২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

জাতি হিসেবে আমরা ছোট হয়ে যাই

জাতি হিসেবে আমরা ছোট হয়ে যাই - ছবি : নয়া দিগন্ত

বাঙালিদের স্থায়ী আবাসস্থল বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিম বাংলা হলেও বাংলাদেশে বসবাসরত বাঙালিদের জাতীয়তা বাংলাদেশী। অপর দিকে, ভারতের পশ্চিম বাংলায় বসবাসরত বাঙালিদের জাতীয়তা ভারতীয়। বর্তমানে পৃথিবীর সর্বত্রই জাতীয়তা ভূখণ্ডভিত্তিক হয়। ভারত বহুজাতির সমন্বয়ে গঠিত একটি দেশ হলেও সামগ্রিক অর্থে তাদের সবার জাতীয়তা ভারতীয়। পাকিস্তান, যুক্তরাষ্ট্র, চীন প্রভৃতি দেশের ক্ষেত্রেও এটি সমভাবে প্রযোজ্য।

বর্তমানে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশীদের বসবাস রয়েছে। এদের কেউ স্থায়ী নাগরিক হিসেবে পৃথিবীর বিভিন্ন রাষ্ট্রে বসবাস করেন আবার কেউ কাজ বা পেশার তাগিদে অস্থায়ীভাবে বিদেশে বসবাস করেন। ইউরোপের যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, সুইডেন, নরওয়ে, উত্তর আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা, মধ্যপ্রাচ্যের সৌদি আরব, আরব-আমিরাত, কুয়েত, কাতার, ওমান, বাহরাইন, জর্ডান, দক্ষিণ এশিয়ার সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া এবং পূর্ব-এশিয়ার জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ায় উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বাংলাদেশীর বসবাস রয়েছে।

যুক্তরাজ্যে বসবাসরত বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত একটি অংশের দ্বিতীয় হতে চতুর্থ প্রজন্ম তথায় বসবাস করছে। এ ধরনের দ্বিতীয় থেকে চতুর্থ প্রজন্মের অনেক বাংলাদেশী সে দেশের রাজনীতি ও অর্থনীতিতে ব্যাপক ভূমিকা রেখে চলেছেন। যুক্তরাজ্যে বসবাসরত বর্তমানে বাংলাদেশী বংশোদ্ভূতদের দ্বিতীয় থেকে চতুর্থ প্রজন্মের একাধিক ব্যক্তি তথাকার পার্লামেন্টের মেম্বার, বিভিন্ন শহরের মেয়র ও কাউন্সিলর পদে নির্বাচিত হয়ে জাতি হিসেবে বাংলাদেশীদের সুনাম বাড়িয়ে চলেছেন। যুক্তরাজ্যের সরকারের উচ্চপদেও বাংলাদেশী বংশোদ্ভূতরা তাদের মেধা ও যোগ্যতার স্বীকৃতিতে আসন করে নিতে পেরেছেন। কোনো এক সময় খোদ বাংলাদেশেই যুক্তরাজ্যের হাইকমিশনার বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত ছিলেন। যুক্তরাজ্যের মতো যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায়ও বিপুল বাংলাদেশীদের বসবাস। এ দু’টি দেশেও দ্বিতীয় থেকে চতুর্থ প্রজন্মের বাংলাদেশী বংশোদ্ভূতদের বসবাস রয়েছে। বাংলাদেশী বংশোদ্ভূতরা তথাকার অর্থনীতি ও রাজনীতির সাথে সক্রিয়ভাবে সম্পৃক্ত এবং এদের একজন প্রথমোক্ত দেশটির সিনেটর পদে নির্বাচিত হওয়ার গৌরবধারী। অপর একজন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত হিসেবে প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জভুক্ত দেশ ফিজির রাষ্ট্রদূত ছিলেন। তা ছাড়া, উভয় দেশের জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনে বাংলাদেশী বংশোদ্ভূতরা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হয়ে গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের সূচনা করে চলেছেন।

জন্মসূত্রে বাংলাদেশী এমন যারা সে দেশের নাগরিক অথবা বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে বিদেশে বসবাস করছেন, এদের অনেকেই দেশের রাজনীতির সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখেন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে বর্তমানে যে চারটি দলের বড় ধরনের প্রভাব রয়েছে, এ দলগুলো হলো- আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামী। এ চারটি দলের তিনটি দল এককভাবে এবং অপরটি জোটগতভাবে রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিল। পৃথিবীর যে সব দেশে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বাংলাদেশীদের বসবাস রয়েছে, এমন সব দেশে এ চারটি দলের শাখা এবং ক্ষেত্র বিশেষে অঙ্গসংগঠনসমূহের শাখা রয়েছে। এ সব শাখা ও অঙ্গসংগঠনসমূহের শাখাসমূহ বাংলাদেশে দলগুলোর কেন্দ্রীয় কমিটির অনুমোদনপ্রাপ্ত। এমনও দেখা যায়, দু’য়েকটি দেশে একই দলের একাধিক কমিটি থাকায় নিজেদের মধ্যে কলহ, বিবাদ, সহিংসতায় রূপ নিয়ে দেশের মর্যাদাহানির অবকাশ ঘটায়।

বিগত প্রায় চার দশক ধরে দেখা গেছে বাংলাদেশের সরকার প্রধানেরা যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য সফরকালীন বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী ও সমর্থকদের আয়োজিত প্রতিবাদ সমাবেশের মুখে পড়ে বিব্রত ও অবমাননাকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছেন। সচরাচর দেখা যায়, এ ধরনের প্রতিবাদ সমাবেশ সরকার প্রধানদের আগমন পরবর্তী বিমানবন্দরে, তারা যে হোটেলে অবস্থান করেন সে হোটেলের সম্মুখে এবং তারা যে সব স্থানে সমাবেশে মিলিত হন সে সব স্থানের সম্মুখে সংগঠিত হয়ে থাকে। এ ধরনের প্রতিবাদ সমাবেশের কারণে যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র সফরকালীন একাধিক সরকার প্রধানকে নির্ধারিত যাত্রাপথের পরিবর্তে বিকল্প পথ ধরে বিভিন্ন গন্তব্যে পৌঁছাতে দেখা গেছে। কোনো কোনো প্রতিবাদ সমাবেশ থেকে সরকার প্রধানকে লক্ষ্য করে কালো পতাকা প্রদর্শন ছাড়াও জুতা ও পচা ডিম নিক্ষেপের ঘটনা প্রত্যক্ষ করা গেছে। এ সব সমাবেশস্থলে প্রতিবাদ কর্মসূচিতে অংশগ্রহণকারীরা ক্ষমতাসীন সরকার প্রধানের দুঃশাসন ও অপকর্মের চিত্র ব্যানার, ফেস্টুন, প্লেকার্ডের মাধ্যমে তুলে ধরেন। সম্প্রতি দেখা গেছে, বাসের চারপাশে অপশাসন ও দুঃশাসনের বাণীসম্বলিত বার্তার মাধ্যমে অভিনবভাবে প্রতিবাদের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এ বাসটি শহরের বিভিন্ন এলাকা প্রদক্ষিণকালে শহরবাসীদের একটি বড় অংশের এ বার্তা পাঠের মাধ্যমে দেশে যে অস্বাভাবিক কিছু ঘটে চলেছে তার বাস্তবচিত্রের খণ্ডিতাংশ জানার সুযোগ ঘটেছে। এ ধরনের অভিনব ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রতিবাদ বাস কর্তৃপক্ষের জন্য আয়ের একটি বাড়তি সুযোগ করে দিয়েছে।

পৃথিবীর যেসব দেশে ক্ষমতাসীনদের দমন-পীড়নের কারণে বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী ও সমর্থকরা নিজ দেশে সংবিধানস্বীকৃত পন্থায় যেকোনো ধরনের প্রতিবাদ কর্মসূচি আয়োজনে পুলিশ ও দলীয় ক্যাডারদের হাতেঅন্যায়ভাবে বাধাগ্রস্ত হয়ে শারীরিকভাবে প্রহৃত হচ্ছেন অথবা কারান্তরীণে বাধ্য হচ্ছেন, সে সব দেশের নাগরিকদের নিজ নিজ দেশে বৈধ ও গণতান্ত্রিক পন্থায় প্রতিবাদ জানানোর সুযোগ না থাকার কারণেই আজ এ সব দেশের বিদেশে অবস্থানরত নাগরিকেরা যখন তাদের দেশের সরকার প্রধানেরা বিদেশ সফরে যায়, তখন এভাবে প্রতিবাদ জানানোর প্রয়াস নিয়ে থাকেন।

যেসব দেশে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা চালু রয়েছে এবং একটি সরকারের মেয়াদান্তে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনের মাধ্যমে মসৃণভাবে ক্ষমতার পালাবদল ঘটে সে সব দেশের নাগরিকেরা সরকারের কোনো ধরনের কর্মসূচির কারণে বিক্ষুব্ধ হলে তার প্রতিবাদ জানানোর ক্ষেত্রে সরকার কর্তৃক কোনোভাবে বাধার সম্মুখীন হন না। আর এ কারণেই এ সব দেশের সরকার প্রধানরা বিদেশের যেকোনো রাষ্ট্রে সফরে গেলে তথায় বসবাসরত সে দেশের নাগরিকরা তাদের সম্মানে সংবর্ধনার আয়োজন করে। আমাদের দেশের ক্ষেত্রেও ক্ষমতাসীনদের রাজনৈতিক মতাবলম্বীরা বিদেশে অনুরূপ সমাবেশের আয়োজন করলেও তা বিরোধীদের বাধার কারণে অনেক সময় সফলভাবে সম্পন্ন করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। যেকোনো দেশের সরকার প্রধান অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত হয়ে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হলে তাকে সরকার পরিচালনায় দেশ ও সমাজের সব শ্রেণী-পেশার মানুষ সহযোগিতা করে থাকে। আর অস্বচ্ছ ও কলুষতাপূর্ণ নির্বাচনের মাধ্যমে কেউ জোরপূর্বক ক্ষমতাসীন হলে এর ব্যত্যয় ঘটে। এভাবে যারা ক্ষমতায় আসীন হন তারা দেশের অভ্যন্তরে তাদের অপশাসন ও দুঃশাসনের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের প্রতিবাদ কর্মসূচি বরদাস্ত করেন না। এ কারণেই অনেকটা বাধ্য হয়ে দেখা যায় বিদেশের মাটিতে প্রতিবাদের আয়োজন। এ কথাটি অনস্বীকার্য যে, এ ধরনের প্রতিবাদ বিদেশের মাটিতে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ করে এবং দেশের জন্য মর্যাদাহানিকর। এ ধরনের প্রতিবাদ জাতি হিসেবে আমাদের ছোট করলেও উদ্ভূত পরিস্থিতির কারণে দেখা যায়। এর কোনো বিকল্প নেই।

বিদেশের মাটিতে এ ধরনের প্রতিবাদ কর্মসূচি যেনো না হয় তা নিশ্চিত করতে হলে নিজ দেশের অভ্যন্তরে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা এবং বাক ও ব্যক্তিস্বাধীনতার কোনো বিকল্প নেই। যে সব দেশের সরকার প্রধান এটি নিশ্চিতে সফল, তাদের জন্য কখনো বিদেশের মাটিতে বিব্রতকর পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটেনি। সুতরাং, বিদেশের মাটিতে আমাদের কোনো সরকার প্রধানের জন্য যেনো কোনো ধরনের অবমাননাকর ও বিব্রতকর পরিস্থিতির উদ্ভব না ঘটে তা নিশ্চিত করতে হলে তাকে অবশ্যই নিজ দেশে বিরোধীদের সংবিধানস্বীকৃত পন্থায় প্রতিবাদ কর্মসূচি আয়োজনের সুযোগ দেয়াসহ এমন নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে। যাতে গণতান্ত্রিক পরিবেশে সমসুযোগ সম্বলিত মাঠে অবাধ, সুষ্ঠু ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনে জনমতের প্রকৃত প্রতিফলনে সরকার গঠনের মধ্য দিয়ে দেশের শাসনব্যবস্থা পরিচালিত হয়।হ
লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনীতি ও অর্থনীতি বিশ্লেষক)

E-mail: iktederahmed@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement
নোয়াখালীতে প্রবাসীর স্ত্রীর ব্যক্তিগত ছবি দেখিয়ে চাঁদা আদায় দেশের উন্নয়নে পাকিস্তান প্রশংসা করে, অথচ বিরোধী দল দেখে না : কাদের আশুলিয়ায় বাঁশবাগান থেকে নারী পোশাক শ্রমিকের রক্তাক্ত লাশ উদ্ধার মিয়ানমারের কর্মকর্তারা ফেরত গেলেন, কিন্তু রোহিঙ্গা সঙ্কট কি আরো জটিল হচ্ছে দিনাজপুরে দুই ট্রাকের সংঘর্ষ, চালক-হেলপার নিহত মানিকগঞ্জে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ২ সখীপুরে বৃষ্টির জন্য অঝোরে কাঁদলেন মুসল্লিরা দক্ষিণ ভারতে কেন কাজ করেনি বিজেপির হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি জাতীয়তাবাদী ওলামা দলের নতুন আংশিক কমিটি বাংলাদেশের হাসপাতাল ও চিকিৎসায় বিনিয়োগ সম্ভাবনা অন্বেষণে থাইল্যান্ডের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর আহ্বান ট্রাম্পের বিচার নিয়ে বিভক্ত যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্ট

সকল