২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`


বিরোধী দল বনাম সরকারের সঙ্কট

-

প্রথমবারের মতো সংসদে বিরোধী দলের নেতা হয়ে জাপার নেত্রী সাবেক স্বৈরশাসক মুহম্মদ এরশাদের সহধর্মিণী রওশন এরশাদ গত বছর ২৭ ফেব্রুয়ারি সংসদে সমাপনী ভাষণে তার দলকে ‘পরিচয় সঙ্কট’ থেকে মুক্তি দেয়ার জন্য সংসদ নেতা ও আওয়ামী লীগ প্রধান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি আকুল আবেদন জানিয়েছিলেন। তার এই আকুতি চার বছর বিলম্বে হলেও বিরোধী দলের নেতা হিসেবে এবারই সর্বপ্রথম তিনি জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হয়েছেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী নিজেই আগামী সংসদ নির্বাচনের সময় তার সরকারের পরিচয় কী হবে, সেই সঙ্কটে পড়তে যাচ্ছেন বলে জনগণ মনে করেন। নির্বাচনকালে এ সরকারের পরিচয় কি রুটিনমাফিক ‘তত্ত্বাবধায়ক’ সরকার হবে, না রুটিন দায়িত্ব পালনকারী ‘দলীয়’ সরকার হবে; সে ব্যাপারে ক্ষমতাসীনরা দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছেন বলে মন্ত্রীদের বক্তব্যে পরিস্ফুটিত। রওশন এরশাদ তার রাজনৈতিক জীবনের শেষ প্রান্তে এসে জাপাকে যে পরিচয় সঙ্কটে পড়তে হবে, তা কয়েক দিন আগেও কল্পনা করতে পারেননি। তেমনি ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনের কারণে ১৪ দলীয় সরকারকে শেষ বছরে এসে পরিচয় সঙ্কটের মুখোমুখি হতে হবে- প্রধানমন্ত্রী তা-ও ভাবতে পারেননি। প্রধানমন্ত্রীর ৩৮ বছরের রাজনৈতিক জীবনে তার ক্যারিশমেটিক নেতৃত্বের গুণে এরশাদ সরকারকে ১৯৯০ সালে, খালেদা জিয়া সরকারকে ১৯৯৬ সালে এবং প্রধান উপদেষ্টা ও রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার ২০০৭ সালে এ তিনটি সাংবিধানিক সরকারের পতন ঘটিয়ে অন্য সরকার প্রতিষ্ঠাপূর্বক তাদের অধীনে অনুষ্ঠিত চারটি নির্বাচনের দু’টিতে জয়ী হয়েছেন। তবে দু’টিতে পরাজিত হওয়ায় ভবিষ্যতে যাতে নির্বাচনে পরাজিত হতে না হয়, সে জন্য ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি তার সরকার ও এমপিরা স্বপদে থেকে নির্বাচন করার সাংবিধানিক ব্যবস্থা ৩০ জুন ২০১১ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সম্পন্ন করেছিলেন। কিন্তু বিরোধী দল ১৪ সালের নির্বাচন বর্জন করায় জনগণ ভোট দিতে অনাগ্রহী হয়ে পড়ায় ১৫৪টি আসনে ব্যালট বাক্স, ব্যালট পেপার ও ভোটার তালিকার কোনো প্রয়োজন ছিল না। বাকি ১৪৬টি আসনে ব্যালট বাক্স ও পেপারের প্রয়োজন পড়লেও ভোটার তালিকার বালাই ছিল না। কারণ, কেন্দ্র ভোটারশূন্য থাকায় পুলিশ ও পোলিং অফিসারদের সহায়তায় ‘৯০ ভোটকে ৯৯০ ভোটে’ পরিণত করার কর্মটি প্রার্থীর এজেন্ট ও কর্মীরাই সম্পন্ন করেছিলেন। সংসদ নেতা ও বিরোধী দলের নেতা, উভয়ে যার যার নিজের ও দলের জনপ্রিয়তা প্রমাণ করতে গিয়ে ১৫৪ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার কারণেই এভাবে নির্বাচিত উভয় পরিচয় সঙ্কটে পড়েছেন। গুলশান-বনানী থেকে ওই নির্বাচনে ‘নির্বাচিত’ সংসদ সদস্যকে এলাকার কেউ চেনেন না। বলিহারি এই নির্বাচনী ব্যবস্থা! বিরোধী দলের পরিচয় সঙ্কট নিরসনের দায়িত্ব প্রধানমন্ত্রীর তৎকালীন বিশেষ দূত ও জাপার তদানীন্তন চেয়ারম্যান জেনারেল এরশাদের ওপর পড়ায় তিনি অচিরেই এর সমাধান দেবেন বলে জানিয়েছিলেন।

৩৬ বছরের শাসক, অর্থাৎ তিন দলের তিন নেতার কয়েকটি বিষয়ে মতের খুবই মিল পরিলক্ষিত হয়। যেমন- ক্ষমতায় থাকলে হরতাল ‘অবৈধ’ আর বিরোধী দলে থাকলে হরতাল ‘গণতান্ত্রিক অধিকার’। ক্ষমতায় থাকলে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ‘অসাংবিধানিক’, বিরোধী দলে থাকলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনে ‘সংবিধান কোনো বাধা হতে পারে না’। ক্ষমতায় থাকাকালে নির্বাচনকালীন সরকার হতে হবে ‘শতভাগ দলীয়’ আর বিরোধী দলে থাকলে তা হতে হবে ‘শতভাগ নির্দলীয়’। দাবি করা হয়, দলীয় সরকার নির্বাচনকালীন রুটিনমাফিক দায়িত্ব পালন করবেন বলে নির্বাচন ‘শতভাগ অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে’। আমজনতা নেতাদের কথা ও কাজের মিল খুঁজে পাচ্ছে না। একটানা ৩৬৫২ দিন প্রবল ক্ষমতাধর পদে থাকার পরও নির্বাচনকালীন মাত্র ৩০ দিন স্বপদে থেকে রুটিনমাফিক দায়িত্ব পালনের অধিকার সংবিধান তাদের দিয়েছে বলে জনগণকে হাইকোর্ট দেখানো ঠিক নয়। জনগণ কি নেতাদের ১৯৯৪-৯৬ ও ২০০৬-০৭ সালের আন্দোলন ও বক্তব্যের ওপর আস্থা রাখবে, না ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে আস্থা রাখবে? জাতীয় নির্বাচন কিভাবে কোন সরকারের অধীনে হতে হবে, সে ব্যাপারে ১৯৯৪ সালে সংসদ থেকে পদত্যাগ করে দলগুলো ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত ১৭৩ দিন হরতাল পালন ও সরকারি কর্মচারীদের ‘বিদ্রোহ’ ঘোষণার মাধ্যমে তাদের দাবি অনুযায়ী ৩০-৩-১৯৯৬ নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা করেই সেই সরকারের অধীনে ১৯৯৬ সালের ১২ জুনে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন হয়েছিলেন আওয়ামী লীগ নেতারা। পুনরায় ২০০৭ সালে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের শতভাগ নিরপেক্ষতা রক্ষার্থে ও লাইনচ্যুত গণতন্ত্রের ট্রেন গণতন্ত্রের ট্র্যাকে তুলতে জেনারেল মইন তার ট্যাংকবাহিনী নিয়ে এগিয়ে এসেছিলেন। তিনি জনগণকে ড. ফখরুদ্দীনের সরকারের দুই বছরের কঠোর শাসনে রেখে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নির্বাচনের মাধ্যমে ‘গণতন্ত্রের ট্রেন’ সঠিক ট্র্যাকে তুলে দিয়েছেন বলে মনে করেন। তবে বিদায় নিতে গিয়ে শেষ রক্ষা করতে পারলেন না। ২০০৭ সালে ১৫ টাকা কেজি দরের মোটা চালের দাম ৩০ টাকায় উঠেছিল। ফলে গরিবদের বাঁচানোর জন্য তাদেরই সন্তান বিডিআর সেনাদের ‘অপারেশন ডাল-ভাত’ কর্মসূচিতে নিয়োজিত করা হয়েছিল। কিন্তু দুই বছরেও তাদের প্রাপ্য টিএ-ডিএ না পাওয়ার বঞ্চনা ঘটেছিল। পত্রিকার খবর মোতাবেক, তাদের ক্ষোভের চরম বহিঃপ্রকাশ ঘটে ওই সরকারের বিদায়ের ৪৫ দিন পর, ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি বিদ্রোহের মাধ্যমে ৫৭ জন চৌকস সেনাকর্মকর্তাসহ ৭৪ জনকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। আর বিদ্রোহের জেরে বিডিআর ভেঙে দিয়ে বিজিবি গঠন করা হয়েছে। ১০ হাজার বিডিআর সেনা চাকরিচ্যুত হন, যারা সমাজের খুবই অনগ্রসর পরিবার থেকে এসেছিলেন। বিচারে সহস্রাধিকের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড এবং শতাধিকের প্রাণদণ্ডের রায় হয়েছে। রাজনৈতিক নেতা, সরকারি কর্মচারীদের বাইরে যাদের কর্মকাণ্ড জনগণকে খুবই ক্ষুব্ধ করেছে, তারা হচ্ছেন অনেক বুদ্ধিজীবী সুশীল ব্যক্তিত্বও।

১৯৯৪ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে বিরোধী দলের ১৪৭ এমপির একযোগে দাখিলকৃত পদত্যাগপত্র স্পিকার গ্রহণ না করার ব্যাপারে রিটের রায় এমপিদের পক্ষে দেয়ার মাধ্যমে রাজনৈতিক বিরোধের মীমাংসা তখন উচ্চ আদালতে হয়েছিল। পরে আওয়ামী লীগের জনৈক আইনজীবী কর্তৃক ২০০২ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল চেয়ে করা রিটের শুনানি ২০০৪ সালে হলে হাইকোর্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকার বৈধ বলে রায় দেন। সাত বছর পরে আপিলের রায়ে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক তার কাস্টিং ভোটের ৪-৩ সংখ্যাগরিষ্ঠতার রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ‘অসাংবিধানিক’ বলে ঘোষণা করেন। ফলে ১৪ দলীয় সরকার ও তাদের এমপিরা স্বপদে বহাল থেকেই ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচন করতে সক্ষম হন এবং জনগণ ১৯৮৮ সালের পর ২০১৪ সালে প্রথমবারের মতো ভোটাধিকার হারিয়ে ফেলেছিল।

১৯৯৪ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত দাবি ছিল শতভাগ নির্দলীয় অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে শতভাগ ‘অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন’। ২০১৩-২০১৪ সালে হলো ১০০ শতভাগ দলীয় সরকারের অধীনে ‘প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন’। বর্তমানে কথা হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী যেহেতু আর প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন চান না তাই নির্বাচন হতে হবে অংশগ্রহণমূলক। ১৪ দলের ১২৭ জন ও জামায়াতের ২০ জন এমপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবিতে ১৯৯৪ সালে পদত্যাগ করেছিলেন এবং হাইকোর্টে রিট করে ওই পদত্যাগপত্র গ্রহণ করতে স্পিকারকে বাধ্য করা হয়েছিল। তাই ক্ষমতায় থেকে ছলছুতায় প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন কি করা যেতে পারে?

রাজনৈতিক নেতাদের এবং ‘অভিজাত’ গোষ্ঠীর নীতি ও বক্তব্য পাল্টানোর সাথে জনগণ কিছুতেই খাপ খাওয়াতে পারছে না। নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রসঙ্গে হাইকোর্টের রায়ের মাধ্যমে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তা আপিল করে বাতিল করা যাবে। ১৯৯৪ সাল থেকে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি পর্যন্ত নির্বাচন নিয়ে যা কিছু হয়েছে, সব কিছুতেই জড়িত ছিল দলগুলো এবং তাদের সমর্থক ওই বিশেষ ‘অভিজাত’ শ্রেণী এবং সরকারি কর্মচারী-কর্মকর্তারা। আগামী নির্বাচন অন্তত ১৯৯৬ সালের ১২ জুন অথবা ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের মতো করার ঘোষণা দিয়ে সবার মনে স্বস্তি ফিরিয়ে আনা হোক।


আরো সংবাদ



premium cement