল জম্মু ও কাশ্মিরের মর্যাদা প্রশ্নে পুরোপুরি বিপরীত ধারণা পোষণ করে। ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ নম্বর ধারা এবং এর সংশ্লিষ্ট স্পেশাল স্ট্যাটাস প্রশ্নে রয়েছে বিজেপির সুপরিচিত অবস্থান। পিডিপি চোখ বন্ধ করে থাকতে পারে না কাশ্মিরের গুরুতর অবস্থা সম্পর্কে, যেমনটি পারে বিজেপি। সেজন্য পিডিপি চেয়েছে বিদ্রোহীদের সাথে সংলাপ হোক। এ দিকে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কাশ্মিরে অস্থিতিশীলতা বেড়েই চলেছে। সেই সাথে আলোচ্য জোটের দুই পক্ষের মধ্যকার বিরোধও আরো জোরদার হয়ে ওঠে। এক দিকে বিজেপি চায় কঠোরতা অবলম্বনের মধ্য দিয়ে কাশ্মির সমস্যার সমাধান করতে, অপর দিকে পিডিপি চায় উদারতা অবলম্বনের মধ্য দিয়ে এ সমস্যার সমাধান টানতে। এমনকি বিদ্রোহীদের সাথে সমঝোতায় পৌঁছার মুফতির পরামর্শকেও ভালো চোখে দেখেনি বিজেপি।
বিজেপি বলেছেÑ জম্মু ও কাশ্মিরে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ও অচলাবস্থার কারণে দলটি জোট থেকে সরে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তাদের দলের এমনকি মোদি সরকারের দায়িত্বটি এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। কেননা জোট সরকারের অংশ ছিল এ দলটিও। মেহবুবা মুফতি এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, তার দল সব সময় ‘রিকনসিলেশনে’ বা বিরোধ মিটিয়ে ফেলায় বিশ্বাসী। কিন্তু বিজেপি পেশিশক্তি প্রদর্শনের নীতি ও কৌশল অবলম্বনে এতটাই ব্যস্ত ছিল যে, জম্মু ও কাশ্মিরে শান্তিপ্রক্রিয়া চালানোর কোনো সুযোগ পায়নি। তিনি বলেন, পিডিপি মাসের পর মাস বিজেপির সাথে সমঝোতায় পৌঁছার চেষ্টা চালিয়েছে। তিনি বলেছেন, আমরা চেয়েছি কাশ্মিরের বিরোধ মিটিয়ে ফেলা ও পাকিস্তানের সাথে উত্তেজনা কমিয়ে আনতে। অপর দিকে বিজেপির সাধারণ সম্পাদক রাম মাধব বলেছেন- কাশ্মিরে টেররিজম, ভায়োলেন্স, র‌্যাডিকেলিজম ও নাগরিকদের অধিকার বিপজ্জনক পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। তিনি আরো বলেন, জোট থেকে প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে ভারতের নিরাপত্তা ও সংহতির বৃহত্তর স্বার্থে। রাম মাধব আরো ঘোষণা করেন, আমরা এই রাজ্যে নিয়ন্ত্রণ ফিরিয়ে আনার জন্য গভর্নরকে প্রয়োজনীয় ক্ষমতা দেয়ার সিদ্ধান্তও নিয়েছি।

কাঠুয়ায় আট বছরের এক মুসলিম মেয়েকে ধর্ষণের পর হত্যার বিষয়টি সারা ভারতে এমনকি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রবলভাবে সমালোচিত হয়। বিষয়টি বিজেপি-পিডিপি জোটে মোড় ফেরানোর ঘটনা হিসেবে কাজ করে। পিডিপি সরাসরি অভিযোগ করে, এ ঘটনার জন্য দায়ী বিজেপি সমর্থকদের সুরক্ষা দেয়। বিজেপি এই ঘটনার তদন্ত সিবিআই-এর কাছে দিতে দাবি করলেও পিডিপি দাবি করে তা রাজ্য পুলিশ করবে। কারণ, ইউনিয়ন সরকার-নিয়ন্ত্রিত এজেন্সি সিবিআই দিয়ে এই তদন্ত সুষ্ঠু হবে না বলেই দাবি করেন মেহবুবা মুফতি। এ দিকে কয়েক মাস ধরে বিক্ষোভকারীদের ওপর সেনাবাহিনীর পেলেট গান ব্যবহারের বিষয়টি ভারতে ও ভারতের বাইরে সমালোচনা ও নিন্দার মুখে পড়ে। এর ফলে আহত হওয়া ও দৃষ্টিশক্তি হারানো লোকদের সংখ্যা ব্যাপক। জম্মু ও কাশ্মিরের স্টেট হিউম্যান রাইটস কমিশনের (এসএইচআরসি) কাশ্মির উপত্যকার ১০ জেলার তথ্য সংগ্রহ করেছে। তাদের দেয়া তথ্য মতে, ২০১৬ সালের মেটাল পেলেটের আঘাতে কাশ্মিরে আহত হয়েছে এক হাজার ৭২৬ জন। অপর দিকে মেহবুবা মুফতি গত জানুয়ারিতে রাজ্যসভায় বলেছেন, ২০১৬ সালের ৮ জুলাই থেকে ২০১৭ সালের ১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময়ে ছয় হাজার ২২১ জন পেলেটের আঘাতে আহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে ৭২৮ জনের চোখে আঘাত লেগেছে।

একইভাবে ২০১৬ সালের জুলাইয়ে হিজবুল মুজাহেদিন নেতা বুরহান ওয়ানির হত্যা কাশ্মির উপত্যকায় ও ভারতের কয়েকটি জেলায় ব্যাপকভিত্তিক বিক্ষোভের জন্ম দেয়। বিক্ষোভ দমনে ভারতীয় বাহিনীর দমনপীড়ন আবারো পরিস্থিতির অবনতি ঘটায়। বেড়ে যায় তাদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের মাত্রাও। জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৯৮০-এর দশকের শেষ দিকে, ১৯৯০-এর দশকের প্রথম দিকে ২০০৮ ও ২০১০ সালে কাশ্মিরে ব্যাপক বিক্ষোভ দেখা দেয়। কিন্তু বর্তমান সময়ের বিক্ষোভে অতীতের তুলনায় অনেক বেশি সংখ্যায় জনসংশ্লিষ্টতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। আর আজকের দিনের বিক্ষোভে সংশ্লিষ্ট হচ্ছে তরুণ, মধ্যবিত্ত কাশ্মিরি নারীরাও, যা অতীতের বিক্ষোভের সময় দেখা যায়নি। জাতিসঙ্ঘের রিপোর্টে আরো উল্লেখ করা হয়, এই রাজ্যে কার্যকর রয়েছে আরো বিশেষ আইন, যেমন ১৯৯০ সালে এএফএসপিএ নামের আইন এবং ১৯৭৮ সালের জম্মু ও কাশ্মির পাবলিক সেফটি অ্যাক্ট। এসব আইন কাশ্মিরে স্বাভাবিক আাইনের গতি ব্যাহত করছে। মানবাধিকার লঙ্ঘনে করছে সহায়তা। এএফএসপিএ আইনে নিরাপত্তা বাহিনীকে ব্যাপক ক্ষমতা দেয়া হয়েছে কাশ্মিরে বিভিন্ন অভিযান পরিচালনার। এসব অভিযান পরিচালনার সময় নিরাপত্তা বাহিনীর কোনো সদস্যের আচরণের বিরুদ্ধে আদালতের আশ্রয় নেয়া যাবে না। ভারতের সুপ্রিম কোর্ট ২০০৫ সালে মন্তব্য করেন, এই আইন: ‘a symbol of oppression, an object of hate and an instrument of discrimination and high-handedness.’ এরপরও এ আইনটি কার্যকর রাখা হয়েছে কাশ্মিরিদের দমনপীড়নের জন্য।

১৯১৭ সালের এপ্রিলে ভারতীয় সেনাবাহিনী দুর্নাম কুড়ায় ও সমালোচনার মুখে পড়ে কাশ্মিরে এর অবলম্বিত ‘মানব বর্ম’ নীতিকৌশল অবলম্বনের জন্য। তখন ২৬ বছরের কাশ্মিরি তরুণ ফারুক আহমদ দারকে একটি সামরিক যানের বনেটের সাথে বেঁধে ভারতের এক জ্যেষ্ঠ সেনাকর্মকর্তা শ্রীনগরের সড়কে ঘুরে বেড়ান। এই অমানবিক কাজের জন্য মানবাধিকার সংস্থাগুলো ও রাজনৈতিক দলগুলোর সমালোচনার মুখে পড়ে ভারতীয় সেনাবাহিনী ও সেনাবাহিনীর এই কর্মকর্তা। এরপরও ভারত একে পাথর নিক্ষেপকারী কাশ্মিরিদের বিরুদ্ধে নিরাপত্তার খাতিরে করা হয়েছে বলে দাবি করে। খবরে প্রকাশ, অধিকন্তু এই সেনাকর্মকর্তার এই কাজের জন্য ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রধান তাকে উচ্চ প্রশংসা করেছেন। ঘটনার দুই মাস পর জম্মু ও কাশ্মির রাজ্য মানবাধিকার কমিশন এই কাজকে ‘অবৈধ’ বলে আখ্যায়িত করে এবং ফারুক আহমদ দারকে দুই লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেয়ার আদেশ দেয়।

কয়েক বছর ধরে জম্মু ও কাশ্মিরে বেশ কয়েকবার যোগাযোগ সমস্যার সৃষ্টি করে সেখানকার সরকার। রাজ্যসরকার বাতিল করে মোবাইল ও ইন্টারনেট যোগাযোগ। কখনো কখনো কয়েক মাস ধরে চলে এই যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতা। গণমাধ্যম ও সাংবাদিকদের মত প্রকাশের বাধা দেয়ার ঘটনা ঘটে। ২০১৬ সালে পুলিশ কাশ্মির উপত্যকার প্রধান তিনটি সংবাদপত্র অফিসে অভিযান চালায়। এগুলো হচ্ছে- গ্রেটার কাশ্মির, কাশ্মির টাইমস ও রাইজিং কাশ্মির। নিরাপত্তা সংস্থা এসব সংবাদপত্রের কপি বাজেয়াপ্ত করে। কয়েকজন স্টাফকে আটক করা হয়। সংবাদপত্র প্রকাশও তিন দিন বন্ধ রাখার ঘটনা ঘটে। এমনকি মুখ্যমন্ত্রী এই সংবাদপত্রের স্বাধীনতা বিঘিœত করার ঘটনার কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারেননি।

আসলে বিজেপি মনে হয় এবার আরো কঠোরতা নিয়ে কাশ্মিরিদের দমনে নামার লক্ষ্য নিয়েই মেহবুবা মুফতির দলের সাথে জোট ছিন্ন করেছে। মেহবুবা মুফতির পদত্যাগ, রমজানের অস্ত্রবিরতি বাতিল করা এবং সেখানে কেন্দ্রের গভর্নরের শাসন চালু ও বিশেষ ক্ষমতার আইনগুলো আবার নতুন করে কার্যকর করার মধ্যমে সে আভাসই মিলছে। আসলে সেখানে নতুন করে শুরু হয়েছে ডেভিড আর গলিয়াথের খেলা। এখন দেখার বিষয়, এই যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলায় শেষ পর্যন্ত কে জয়লাভ করে।হ


আরো সংবাদ



premium cement