পৃথিবী কোনো মানুষের স্থায়ী আবাসস্থল নয়। পৃথিবী সৃষ্টির পর থেকে এ পৃথিবীতে যেসব মানুষের আগমন ঘটেছে, তারা প্রত্যেকেই এখানে অল্প কিছু সময় ক্ষণস্থায়ীরূপে বসবাসরত অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে বিদায় নিয়েছেন। বর্তমানে যারা বসবাস করছেন, তাদের সবাইকেই অনুরূপভাবে বিদায় নিতে হবে এবং ভবিষ্যতে যাদের আগমন ঘটবে, তারাও অবশ্যই বিদায় নেবেন।
পৃথিবীতে মানুষ অস্থায়ীভাবে বাস করে, তাই এটি তাদের অস্থায়ী আবাসস্থল। এখানে কারো পক্ষে স্থায়ীভাবে বসবাস করা সম্ভব নয়। পৃথিবীতে একজন মানুষের অবস্থান কত দিন হবে, সেটি আল্লাহ নির্ধারণ করে দিয়েছেন। আমাদের দেশে বিগত শতকে মানুষের গড় আয়ু ছিল ৫০ বছরের নিচে। বর্তমান দশকে গড় আয়ু বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭০ বছরের ঊর্ধ্বে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও এ দশকে মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে এবং যেভাবে চিকিৎসা বিজ্ঞানের উৎকর্ষ সাধিত হচ্ছে, তাতে মানুষের মধ্যে ব্যাপক আশার সঞ্চার হয়েছে যে, আগামী কয়েক দশকের মধ্যে গড় আয়ুর ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটবে। পৃথিবীর কোনো কোনো অঞ্চলে মানুষের গড় আয়ু ১০০ বছরের অধিক হলেও কোনো দেশে মানুষের গড় আয়ু ১০০ বছরের সীমা অতিক্রম করেনি।
একজন মানুষ যে স্থানে জন্মগ্রহণ করে সেটিকে বলা হয় তার জন্মস্থান। আমরা সচরাচর জন্মস্থান হিসেবে যে জেলায় জন্মগ্রহণ করি, সেটির নাম উল্লেখ করলেও প্রায়ই আমাদের স্থায়ী নিবাস হিসেবে পৈতৃক বাড়ির ঠিকানা উল্লেখ করি। আর আমরা অস্থায়ীভাবে যেখানে বসবাস করি, সেটিকে বর্তমান ঠিকানা হিসেবে উল্লেখ করি। আমাদের দেশে শহরে বসবাসরত বেশির ভাগ মানুষ এক পুরুষ বা দুই পুরুষ আগে গ্রাম থেকে আসা। গ্রাম থেকে আসা এসব মানুষ তাদের স্থায়ী ঠিকানা হিসেবে গ্রামের বাড়ির ঠিকানা উল্লেখ করে থাকে। অপর দিকে শহরে যে ঠিকানায় বসবাস করে, সেটিকে বর্তমান ঠিকানা হিসেবে উল্লেখ করে থাকে।
শহরে বসবাসরত কিছু মানুষ ভাড়া বাসায় অবস্থান করে। এরা সব সময় ভাড়া বাসাটিকে বর্তমান ঠিকানা হিসেবে উল্লেখ করে। শহরে বসবাসরত এমন অনেক মানুষ রয়েছেন, যারা নিজ মালিকানার বাড়িতে বসবাস করেন। এদের কেউ কেউ বসবাসরত বাড়িটির ভূমির পৈতৃক সূত্রে মালিক, আবার কেউ খরিদ সূত্রে মালিক। এদের মধ্যে যারা পৈতৃক সূত্রে মালিক, তারা শহরের বাসভবনের ঠিকানাকে স্থায়ী ঠিকানা হিসেবে উল্লেখ করে থাকেন। অপর দিকে যারা খরিদ সূত্রে মালিক, এদের প্রায় সবাই গ্রামের বাড়ির পৈতৃক আবাসস্থলকে স্থায়ী ঠিকানা হিসেবে উল্লেখ করে থাকেন।
একটি শিশুর এ পৃথিবীতে জন্ম-পরবর্তী তার জন্মসনদ গ্রহণের প্রয়োজন দেখা দেয়। জন্মসনদ গ্রহণকালীন শিশুটির বাবা-মাকে শিশুটির নাম, বাবা-মায়ের নাম এবং বর্তমান ও স্থায়ী ঠিকানা উল্লেখ করতে হয়। এ শিশুটি যখন তার শিক্ষাজীবনের শুরুতে স্কুলে ভর্তি হয়, তখন তাকে তার ঠিকানার বিস্তারিত বিবরণ দিতে হয়। এ বিবরণীর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত থাকে নিজ নাম, বাবা-মায়ের নাম, বর্তমান ও স্থায়ী ঠিকানা প্রভৃতি।
একটি শিশু তার শৈশবকালে পারিবারিক গণ্ডির মধ্যে নৈতিকতা ও নীতিজ্ঞান বিষয়ে জ্ঞান লাভ করে। এ নৈতিকতা ও নীতিজ্ঞান তার মধ্যে সত্য কথা বলার অভ্যাস গড়ে তোলে। পরে পারিবারিক গণ্ডি অতিক্রম করে শিশুটি যখন শিক্ষা গ্রহণের জন্য স্কুলে যাওয়া-আসা শুরু করে, তখন সেখানে সে শিক্ষকদের কাছ থেকে সব সময় সত্যের প্রতি অবিচল থাকার বিষয়ে দীক্ষা লাভ করে। ধর্মীয় শিক্ষালাভের সময় শিশুটি সত্যের প্রতি অবিচল থাকার বিষয়ে আকৃষ্ট হয়। এ শিক্ষা শিশুটির মধ্যে জীবনের সব পর্যায়ে সত্যকে ধারণ ও মিথ্যাকে বর্জনের পথ বাতলে দেয়। এরূপ একটি শিশু প্রাথমিক ও নি¤œ মাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশ নেয়ার আগে নিবন্ধন ফরম পূরণের সময় তাকে নিজের বর্তমান ও স্থায়ী ঠিকানা উল্লেখ করতে হয়। পরবর্তীকালে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের নিবন্ধন ফরম পূরণের সময়ও উভয় ঠিকানা উল্লেখ করতে হয়। যেসব শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষা নিতে আগ্রহী, তাদের বিশ্ববিদ্যালয় অথবা প্রকৌশল বা চিকিৎসা মহাবিদ্যালয়ে ভর্তির আবেদন দাখিলের সময় বর্তমান ও স্থায়ী ঠিকানা উল্লেখ করতে হয়। যে শিশু জীবনের সূচনালগ্নে সত্য বলার ও মিথ্যা পরিহারের শিক্ষা লাভ করে, সে শিশুটি শিক্ষাজীবনের মধ্যবর্তী বা শেষ পর্যায়ে বর্তমান ঠিকানার সাথে স্থায়ী ঠিকানা হিসেবে যে ঠিকানাটি উল্লেখ করে, এটি আদৌ তার স্থায়ী ঠিকানা কি না, বিষয়টি নিয়ে যাদের মনে প্রশ্নের উদয় হয়, তা তাদের ভাবিয়ে তোলে।
চাকরির আবেদনের ক্ষেত্রে আবেদনকারীকে তার ঠিকানার বিবরণে অপরাপর বিষয়ের সাথে বর্তমান ও স্থায়ী ঠিকানা উল্লেখপূর্বক ঘোষণা দিতে হয় যে, তিনি স্বজ্ঞানে ওই আবেদনপত্র পূরণ করেছেন এবং আবেদনপত্রে বর্ণিত সব তথ্য সত্য। এখন প্রশ্ন- আবেদনকারীর বর্ণিত স্থায়ী ঠিকানা সত্য হয়ে থাকলে মৃত্যুর পরক্ষণে তার কাছে পাঠানো চিঠি তার হাতে পৌঁছবে কি না?
চাকরির আবেদনপত্রের মতো পাসপোর্টের আবেদনপত্র ও পাসপোর্টে এবং জাতীয় পরিচয়পত্রে বর্তমান ঠিকানার পাশাপাশি স্থায়ী ঠিকানা উল্লেখ থাকে। এ ক্ষেত্রেও মৃত ব্যক্তির স্থায়ী ঠিকানায় তার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে যোগাযোগ সম্ভব হবে কি না, সে প্রশ্নটিও এসে যায়।
এ পৃথিবীতে অবস্থানকালীন একজন ব্যক্তির দু’টি ঠিকানা হতে পারে। এর একটি বর্তমান ঠিকানা এবং অপরটি জীবদ্দশাকালীন ঠিকানা। যেকোনো ধরনের আবেদনপত্রে অঙ্গীকারনামা দেয়ার মাধ্যমে একজন ব্যক্তিকে স্থায়ী ঠিকানা উল্লেখ করার জন্য বাধ্য করা হলে, এটি তাকে দিয়ে মিথ্যা অঙ্গীকারনামা বা ঘোষণা দিতে বাধ্য করা বৈ আর কিছু নয়।
বাংলাদেশ মুসলিম জনসংখ্যা অধ্যুষিত দেশ। দেশটির সামগ্রিক জনসংখ্যার ৯০ শতাংশের অধিক মুসলিম। মুসলিমদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কুরআন মজিদে একাধিকবার উল্লেখ রয়েছে- প্রত্যেক জীবিত প্রাণীকে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। মৃত্যুপরবর্তী একজন মুসলমানকে কবরস্থ করা হয়। মুসলমানদের মতো খ্রিষ্টান ও ইহুদি ধর্মাবলম্বীদেরও মৃত্যু-পরবর্তী কবর দেয়া হয়। হিন্দুধর্মসহ অপর যেসব ধর্মাবলম্বীকে মৃত্যু-পরবর্তী মৃতদেহ দাহ করে, তারাও আর্থিক সক্ষমতা সাপেক্ষে দাহ করার নির্দিষ্ট স্থান শ্মশানে মৃত ব্যক্তির উদ্দেশ্যে স্মৃতিচিহ্ন বা স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করে। পৃথিবীতে বসবাসকারী কোনো মানুষের অমরত্ব লাভের সুযোগ নেই। আর তাই মৃত্যুর পর প্রত্যেক ধর্মাবলম্বীকে নিজ ধর্মীয় বিধান অনুযায়ী আচার-অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে চিরবিদায় দেয়া হয়। মৃত্যুর সাথে সাথে একজন মানুষের পৃথিবীর সাথে সব যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে যায়। মৃত্যুর পর একজন মানুষ যতই আপনজন হোক না কেন স্ত্রী, পুত্র, কন্যাসহ নিকটাত্মীয় ও শুভানুধ্যায়ীরা দ্রুত তাকে কবরস্থ বা দাহ করার আয়োজন সম্পন্ন করে। এ আয়োজনের মধ্য দিয়েই এ পৃথিবী থেকে একজন মানুষের বিদায় ঘটে এবং এমন বিদায়ের পর এ পৃথিবীতে কোনো মানুষ ফিরে আসে না। এরূপ মানুষের প্রতি মৃত্যু-পরবর্তী কেউ কোনো ধরনের বার্তা পৌঁছাতে চাইলে তা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। আর সম্ভব না হলে এ পৃথিবীতে বসবাসকালীন আমরা আমাদের আবাসস্থলকে কী করে স্থায়ী হিসেবে বিবেচনার অবকাশে তা উল্লেখে সদাসর্বদা সচেষ্ট।
আমরা বর্তমানে যারা এ পৃথিবীতে জীবন যাপন করছি, তাদের কারো পিতা-মাতা পরলোকগত, আবার কারো দাদা-দাদী বা নানা-নানী পরলোকগত। এরূপ পিতা-মাতা বা দাদা-দাদী বা নানা-নানীকে তাদের জীবদ্দশায় প্রয়োজনের তাগিদে বিভিন্ন আবেদনপত্রের সাথে হলফনামা বা অঙ্গীকারনামা দিতে হয়েছিল। ওই হলফনামা বা অঙ্গীকারনামায় তারা ঘোষণা করেছিলেন- আবেদনপত্রে তাদের বর্ণিত সব তথ্য সত্য। এখন প্রশ্ন- তাদের বর্ণিত তথ্য সত্য হয়ে থাকলে তারা আবেদনপত্রে যে স্থায়ী ঠিকানার উল্লেখ করেছিলেন, ওই ঠিকানায় তাদের বরাবর কোনো চিঠি পাঠানো হলে তাদের কাছে পৌঁছবে কি না। আর যদি পৌঁছানো না-ই যায়, তবে কেন তাদের দিয়ে তাদের জীবদ্দশায় মিথ্যা বলানো হলো। এ মিথ্যা বলানোর দায় কার?
লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনীতি ও অর্থনীতি বিশ্লেষক
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা