০৫ মে ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`


অস্ট্রেলিয়ায় দাবানল ও জলবায়ু পরিবর্তন

অস্ট্রেলিয়ায় দাবানল ও জলবায়ু পরিবর্তন - ছবি : সংগ্রহ

অস্ট্রেলিয়ার বনাঞ্চলে দাবানল নতুন নয়। তবু সাম্প্রতিক দাবানলটি (ডিসেম্বর-২০১৯) কেন ভয়ঙ্কর হয়ে উঠল এটা নিয়ে বিশ্বব্যাপী আলোচনার ঝড় চলছে। বিশেষ করে জলবায়ুর সাথে সম্পর্কিত করে এই দাবানল নিয়ে নানা বিশ্লেষণ চলছে।

এবারের দাবানল কেন এতটা ভয়ঙ্কর? একাধিক কারণ এর জন্য দায়ী। যেমন, অস্ট্রেলিয়ায় দীর্ঘকালীন খরা ও অতিরিক্ত তাপমাত্রা, দাবানল চলাকালে প্রচণ্ড বেগে বয়ে যাওয়া বাতাস, বনাঞ্চল ব্যবস্থাপনায় অনিয়ম এবং কোথাও কোথাও নাশকতামূলক কাজ। কারণগুলোর মধ্যে তাপমাত্রার বিষয়টি ছাড়া অন্য কারণগুলো আগেও ছিল, এখনো আছে। হয়তো ভবিষ্যতেও থাকবে। আজকের আলোচনার বিষয়, ‘অতিরিক্ত তাপমাত্রা’। কেন এটা লক্ষ করা যাচ্ছে এবং কেনইবা বিষয়টি জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে সম্পর্কিত?

প্রথমেই বলে নেই, আইপিসিসি (IPCC) প্রতিবেদনে বেশি নিশ্চিতভাবেই বলা হয়েছে যে, আগামীতে তাপপ্রবাহ ও দাবানলের প্রচণ্ডতা ও মাত্রা দুটোই বেড়ে যাবে বিশ্বব্যাপী। এমনটাই হচ্ছে এখন। অতিরিক্ত তাপমাত্রার প্রথম কারণ যেটা দাঁড়ায় তা হলো, অস্ট্রেলিয়ার ভেতরের তাপমাত্রা গত তিন মাস স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি ছিল। গত ডিসেম্বরে সেখানকার তাপমাত্রা ছিল ৪১.৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস। একইভাবে গত ১০০ বছরের তাপমাত্রা যদি লক্ষ করি, তাহলে দেখব যে, ১৯১০ সালের তুলনায় ২০১৯ সালের তাপমাত্রা প্রায় ১.৫ থেকে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে গেছে এবং এর অধিকাংশই বেড়েছে ১৯৫০ সালের পরে। তাপমাত্রা এই অধিক বেড়ে যাওয়াটা ছিল বৈশ্বিক উষ্ণতার ফল। এ কারণে স্বাভাবিকভাবেই অস্ট্রেলিয়াতে সার্বিক পরিবেশ ছিল আগুন লাগার সহায়ক। এ ঘটনা আইপিসিসির প্রতিবেদনের তথ্যের সত্যতাই প্রমাণ করে।

দ্বিতীয় যে বিষয়াটিতে গুরুত্ব দিতে চাই, তা হলো- সামুদ্রিক উত্তাপ। এটি নতুন একটি ফ্যাক্টর। এটাও বৈশ্বিক তাপমাত্রার ফলে সৃষ্ট। বিষয়টি হচ্ছে ‘হিট ব্লব’ (Heat Blob)। তা হচ্ছে গরম পানির সমাহার। ঠিক বরফ খণ্ডের মতো গরম পানির খণ্ড। এটি ২০১৩ থেকে প্রায়ই দেখা যাচ্ছে। এগুলো প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে আগে কখনোই দেখা যায়নি। হিট ব্লবের প্রভাব ও অস্ট্রেলিয়ার দাবানল : বর্তমানে অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের সমুদ্র উপকূলের কাছাকাছি অঞ্চলে প্রায় ১০ লাখ বর্গকিলোমিটার অঞ্চলজুড়ে (আমেরিকার টেক্সাস অঙ্গরাজ্যের সমান) গরম পানির একটি অঞ্চল তৈরি হয়েছে। বর্তমানে এই অঞ্চলটি স্বাভাবিকের চেয়ে ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি গরম। এই হিট ব্লব থেকে উদ্ভূত উত্তাপ অস্ট্রেলিয়ার বাতাসের তাপমাত্রাকে আরো বেশি উত্তপ্ত করে তুলেছে। অস্ট্রেলিয়ার দাবানলের জন্য এই হিট ব্লবই মূলত দায়ী। অন্য কারণগুলো সমস্যাটাকে আরো জটিল করে তুলেছে।

সাধারণত হিট ব্লব সৃষ্টি হয় বাতাসের দুর্বলতার কারণে। বায়ুপ্রবাহের কারণে সমুদ্রের উপরের গরম পানি নিচে চলে যায়। আর নিচের ঠাণ্ডা পানি উপরে চলে আসে। এটাই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। পানি উপরের যাওয়ার প্রক্রিয়াকে বলা হয় আপওয়েলিং (up-welling) আর নিচে যাওয়ার প্রক্রিয়াকে বলা হয় ডাউনওয়েলিং (down-welling)। যখন বাতাসের গতি স্বাভাবিকের চেয়ে দুর্বল হয়ে যায় তখন এ প্রক্রিয়াটি ব্যাহত হয়। অর্থাৎ সমুদ্রের উপরের গরম পানি নিচে যেতে পারে না এবং নিচের ঠাণ্ডা পানি উপরে আসতে পারে না। ফলে উপরে অধিক হারে, একই জায়গায় গরম পানি জমতে থাকে। এই জমে যাওয়া গরম পানি থেকে ‘হিট ব্লব’ তৈরি হয়। বৈশ্বিক উষ্ণতার কারণে কোথাও কোথাও ‘ট্রেড উইন্ডে’ এ দুর্বলতা লক্ষ করা যাচ্ছে। গত বছর অক্টোবর ও নভেম্বর মাসে একই ধরনের হিট ব্লব লক্ষ করা গিয়েছিল হাওয়াই, ক্যালিফোর্নিয়া ও আলাস্কা অঞ্চলে। ফলে এই তিন রাজ্যে ২০১৯ সালে অধিকতর গরম গ্রীষ্মের অভিজ্ঞতা হয়েছে।
এই হিট ব্লবের কারণে শুধু ভূমিতে নয়, সমুদ্রের অভ্যন্তরেও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে। সেটা নির্ভর করে এই ব্লব কতদিন স্থায়ী হবে। দীর্ঘস্থায়ী হলে, সমুদ্রের জলজ প্রাণী, মাছ বা মাছের খাদ্য বিশেষভাবে ক্ষতির শিকার হতে পারে। সবচেয়ে বড় ক্ষতি হবে ইকো সিস্টেমে।

মনে রাখতে হবে, এই হিট ব্লব প্রায়ই সমুদ্রের উত্তপ্ত অঞ্চলে দেখা দিতে পারে। ইতোমধ্যে লক্ষ্য যাচ্ছে যে, প্রশান্ত মহাসাগর অন্যান্য মহাসাগরের চেয়ে বেশি উত্তপ্ত হয়ে উঠছে, বিশেষ করে ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলটি আগের চেয়ে অধিক হারে উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। আগামীতে দক্ষিণ অথবা দক্ষিণপূর্ব এশিয়া অঞ্চলটি বিশেষভাবে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠবে। এই হিট ব্লবের প্রভাব বঙ্গোপসাগরীয় অঞ্চলে বিশেষ করে বাংলাদেশেও লক্ষ করা যাবে। সুতরাং এ কথা মাথায় রেখেই বনাঞ্চলে স্থানীয় ব্যবস্থাপনা উন্নত করা উচিত এবং নতুন অবকাঠামো বা শিল্প-কারখানা গড়ার ক্ষেত্রে বিশেষভাবে সতর্কতা অবলম্বন করা দরকার।

লেখক : প্রিন্সিপাল সায়েন্টিস্ট,
প্যাসিফিক ইএনএসও অ্যাপ্লিকেশন ক্লাইমেট সেন্টার, যুক্তরাষ্ট্র


আরো সংবাদ



premium cement