যে সব জিনিস বা বস্তুর ওপর আমাদের বেঁচে থাকা নির্ভর করে, যেমনÑ শ্বাস নেয়ার জন্য অক্সিজেন বা দূষণমুক্ত বাতাস ও অক্সিজেন সমৃদ্ধ বাতাসের জন্য বনভূমি, দৈহিক গঠন ও সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য খাদ্য গ্রহণ এবং তা উৎপাদনের জন্য উর্বর মটি ও পানির উৎস-খাল-বিল, নদ-নদী, পাহাড়, পর্বত সব মিলিয়েই সংজ্ঞায়িত করা হচ্ছে পরিবেশ। মানুষসহ প্রাণিকুলের জীবন-জীবিকা তত দিন চলবে, যত দিন পরিবেশ তার বৈশিষ্ট্য নিয়ে অটুট থাকবে। অবাক বিষয় হচ্ছে, বিজ্ঞানীরা বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করে দেখেছেনÑ মানুষই পরিবেশ নষ্ট করার জন্য প্রধানত দায়ী। পরিবেশের ভারসাম্য হারিয়ে গেলে বৈশ্বিক উষ্ণতা (এষড়নধষ ডধৎসরহম) বৃদ্ধি পায়; ফলে ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, খরা, অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি, এসিডবৃষ্টিসহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের সৃষ্টি হয়Ñ যা আমাদের প্রাণ প্রকৃতির জন্য মহাবিপর্যয় ডেকে আনে। পরিবেশ দূষণমুক্ত রাখা মানেই আমাদের জান-মাল রক্ষা করা। পরিবেশের অন্তর্ভুক্ত সব বস্তু বা উপাদান মহান আল্লাহ পাকের সৃষ্টি। মানুষের জীবন-জীবিকার তাগিদে সর্বোপরি আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে পরিবেশ রক্ষণাবেক্ষণের ক্ষেত্রে মানুষেরই থাকতে হবে কার্যকর ভূমিকা। পৃথিবীর আলো-বাতাস, ভূমি, পানি, উদ্ভিদ, পশুপাখির কার্যকারিতা ও সৌন্দর্য রক্ষায় এখনই সর্বোচ্চ সতকর্তা অবলম্বল করতে হবে। অন্যথায় সবকিছু ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। বর্তমান প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিলে এটি অত্যন্ত পরিষ্কার যে, পরিবেশ দূষণের কবলে পড়ে সমগ্র পৃথিবী ঝুঁকির সম্মুখীন। মানব জাতি পড়েছে অস্তিত্ব সঙ্কটে।
বিজ্ঞান-প্রযুক্তির উন্নয়ন এবং বিশ্বজুড়ে শিল্পকারখানা স্থাপনের প্রতিযোগিতার কারণে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন বৃদ্ধি পাচ্ছে। পৃথিবীর ২৩০টির মতো দেশ অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী হওয়ার লক্ষ্যে ব্যাপক শিল্পায়ন ঘটিয়েছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, বন কেটে উজাড়, নদ-নদী জলাশয় ভরাট ও পাহাড় সমতল করে বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ তথা শিল্পাঞ্চল গড়ে তোলার ফলে জলবায়ু সঙ্কটের সৃষ্টি করে চলেছে। শিল্পকারখানা ও যানবাহনের জ্বালানি, ইটভাটা সর্বোপরি বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে জীবাশ্ম জ্বালানির নির্গত বিষাক্ত গ্যাস বা কার্বন-ডাই-অক্সাইড পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বাড়িয়ে চলেছে। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন বৃদ্ধির আরেকটি কারণ হচ্ছে অতিরিক্ত ক্লোরোফ্লোরোকার্বন ঈঋঈ ব্যবহার, এটি ওজন স্তর (ঙুড়হব খধুবৎ) বিনষ্ট করছে। বনাঞ্চল ধ্বংস করে নগরায়ন ও শিল্পায়ন বায়ুণ্ডলের কার্বন-ডাই-অক্সাইড শুষে নেয়ার ক্ষমতা বহুলাংশে কমিয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশে গড়ে প্রতিদিন এক লাখ ৩০ হাজার বৃক্ষ নিধন হচ্ছে অথচ রোপণের (ওসঢ়ষধহঃধঃরড়হ) হার মাত্র ৩০ হাজার। আমাজন (অসধুড়হ জধরহভড়ৎবংঃ) বনভূমি বিশ্বের ২০ শতাংশ কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষণ করে এবং ২০ শতাংশ অক্সিজেনের জোগান দেয়। কিন্তু বিশ্বে যে হারে বনভূমি ধ্বংসের কর্মকাণ্ড পরিলক্ষিত হচ্ছে, তাতে বোঝা যায়Ñ এক মহাবিপদ আমাদের নিকটবর্তী। জাতিসঙ্ঘের তথ্য মতে, গত এক দশকে বিশ্বের প্রায় এক কোটি ৭০ লাখ হেক্টর বনভূমি বিলুপ্ত হয়ে গেছে। অর্থাৎ প্রতি মিনিটে প্রায় আট হেক্টর বনভূমি ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। পৃথিবীর তাপমাত্রা দ্রুত বৃদ্ধি পাওয়ায় মেরু অঞ্চলে বরফ গলে নাব্যতা বাড়িয়ে দিয়েছে। হুমকিতে রয়েছে উপকূলীয় অঞ্চলগুলো। একটি গবেষণায় দেখা যায়, আগামী ১০০ বছরের কাছাকাছি সময়ে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা প্রায় ১০০ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পাবে। তাতে বাংলাদেশের স্থলসীমার ২২ হাজার ১০০ থেকে ২৬ হাজার ৫০০ বা ততোধিক বর্গকিলোমিটার পানির নিচে চলে যেতে পারে।
দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়ায় দেশের প্রথম কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উপাদন কেন্দ্র চালু হওয়ার পর কেন্দ্রটির কয়লার ছাই পড়ে কূপ ও সেচের পানির উৎস দূষিত করেছে। পুকুরের পানিতে অতিমাত্রার ভারী বিষাক্ত ধাতু পাওয়া গেছে। খাওয়ার পানিতে ৩৫ থেকে ৪০ গুণ বেশি মাত্রার সিসাÑ যা বিশ্বব্যাংক নির্ধারিত সুপেয় পানির মান অনুযায়ী আতঙ্কের বিষয়। কিন্তু তার চেয়েও বড় আতঙ্কের বিষয়, সরকারি নীতি অনুসারে ২০৩১ সাল নাগাদ যদি আরো ২৯টি কয়লাচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু হয়, তাহলে সর্বমোট ৩০টি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বছরে ১১.৫ কোটি টন কার্বন-ডাই-অক্সাইড উৎপন্ন করবে, যার বিরূপ প্রভাবে পরিবেশের ওপর নেমে আসবে এক মহাবিপর্যয়। নভেম্বরের ৮ তারিখ দৈনিক নয়া দিগন্ত সম্পাদকীয়তে লিখেছেÑ ৩০টি বিদ্যুৎ কারখানায় কয়লার ব্যবহার ‘বাংলাদেশের জন্য কার্বন বোমা’, যে রিপোর্টের উদ্ধৃতি দিয়ে উপরোক্ত মন্তব্য করা হয়েছে, তার শিরোনাম হচ্ছেÑ ‘ঈযড়শবফ নু ঈড়ধষ : ঞযব ঈধৎনড়হ ঈধঃধংঃৎড়ঢ়যব রহ ইধহমষধফবংয’ শিরোনামই বলে দিচ্ছেÑ কার্বন-ডাই-অক্সাইড নির্গমনের ফলে আমাদের কত বড় সর্বনাশ হতে পারে। এ ধরনের ভয়াবহতা উপলব্ধি করে ভারতসহ পৃথিবীর বহু দেশ জবহবধিনষব ঊহবৎমু-কেই প্রাধান্য দিচ্ছে। ভারতের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বলছে, ২০২২ সাল নাগাদ সৌর, বায়ু ও বায়োগ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে এক লাখ ৭৫ হাজার মেগাওয়াট। সাশ্রয়ী, পরিবেশবান্ধব জ্বালানির দিকে নজর না দিয়ে আমাদের সরকার কেন যে পারমাণবিক ও কয়লানির্ভর বিদ্যুৎ উৎপাদনে আগ্রহী হলো তা জনগণের কাছে স্পষ্ট নয়। ২০১০ সালে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রাথমিক বাজেট ছিল যেখানে ৩২ হাজার কোটি টাকা, ২০১৯ সালে এসে তা বৃদ্ধি পেয়ে এক লাখ ১৮ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। এ সংখ্যা বাংলাদেশের মোট জাতীয় বাজেটের এক-পঞ্চমাংশ। সবচেয়ে আফসোসের বিষয় হলোÑ জাতীয় সক্ষমতা বৃদ্ধি ও দেশের তেল, গ্যাস বা খনিজ সম্পদ অনুসন্ধানে রাষ্ট্রীয় নীতিমালা যেমন অনুকূল নয় তেমনি বরাদ্দও অপ্রতুল।
২০১৯ সালের ২২ জুন মুক্তি ভবন ‘প্রগতি সম্মেলন কক্ষে’ অনুষ্ঠিত পর্যালোচনা সভায় তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ তাঁর লিখিত বক্তব্যে বলেন, ‘রামপাল’ প্রকল্প নিয়ে সরকার জনগণের কাছে মিথ্যা প্রচারণা চালাচ্ছে, ইউনেস্কোকে দেয়া বিশ্ব ঐতিহ্য রক্ষার অঙ্গীকার ভঙ্গ করে বিশ্ববাসীর কাছে বাংলাদেশকে হেয় করেছে। সরকারের এই ভূমিকায় এক দিকে বাংলাদেশ অরক্ষিত হচ্ছে, অন্য দিকে সুন্দরবন তার বিশ্ব ঐতিহ্যের মর্যাদা হারাতে বসেছে।’ গত ৯ নভেম্বর মধ্যরাতে ঘূর্ণিঝড় ‘বুলবুল’ যে পরিমাণ শক্তি নিয়ে উপকূলে আঘাত হানার আশঙ্কা ছিল, সুন্দরবনের কারণে বাংলাদেশসমূহ ক্ষতি থেকে রক্ষা পেয়েছে, এমনই মন্তব্য করে বিশিষ্টজনরা বলেছেন, সরকারের প্রাণ প্রকৃতি বিনাশী প্রকল্প বন্ধ করা উচিত। আল্লাহ তায়ালার সৃষ্টি সুন্দরবন ও অন্যান্য বনভূমি দেশের মানুষের ঢালস্বরূপ, তা রক্ষা করা মানে জাতিকেই রক্ষা করা। হ
লেখক : রাজনীতিক, প্রাবন্ধিক
ঊ-সধরষ: ংধুবফুঁষশধৎহধরহ@ুধযড়ড়.পড়স
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা