০৪ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`


স্ম র ণ : স্মৃতিতে ভাস্বর সাংবাদিক শামছুর রহমান

-

আজ ১৬ জুলাই ২০১৮। আমাদের সাংবাদিক সমাজের কাছে, বিশেষত যশোরবাসীর জন্য একটি বড় শোকের দিন। ১৮ বছর আগে, ২০০০ সালের এ দিনেই আমরা হারিয়েছি, সাংবাদিক জগতের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র কলমসৈনিক সাংবাদিক শামছুর রহমানকে।
প্রতি বছর দিনটি আসার আগে থেকেই খুবই মনোকষ্ট পাই, নিজেকে অনেকটা অপরাধী মনে হয় এই কারণে যে, তাকে কেন এ পেশায় এনেছিলাম? সাংবাদিকতায় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে কেন সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছিলাম? তা না হলে এভাবে হয়তো তাকে অকালে প্রাণ দিতে হতো না। তার মমতাময়ী মা হারাতেন না নাড়ি ছেঁড়া ধনকে। তার প্রিয়তমা স্ত্রী এত অল্প বয়সে বিধবা হতো না। তার কলিজার টুকরো দুই মেয়ে হতো না এতিম। আর আমরাও হারাতাম না এমন একজন সম্ভাবনাময় ও প্রতিভাবান সাংবাদিককে।
শহীদ সাংবাদিক শামছুর রহমান দুর্নীতিবাজ, চোরাচালানিসহ ভয়ঙ্কর অপরাধী ও তাদের গডফাদারদের কাছে ছিল আতঙ্ক। সে তার বলিষ্ঠ লেখনীর মাধ্যমে দৈনিক বাংলা, সাপ্তাহিক বিচিত্রা ও জনকণ্ঠ পত্রিকার পাতায় বিভিন্ন অপরাধ ও অপরাধীদের ওপর সচিত্র প্রতিবেদন এবং তাদের কুকীর্তির কথা তুলে ধরেছিল। বারবার টেলিফোনে হুমকি আসতে থাকে তার এই লেখনী থামানোর জন্য। কিন্তু এই সাহসী সাংবাদিক আরো দুর্বার গতিতে চালাতে থাকে লেখনী। এতে স্বার্থান্বেষী মহল লিপ্ত হয় গভীর ষড়যন্ত্রে। অবশেষে তারা পথের কাঁটা চিরতরে সরিয়ে দেয়ার পথ বেছে নেয়। হায়েনাদের তপ্ত বুলেটের আঘাতে, সে নিজের চেম্বারে চিরতরে হারিয়ে যায় আমাদের মাঝ থেকে। সে ডাকনাম ‘কেবল’ হিসেবে সুপরিচিত ছিল।
তাকে নিয়ে রয়েছে আমার অনেক স্মৃতি। আমার কর্মজীবনের একটি শ্রেষ্ঠ কর্ম হচ্ছে এই মেধাবী সাংবাদিককে আবিষ্কার। তার আবির্ভাব অনেকটা ধূমকেতুর মতো। ১৯৮০ থেকে ২০০০ সাল মাত্র ২০ বছর; খুবই অল্পসময়। কিন্তু এ স্বল্প সময়ের মধ্যে আমাদের সমাজ ও দেশকে সে দিয়েছে অনেক কিছু।
১৯৮০ সাল। যশোর প্রেস কাবের পুরাতন ভবন থেকে আবুল হোসেন মীরের সম্পাদনায় দৈনিক ঠিকানা পত্রিকা বের হতো। যশোরে আজকে যারা প্রতিষ্ঠিত সাংবাদিক, তাদের অনেকেরই হাতে খড়ি এই পত্রিকায়। আমি তখন একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকার যশোর সংবাদদাতা। অধ্যাপনার পাশাপাশি ছিল সাংবাদিকতার নেশা। দৈনিক ঠিকানায় খণ্ডকালীন দায়িত্ব পালন করতাম ফিচার এডিটর হিসেবে।
একদিন দুপুরে এই পত্রিকা অফিসের ডেস্কে বসে আছি। ২০-২২ বছর বয়সী এক তরুণ যার গায়ের রঙ উজ্জ্বল শ্যামলা, এসে খুবই বিনয়ের সাথে আমার সামনে বসার অনুমতি চাইল। জানাল, সে যশোর এমএম কলেজের ছাত্র। বলল, ‘আপনাদের পত্রিকায় শার্শা এলাকার বিভিন্ন সমস্যার কথা ছাপাতে চাই।’ সানন্দে তার প্রস্তাবে সাড়া দিলাম। এরপর সে নিয়মিত সংবাদ পাঠাতে থাকে। মাস খানেক পর একদিন আমাকে আবদার জানালোÑ আমাদের এলাকার একটি জনগুরুত্বপূর্ণ সংবাদ সংগ্রহের জন্যে আপনাকে যেতে হবে। নির্ধারিত দিন ও সময়ে হাজির হলাম শার্শা বাসস্ট্যান্ডে। হেঁটে হেঁটে বাস্তব অবস্থা পর্যবেক্ষণ করলাম। পরদিন দৈনিক ঠিকানার লিড নিউজ ছাপা হলো। শিরোনাম ছিল ‘দাদখালি বামনার বিল প্রকল্পটি আজ ব্যর্থতার পর্যবসিত হতে চলেছে।’ খবরটি খুবই সাড়া জাগিয়েছিল।
এভাবে সাংবাদিকতা ও সংবাদ আদান-প্রদানের মাধ্যমেই কেবলের সাথে নিবিড় ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠে। সময় পেলেই সে আমার সাথে সৌজন্য সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে পত্রিকা অফিসে চলে আসত।
তার মধ্যে আমি খুঁজে পেয়েছিলাম ছাইচাপা আগুনের জ্বলন্ত স্ফুলিঙ্গ। তাকে শার্শা প্রতিনিধি হিসেবে নেয়ার ব্যাপারে আমার প্রস্তাবে সবাই একমত পোষণ করলেন। পত্রিকার মধ্যেই আমরা খুঁজে পেয়েছিলাম তার সত্যিকারের ঠিকানা।
৮০ দশকে যশোরে ছিল সাংবাদিক সঙ্কট। আমার একটা কাজ ছিল ঢাকার পত্রিকার জন্য নতুন নতুন সাংবাদিক সৃষ্টি করা। শামছুর রহমান কেবলকে নিয়ে আমার স্বপ্ন, তাকে কিভাবে জাতীয় পত্রিকায় সাংবাদিক হিসেবে আমাদের সাথী করা যায়। আমি তখন দৈনিক বাংলার বাণীর যশোর প্রতিনিধি। ওই সময় ঢাকায় দৈনিক বাংলার মফস্বল সম্পাদক ছিলেন শামছুল আলম। বাংলাদেশ সাংবাদিক সমিতির সভাপতি ও দৈনিক বাংলার মুন্সীগঞ্জ প্রতিনিধি ছিলেন সফিউদ্দীন আহমেদ। আমি ছিলাম সাংবাদিক সমিতির যশোর জেলা সম্পাদক। সফি ভাইয়ের সাথে দৈনিক বাংলা অফিসে যাতায়াতের মাধ্যমে মফম্বল সম্পাদক শামসুল আলমের সাথে আমার পরিচয় ও নিবিড় সম্পর্ক গড়ে উঠে। ওই সময় যশোর সেনানিবাসের বিশেষ শাখার দায়িত্বে ছিলেন কর্নেল মাসুদ। এ ছাড়াও ছিলেন ব্রিগেডিয়ার এম এ মঞ্জুর; তারা শামসুল আলমের নিকটাত্মীয়। তাদের সাথেও ছিল আমার ঘনিষ্ঠতা।
যতবার ঢাকায় বাংলার বাণী অফিসে গিয়েছি আলম ভাইয়ের সাক্ষাৎ না করে ফিরতাম না। বাংলার বাণী পত্রিকা বন্ধ হলে চলে যাই অন্য পত্রিকায়। কিন্তু শামসুল আলম ভাইয়ের সাথে সম্পর্কটা বজায় থাকে। দৈনিক বাংলার আলী আশরাফ, হাসিনা আশরাফ, মঞ্জুর আহমেদ, শুভ রহমান, আবদুল হাই শিকদারÑ এদের সাথেও ছিল ঘনিষ্ঠতা।
ওই সময় দেবব্রত সিংহ ছিলেন দৈনিক বাংলার যশোর সংবাদদাতা। আইন পেশার পাশাপাশি সাংবাদিকতাও করতেন। পেশাগত কাজে খুবই বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়ায় সাংবাদিকতা পেশায় সময় বেশি দিতে পারছিলেন না। এ অবস্থায় শামসুল আলম ভাইকে একান্তভাবে বললামÑ কেবলকে আপনার পত্রিকায় স্থান করে দিতে হবে। তিনি বললেন, নড়াইলে আমাদের প্রতিনিধি নেই। যশোরে বসে নড়াইল কভার করা সম্ভব নয়। তার বদলে প্রস্তাব করলাম তাকে নওয়াপাড়া সংবাদদাতা করতে। নওয়াপাড়া প্রতিনিধি আবশ্যক মর্মে একটি বিজ্ঞাপন ছাপার ব্যবস্থা করা হলো। নওয়াপাড়া ডেট লাইনে ১০-১২টি সংবাদ দৈনিক বাংলার পাতায় ছাপা হওয়ার পর কেবলকে পেপার কাটিংসহ আবেদন করতে বলি। ইতোমধ্যে দেবব্রত সিংহ স্বেচ্ছায় পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন।
পরবর্তীকালে কেবল তার নিজ প্রতিভা ও নিষ্ঠার সাথে দৈনিক বাংলা পত্রিকায় দায়িত্ব পালন করেছে। নিজ পেশার প্রতি ছিল খুবই যতœবান ও আন্তরিক। ফলে দ্রুত দৈনিক বাংলা পত্রিকায় বিশেষ স্থান করে নিতে সক্ষম হয়। দৈনিক বাংলার সম্পাদক আহমেদ হুমায়ূন তাকে খুবই ¯েœহ করতেন। দৈনিক বাংলায় স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে তাকে নিয়োগ দেয়া হয়।
জ্ঞানার্জন করতে হলে বেশি করে বই পড়তে হবে। লিখতে গেলেও পড়তে হবে। আমার ফ্যাটের সামনা সামনি কেবলের ফ্যাট। গভীর রাত পর্যন্ত আলো জ্বেলে পড়ালেখায় মগ্ন থাকতে দেখতাম তাকে। রাতে যতবার ঘুম ভাঙত জানালায় তাকিয়ে দেখতাম, সে পড়ালেখা করছে। তার প্রতি আমার স্নেহ ছিল খুবই প্রবল। ওর পত্রিকায় ভালো কভারেজ চোখে পড়লেই তাকে আরো উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা দিতাম। ঘনিষ্ঠ মহলের মাধ্যমে বারবার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করত। ভারত ও চীন সফরের সুযোগ হয়েছে তার। ভারতের মতো একটি বিরাট দেশে নির্বাচনী খবর সংগ্রহে দৈনিক জনকণ্ঠ থেকে অ্যাসাইনমেন্ট দেয়া হয় তাকে। অত্যন্ত দক্ষতার সাথে সে দায়িত্ব পালন করেছিল এবং তার পত্রিকায় ভারত থেকে পাঠানো খবর প্রথম পৃষ্ঠার নিয়মিত কভারেজ পায়। সে যখন দস্যু ফুলন দেবী নির্বাচনী এলাকায়, ফুলন জানতে পারে, বাংলাদেশের একজন সাংবাদিক তার নির্বাচনী এলাকার খবর সংগ্রহের দায়িত্ব নিয়ে এসেছেন। মাইকে ঘোষণা করা হলো, সভাশেষে তার সাথে দেখা করার জন্য। রাতে তার বাসভবনে নৈশভোজের আমন্ত্রণ জানানো হলো এই সাংবাদিককে। ফুলন দেবী তাকে যে সম্মান দেখিয়েছে সে কথা সবিস্তারে আমাকে বলেছে। এরপর চীন সফরে সেখানকার বিভিন্ন সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা, কালচার প্রভৃতি বিষয়ক অভিজ্ঞতা কেবল আমাকে জানায়।
নিজ এলাকার মানুষের প্রতি তার ছিল খুবই দরদ। বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে তার অফিসে কেউ দেখা করলে খুবই আন্তরিকতার সাথে তাদের সহায়তা করত। নিজের খরচে আপ্যায়ন করতে কার্পণ্য করেনি কখনো। দুপুরে টিফিনে ক্যারিয়ারে তার বাসা থেকে যে খাবার আসত, ভাগাভাগি করে তা খেতে হতো অনেক সময়।
একবার তার প্রতিবেশী চাচা গ্রাম থেকে যশোর শহরে এসেছেন একটি কাজে। এ দিকে, তার লেখা শেষ করে ফ্যাক্সে জনকণ্ঠ অফিসে সংবাদ পাঠাতে হবে। ওই মুহূর্তে ছুটে এসে চাচা তার হাত চেপে ধরে বললেন, ‘এখন খবর পাঠাবে না, বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে; ভিজে নষ্ট হয়ে যাবে।’ গ্রামের মানুষের এ সরলতায় আমরা খুবই মজা পেলাম।
কেবল আজ আমাদের মধ্যে নেই; কিন্তু তার অনেক অসমাপ্ত কাজ, অনেক আদর্শ আমাদের মাঝে রেখে গেছে। আমাদের সবার দায়িত্বÑ তার অসমাপ্ত কাজ, স্বপ্ন ও আদর্শ বাস্তবায়ন করা। এটাই এ প্রজন্মের সাংবাদিকদের কাছে প্রত্যাশা। হ
লেখক : প্রবীণ সাংবাদিক ও সমাজ উন্নয়ন কর্মী

 


আরো সংবাদ



premium cement
ইসরাইলগামী সকল জাহাজে হামলার হুমকি হাউছিদের কংগ্রেস সর্বোচ্চ চেষ্টা করেও ৫০ আসন পাবে না : মোদি প্যারিসের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিলিস্তিনিপন্থী শিক্ষার্থীদের সরিয়েছে পুলিশ চুক্তিতে সম্মত হতে হামাসকে ৭ দিনের আল্টিমেটাম ইসরাইলের গফরগাঁওয়ে লরিচাকায় পিষ্ট হয়ে নারী নিহত রোহিঙ্গা গণহত্যা : মিয়ানমারের বিরুদ্ধে মামলার দ্রুত নিরসনে আশাবাদী বাংলাদেশ-গাম্বিয়া দোয়ারাবাজারে মইন হত্যাকারীদের গ্রেফতার দাবিতে বিক্ষোভ সাংবাদিকদের সুরক্ষায় প্রতিটি দেশের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের আহ্বান জলবায়ু সঙ্কট মোকাবেলায় অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন জোরদারের আহ্বান এডিবি প্রেসিডেন্টের মিরসরাইয়ে তীব্র তাপদাহে মরছে মাছ : লোকসানের মুখে চাষিরা মহেশখালীতে ত্রিমুখী লড়াইয়ের সম্ভাবনা, এগিয়ে জয়নাল

সকল