২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

মেঘ ডাকলেই হাড্ডিসার বুক ধড়ফর করে উঠে মুক্তিযোদ্ধা ছকিন উদ্দিনের

বীরমুক্তিযোদ্ধা ছকিন উদ্দিন - নয়া দিগন্ত

মঙ্গলবার বেলা আড়াইটা। রংপুরের পাগলাপীরের বাজার থেকে বেতগাড়ি যাওয়ার সড়কের পাশে একটি ঘুপচি ঘরের বাইরে প্লাস্টিকের চেয়ারে খাালি গায়ে বসে আছেন অশীতিপর এক বৃদ্ধ। হাতে লাঠি। শরীরের প্রতিটি হাড় দৃশ্যমান। যে কেউ ইচ্ছে করলেই গুনতে পারবেন। চামড়াগুলোও ঝুলে গেছে। মোটরবাইক থেকে নেমে তার সাথে কথা বলতেই হাত পা ঠান্ডা হয়ে যাওয়ার উপক্রম। জানার আগ্রহটাও থমকে গেলো। তার নাম ছকিন উদ্দিন। বয়স ৭২। তিনি মহান মুক্তিযুদ্বের রণাঙ্গনের সম্মুখ সমরে অংশ নেয়া এক অকুতভয় সাহসি বীরমুক্তিযোদ্ধা। আলাপচারিতায় উঠে আসলো তার যাপিত জীবনের বর্ণনাতীত বাস্তবতার গা শিউরে ওঠা গল্প। তার সম্বল বলতে রাস্তার পাশের ২ শতক জমি। তারও হাফ শতক দখল করে নিয়ে টেইলার্সের দোকান দিয়েছেন একজন। বাকি দেড় শতকের মধ্যে তিনটি টিনের ঘর ওঠানো। একটি পশ্চিম-পুর্ব দুয়ারী। আর দুটি উত্তর-দক্ষিণ দুয়ারি। এরই মাঝে উঠান বলতে কোনমতে বাড়িটিতে প্রবেশ করা যায়। পশ্চিম-পুর্ব দুয়ারী ঘরটির বেড়া নেই। মাটি ভরাটের কাজ চলছে। ওই ঘরটিতেই একটি কদম গাছের চৌকিতে থাকেন বীরমুক্তিযোদ্ধা ছকিন উদ্দিন। খাটে কোন তোষক নেই। কভার বিহীন বালিশ আর ছেড়া কাথা। আকাশে মেঘ ডাকলেই ধড়ফর করে বুক। বৃষ্টি ঝড়লেই ভিজে যায় খাট। ঝড় বাতাস উঠলে আল্লাহর কাছে দু হাত তোলে ফরিয়াদ করেন। কখন যেন নড়েবড়ে ঘর ভেঙ্গে যায়, উড়ে যায়, তছনছ হয়ে যায় সব কিছু। সুষম খাদ্যের অভাবে চেহারা শীর্ণকায়। শরীরের চামড়া ছাপিয়ে প্রতিটি হাড় স্পস্ট হয়ে উঠেছে। লাঠিতে ভর করে অন্যের সহযোগিতায় চলাফেরা নাওয়া খাওয়া করেন তিনি। কাজ করার সামর্থ নেই। আয় বলতে সরকারের দেয়া ১০ হাজার টাকার ভাতা। সেই টাকার অর্ধেক যায় প্রতি মাসে ওষুধ কিনতে। বাকি টাকায় চালাতে হয় সংসার। বর্তমানে স্বামী পরিত্যাক্তা মেয়ে, দুই নাতি নাতনি ও স্ত্রী সমেত পাঁচজন মিলে এক অন্নে খান। ঠিক কতদিন আগে গোশত খেয়েছেন তিনি স্মরণ করতে পারলেন না। অভাবের সংসারে ছেলে মেয়েদের পড়ালেখা করাতে পারেননি। মেট্রিক পাশ বড় ছেলের জন্য পিয়নের চাকরির চেষ্টা করেছিলেন। কিন্ত দেড় লাখ টাকার দাবি ছিল। কোথায় পাবেন সেই টাকা? তাই আর এগুতে পারেননি। দেশের জন্য সংগ্রামে জীবনবাজি রেখে তিনি লড়েছেন-জিতেছেনও, সেই তিনিই এখন নিজের জীবন সংগ্রামে হেরে ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যুর প্রহর গুনছেন। জীবনের পড়ন্ত বেলায় এসে ভালো খাবার না জুটুক অন্তত: একটু ভালো থাকার ঘর আর বিছানা খুবই দরকার এই মুক্তিযোদ্ধার-ফিল করেন তিনি। এর বেশি কিছু চাওয়া নেই তার।
বীরমুক্তিযোদ্ধা ছকিন উদ্দিন রংপুর সদর উপজেলার গোকলপুর ধনীপাড়া গ্রামের তছির উদ্দিনের পুত্র। এখন বয়স ৭২ এর উপরে। মুক্তিযোদ্ধা সনদ ক্রমিং নং ১৩৮৩৪। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রিয় কমান্ড কাউন্সিল চেয়ারম্যান আব্দুল আহাদ চৌধুরী স্বাক্ষরিত ওই সনদ ইস্যুর তারিখ ২৯ জুলাই ১৯৯৯। ছকিন উদ্দিন জানালেন, ১৯৭১ সালে আমার বয়স ২০ এর মতো। দেশে যুদ্ধের ডামাডোল। দেশকে স্বাধীন করার স্পৃহা জাগলো আমার মনে। বাড়িতে বললে হয়তো বাবা-মা আটকাতে পারে। সেজন্য না জানিয়েই মুক্তিযুদ্ধে নাম লেখাই। লালমনিরহাটের কালিগঞ্জের সিতাই হয়ে ভারতে গিয়ে ট্রেনিং নিয়ে ৬ নং সেক্টরে যুদ্ধ করি। একাধিক জায়গায় শত্রুর সাথে গোলাগুলিতে অংশ নেই। দেশ স্বাধীনের হওয়ার পর ফিরলাম বাড়ি। বাড়ি আসার ৭ বছর পর বিয়ে করলাম। দুই ছেলে দুই মেয়ের বাবাও হলাম। জমি জমা না দিন মজুর হিসেবে কাজ করেই সংসার চালাতে থাকি। এরই মধ্যে আমার শরীরে নানা রোগ বাঁধে। কাজ করার সক্ষমতা হারিয়ে ফেলি।
মুক্তিযোদ্ধা ছকিন উদ্দিন বলেন, সংসার চালাতে হিমশিম খেতে খেতে বউ-বাচ্চা নিযে যাই রাজশাহীতে। সেখানে একটানা ১৮ বছর থাকি। স্ত্রী রিনা বেগম (৫৫) একটি ক্যাডেট কোচিংয়ে রাধুনির কাজ করেন আর আমি রিকশা চালাই। এভাবে চলতে থাকে সংসার। রাজশাহীতে কাজ করেই মেয়েদের বিয়ে দেই। ছেলেরা বিয়ে করে সংসারি হয়। আমার রিকশা চালানোর ক্ষমতাও হারিয়ে যায়।
ছকিন উদ্দিন বলেন, এরই মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মুক্তিযোদ্ধা ভাতা ১০ হাজার করলেন। তখন আবার বাড়িতে ফিরে আসি। রাজশাহী থেকে টাকা জোগার করেই দুই মেয়েকে বিয়ে দেই। এরমধ্যে বড় মেয়ে শিউলিকে স্বামী ছেড়ে দেয়। অনেক চেষ্টা করেও সংসার টেকাতে পারিনি। স্বামী পরিত্যাক্তা হয়ে শিউলি তার ছেলে শিবলু ও মেয়ে ঈশিতাকে নিয়ে আমার সংসারে এসে উঠে। এখন পাঁচজনের সংসার। প্রতি মাসে ৫ হাজার টাকারও বেশি ওষুধ কিনতে হয়। বাকি টাকা দিয়ে কোনমতে এক বেলা আধাবেলা খেয়ে বেঁচে আছি। ছেলেদের পড়া লেখা করাতে পারিনি। দুই ছেলের মধ্যে রেজাউল খরির (গাছ) ব্যবসা করে। অপর ছেলে মিস্টার আলী শশুড় বাড়িতে থাকে। সেখানে রিকশা চালায় সে। আরেক মেয়ে সাইবুদা স্বামীর সাথে সংসার করছে। অটোভ্যান চালিয়ে সংসার চলে তাদের।
মুক্তিযোদ্ধা ছকিন উদ্দিন বলেন, বড় ছেলের জন্য দারোয়ানের চাকরির চেষ্টা করেছিলাম। রাজশাহী, ঢাকা অনেক দৌঁড়াদৌড়ি করেছি। কিন্তু কোন কাজ হয়নি। যাদের মাধ্যমে দৌঁড়াদৌঁড়ি করেছি তারা দেড় লাখ টাকা চেয়েছিল। কিন্তু টাকা ম্যানেজ করতে পারিনি। তাই চাকরিও হয়নি।
ছকিন উদ্দিন জানান, আমার এখন থাকা খাওয়ার খুব সমস্যা। পৈত্রিক সুত্রে পাওয়া ২ শতক জমিই আমার একমাত্র সম্বল। তারও হাফ শতকের মতো টেইলার্স মালিক দখল করে নিয়েছে। আমিন এনে মাপ-জোক করার পরেও তারা দখল ছাড়েনি। এখন দেড় শতক জমিতে কোনমতে তিনটি টিনের ঘর করেছি। একটি চালা ঘরের মধ্যে বড় ছেলে তার বউ ও ছেলেমেয়েদের নিয়ে থাকে। একটিতে আমার স্ত্রী এবং স্বামী পরিত্যাক্তা মেয়ে, মেয়ের ছেলেমেয়েসহ খুব কষ্ট করে থাকি। আরেকটি ঘর উঠানোর চেষ্টা করছি। এখনও বেড়া দিতে পারিনি। ওই বেড়া না থাকা ঘরেই আমি থাকি। বৃষ্টি আসলেই পানি পড়ে। ঝড় উঠলে ঘর দোলাদুলি করে। আল্লাহর কাছে দুই হাত তুলে ফরিয়াদ করি। যেন ঘর ভেঙ্গে না যায়, চালা উড়ে না যায়। তাহলে খোলা আকাশের নীচে থাকতে হবে।
এই মুক্তিযোদ্ধার ছবি তুলতে চাইলে তিনি একটি নাতনির ওড়না আনতে বললেন। তা দিয়ে হাড্ডিসার শরীর ঢেকে তবেই ছবি তুলতে দিলেন। যাতে হাড্ডিসার শরীর মিডিয়ায় না আসে।
মুক্তিযোদ্ধা ছকিন উদ্দিনের স্ত্রী রিনা বেগম জানান, থাকার ঘরের অবস্থা তোমরা তো দেইখলেন। ঝড়ি আইসলেই ধোর ধোর করি ওসসে। ঝড়-বাতাস আইসলে কইলজা উড়ি যায় বাবা। ঘর কোনা যদি বাতাসোত পরি যায় সখন কই থাইকমো। হামার ওমরা আইতোত নিন্দ পাইরবার পায় না। এখন ওমাক একনা ভালো খিলা দরকার। সেটা ফির কই পাই। যেকনা ট্যাকা সরকার হামাক দেয় সেইকনা দিয়া ওষুধ কিনি আর চাউল কিনি। গোছ-মাছ আইনবার কোন বুদ্দি নাই। হামার মনে পরে না কোন দিন গোছ মাছ খাইছি।
কথা বলতে বলতে রিনা বেগমের চোখ পানিতে টলমল। তিনি আরও বলেন, আল্লাহ হামারগুলাক ক্যান যে বাঁচি রাইখছে। বড় মেয়ে কোনার কপাল খারাপ। খুব কস্ট করি আজশাহীত কোচিংয়োত ভাত আন্দিয়া ট্যাকা জোগার করি বড় বেটিক বিয়া দিনো। দুইকনা আজা-আনির মতো ছইলও হইলো। এখন জামাই বেটিক ছাড়ি দিল। এখন ওগলাই কি ফ্যালো দেমো। বেটি-নাতি নাতনিকো বাড়িত নিয়া আইসনো। একনা ঘরোত ৫ জন মিলি কোনমতে থাকি। আরেকনা ঘরোত উপর টিন দিচি। এ্যলাও বেড়া দিবার পাই না।
রিনা বেগম বলেন, হামার গুলার কেউ নাই যে একনা সাহায্য কইরে। ওমরা তো অচল হয়া গেইচে। বাইরোত বাইর হবার পায় না। অফিসোতও যাবার পায় না। কারো কাছোত হাতও পাইতপার পায় না। হামরা শুনছি শেখ হাসিনা নাকি মুক্তিযোদ্ধার ছাওয়া-পোয়াক (ছেলে-মেয়ে) সরকারি চাকরি দ্যায়। বুড়া মানুষটার দিকি দেখিয়া শেখ হাসিনা যদি মোর বেটি আর ব্যাটার জন্য কিছু করি দিল হয়। তাহলে বুড়া মানুষটা মরিয়াও শান্তি পাইল হয়।
স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান ইকবাল হোসেন জানান, মুক্তিযোদ্ধা ছকিন উদ্দিনের পরিবারের করুনদশা। এ বিষয়ে অনেকেই আমরা তাকে ব্যক্তিগত সহযোগিতা করছি। তার বাড়ি এবং ছেলেমেয়েদের কারো চাকরির ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।
এ ব্যপারে রংপুর জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা মোসাদ্দেক হোসেন বাবলু জানান, তিনি নিয়মিত মুক্তিযোদ্ধা ভাতা পেয়ে আসছেন। তার পরিবারের এই জীর্ণ দশাটি আমাদের জানা ছিল না। আশা করি মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয় তার জন্য ভালো থাকার ব্যবস্থা ও ছেলে মেয়ের জন্য কমংসংস্থানের ব্যবস্থা করে দিবেন। এজন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ আমরা নেবো।


আরো সংবাদ



premium cement
দক্ষিণ ভারতে কেন কাজ করেনি বিজেপির হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি জাতীয়তাবাদী ওলামা দলের নতুন আংশিক কমিটি বাংলাদেশের হাসপাতাল ও চিকিৎসায় বিনিয়োগ সম্ভাবনা অন্বেষণে থাইল্যান্ডের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর আহ্বান ট্রাম্পের বিচার নিয়ে বিভক্ত যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্ট চুয়েট শিক্ষার্থীদের আন্দোলন স্থগিত, ক্লাসে ফেরার সিদ্ধান্ত আমদানি ব্যয় কমাতে দক্ষিণাঞ্চলের সূর্যমুখী তেলের আবাদ পাকুন্দিয়ায় গানের আসরে মারামারি, কলেজছাত্র নিহত আবারো হার পাকিস্তানের, শেষ সিরিজ জয়ের স্বপ্ন পাটকেলঘাটায় অগ্নিকাণ্ডে ৩ দোকান পুড়ে ছাই ৪৬তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষা শুরু দোয়ারাবাজারে পরকীয়া সন্দেহে স্ত্রীকে হত্যা : স্বামীর আমৃত্যু কারাদণ্ড

সকল