২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ফায়ার হাইড্রেন্ট স্থাপন জরুরি

ফায়ার হাইড্রেন্ট স্থাপন জরুরি - সংগৃহীত

প্রতিনিয়ত যেভাবে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে চলেছে, এখন কোথাও নিরাপদ বোধ করছে না মানুষ। বিশেষ করে সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন শহরের অগ্নিকাণ্ড এই উদ্বেগ আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। এসব অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ফায়ার সার্ভিস ব্যবস্থার দুর্বলতা ফুটে উঠেছে। অথচ আমাদের এই বাহিনীর কর্মকর্তা ও কর্মীরা যেকোনো দুর্যোগে নিজেদের জীবন বাজি রেখে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং আন্তরিকভাবে কাজ করে প্রাণপণ লড়ে যায় বিপদগ্রস্ত মানুষদের সহযোগিতায়।

সমালোচনা হচ্ছে অগ্নিনির্বাপণে ব্যবহৃত সরঞ্জাম নিয়েও। এ মুহূর্তে বেশি প্রয়োজন ফায়ার সার্ভিস ব্যবস্থার আধুনিকায়ন। অগ্নিনির্বাপণে প্রথম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে পানির পর্যাপ্ততা নিশ্চিত করা। কিন্তু আমাদের দেশে বেশির ভাগ বড় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় পানি সরবরাহের সীমাবদ্ধতা লক্ষ করা গেছে। তাই অগ্নিনির্বাপণের ক্ষেত্রে ফায়ার হাইড্রেন্ট স্থাপন হতে পারে একটি কার্যকর উদ্যোগ।

অগ্নিকাণ্ড মোকাবেলায় দ্রুত পানি সরবরাহের প্রয়োজনে ঝুঁকিপূর্ণ বিভিন্ন পয়েন্টে ফায়ার হাইড্রেন্ট (অগ্নিনির্বাপণ কাজে ব্যবহৃত বিশেষ পাম্পযুক্ত পানিকল) স্থাপন করা খুবই জরুরি। কারণ, ফায়ার হাইড্রেন্ট হচ্ছে পানির একটি সংযোগ উৎস। যা পানির প্রধান উৎসের সাথে যুক্ত থাকে। যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজনে এই উৎস থেকে পানি ব্যবহার করা যায়। এর সবচেয়ে বড় সুবিধা হচ্ছে লম্বা পাইপের সাহায্যে ইচ্ছেমতো যেকোনো দূরত্বে পানি সরবরাহ করা যায়।

তাছাড়া ঘনবসতিপূর্ণ গিঞ্জি এলাকার যেসব রাস্তায় অগ্নিনির্বাপক গাড়ি সহজেই প্রবেশ করতে পারে না সেখানে এই ব্যবস্থায় পানি সরবরাহ বেশ কার্যকর। এটি রাস্তার ধারে স্থাপিত এক ধরনের পানির কল বা উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন পাম্প যেখান থেকে প্রয়োজনের সময় পানি ব্যবহার করা যায়।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আগুন নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় বহু আগে থেকেই ফায়ার হাইড্রেন্ট ব্যবহার হয়ে আসছে। ফায়ার হাইড্রেন্ট উদ্ভাবন নিয়ে সুস্পষ্ট তথ্য জানা যায়নি, তবে কারো কারো মতে ১৮০১ সালে আবিষ্কার হয়। তবে বাংলাদেশে এখনো এই ব্যবস্থাটির ব্যবহার দেখা যায় না। যদিওবা দেশের রফতানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলে এ ব্যবস্থা কিছুটা চোখে পড়েছে।

বিশ্বের প্রায় সব শহরে অগ্নিদুর্ঘটনা রোধে এ ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে। এমনকি পাশের দেশ ভারতের কলকাতাও এর আওতায় আনা হয় সেই ইংরেজ আমলে। কলকাতার চেয়ে আমাদের পানির উৎস বেশি অথচ আমরা এই সুযোগ কাজে লাগাইনি। এত দুর্ঘটনার পরও আমাদের অপরিকল্পিত নগরে ফায়ার হাইড্রেন্ট ব্যবস্থা গড়ে তোলার কোনো উদ্যোগই নেয়া হচ্ছে না।

কেন ফায়ার হাইড্রেন্ট ব্যবস্থা চালু করা সময়ের দাবি! কারণ, ঢাকার চকবাজারে অগ্নিদুর্ঘটনার সময় প্রায় ১ কিলোমিটার দূরের পুকুর থেকে পানি সংযোগ দেয়া হয়েছিল। সেই সময় মানুষের পায়ের চাপে সেই পানিপ্রবাহ বারবার বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে পুকুর, খাল ও জলাশয় একবারে নেই বললে চলে। ফলে যেকোনো অগ্নিকাণ্ডে আমাদের পানির উৎস খুঁজে বের করতে বেগ পেতে হয়। অথচ ফায়ার হাইড্রেন্ট স্থাপন করে আমরা সে সমস্যা সমাধান করতে পারি।

আমাদের মেয়র, শহর উন্নয়ন কর্মকর্তা, নগর পরিকল্পনাবিদ ও বিশেষজ্ঞরা বিশ্বের কত দেশে সফর করেন এবং তারা এটাও জানেন প্রায় সব উন্নত শহরে ফায়ার হাইড্রেন্ট স্থাপন করা হয়েছে। কিন্তু উন্নত বিশ্বের সুপরিকল্পনাগুলো আমাদের দেশে কেন প্রয়োগ করা হয় না, তা আমরা জানি না। স্বাধীনতার প্রায় পাঁচ দশক হতে চলল, এখনো বাংলাদেশে এই প্রযুক্তির প্রচলন দেখা যায়নি। যদিও প্রতি বছরই দেশের প্রধান শহরগুলোতে বিভিন্ন সময়ে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে।

সর্বশেষ ঢাকার চকবাজারের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় প্রায় ৭০ জন, বনানীতে ২৫ জন মানুষের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। এখনো অনেকে হাসপাতালের বেডে কাতরাচ্ছেন, হয়তো মৃত্যুর সংখ্যা আরো বাড়বে। এর আগে ২০১০ সালে ঢাকার নিমতলীতেও ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছিল। প্রতি বছর দেশে হাজারো অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। আর এসব ঘটনায় আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ হাজার কোটি টাকা সাথে হারাতে হয় অসংখ্য মূল্যবান জীবন। উন্নত বিশ্বের আদলে অগ্নিকাণ্ড মোকাবেলায় দ্রুত পানি সরবরাহ করতে ওয়াসা এবং ফায়ার সার্ভিসের উদ্যোগে দেশের অগ্নিঝুঁকি রয়েছে এমন শহরে রাস্তার বিভিন্ন পয়েন্টে ফায়ার হাইড্রেন্ট স্থাপন করা দরকার।

দৃশ্যত ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা সরু অলিগলি পেরিয়ে দুর্ঘটনাস্থলে পৌঁছতে পারলেও প্রয়োজনীয় পানি সরবরাহের অভাবে দ্রুত সময়ের মধ্যে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেন না। ফলে আগুনের ব্যাপ্তি আর ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও বেশি হয়। তাই অগ্নিকাণ্ডে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কমাতে ফায়ার হাইড্রেন্ট হতে পারে একটি চমৎকার উদ্যোগ।

একটি ফায়ার হাইড্রেন্ট থেকে মিনিটে ৫০০ থেকে ১৫০০ গ্যালন পানি বের হয়। ফায়ার হাইড্রেন্টের জলাধারগুলো সাধারণত প্রাকৃতিক পানির উৎস যেমন নদী, খালের সাথে যুক্ত থাকে এবং এগুলোর অবস্থান পানির উৎস থেকে নিচুতে থাকে যাতে করে পানির সম-উচ্চশীলতার কারণে উৎস থেকে জলাধারে আপনা আপনি পানি চলে যায়। যার কারণে ফায়ার হাইড্রেন্টের পানির সরবরাহ যতক্ষণ প্রয়োজন ততক্ষণই থাকে।

আমরা সাধারণত আগুন লাগার পর তা কিভাবে নেভানো হবে, সে সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করি। যদিও বিষয়টি নিয়ে চিন্তাভাবনা করা উচিত আগুন লাগার আগেই। বাংলাদেশের পরিস্থিতিতে ফায়ার সার্ভিসের সহায়তা পাওয়া সহজ নয়। কারণ, রাস্তায় যানজট লেগেই থাকে। এ ছাড়া রয়েছে বিভিন্ন এলাকায় সঙ্কীর্ণ রাস্তাঘাট।

ফলে ইচ্ছা থাকলেও দ্রুত ফায়ার সার্ভিসের পক্ষে ঘটনাস্থলে গিয়ে আগুন নেভানো সম্ভব হয় না। অগ্নিকাণ্ডের সময় প্রায়ই পানির সঙ্কটের কথা জানা যায়। ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে খুব বেশি পানি থাকে না। কয়েক মিনিটেই এ পানি শেষ হয়ে যায়। বড় বিপণিবিতান বা আবাসনে আগুন লাগলে তা কিছুক্ষণ পর নেভানো অসম্ভব হয়ে পড়ে। তাই আগুন লাগলে তা কিভাবে নেভানো হবে তার একটি পরিকল্পনা আগেই করে রাখতে হবে। এ ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত পানি, বালির ব্যবস্থা ও আগুন শনাক্ত ও নেভানোর যন্ত্রপাতি এবং সেগুলো চালানোর মতো প্রশিক্ষিত জনবল থাকা প্রয়োজন।

যেকোনো দুর্ঘটনা ঘটলে খবরে প্রচার হয় ভবন নির্মাণে বিল্ডিং কোড মানা হয়নি, এত তলার অনুমোদন ছিল না, অগ্নিনির্বাপণে যথাযথ ব্যবস্থা ছিল না, ভবনের ইমার্জেন্সি সিঁড়ি নেই আরো কতকিছু। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এসব দেখা যাদের দায়িত্ব তারা কোথায়? একের পর এক ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটা সত্ত্বেও এসব দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হয়নি।

ফায়ার সার্ভিসকে কিছুটা আধুনিকায়ন করা হলেও জনাকীর্ণ এলাকাগুলোতে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি নিয়ে সেখানে সময়মতো পৌঁছা সম্ভব হয় না। বিশেষ করে জনাকীর্ণ এলাকায় আগুন নেভানোর জন্য পানি সরবরাহের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না থাকায়, এসব এলাকায় অগ্নিকাণ্ডে প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বেড়েই চলছে। আমাদের আইন আছে, আর এই আইন প্রয়োগের আগে প্রয়োজন যথেষ্ট গণসচেতনতা।

দুর্ঘটনা আসলেই দুর্ঘটনা, কেউ তো ইচ্ছাকৃতভাবে আগুন লাগায় না, তবে রাজনৈতিক কারণে বা বীমার টাকার লোভে যদি করে থাকে তা তদন্তের বিষয়। প্রকৃত অর্থে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় যারা মারা যাচ্ছে তারা তো নিরপরাধ। যাদের সাথে এ ঘটনার কেনো সম্পৃক্ততা নেই। এখন প্রশ্ন আসতে পারে, অগ্নিনির্বাপণে যথাযথ ব্যবস্থা না থাকার জন্য দায়ী কে বা কারা ?

কিন্তু মূল আলোচ্য বিষয়কে পাশ কাটিয়ে কর্মকর্তারা ব্যস্ত হয়ে পড়েন কেন ঘটনা ঘটল? মালিক কে? ধরে নিয়ে এসো... আরো কত কিছু। অথচ দেশের আর্থসামাজিক অবস্থার কথা বিবেচনা করেই বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠান বা মালিক সাধ্যমতো চেষ্টা করে প্রতিষ্ঠান চালাতে। তার ওপর এই বিপদে প্রতিষ্ঠান বা মালিক অনেকটা পিছিয়ে পড়ে বা দেউলিয়া হয়ে যায়। অবশ্যই তদন্ত করে সবাইকেই বিচারের আওতায় আনতে হবে।

প্রতিটি ঘটনার পর তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। কমিটি প্রতিবেদন জমা দেয়, সমস্যা প্রতিরোধে কিছু সুপারিশমালা তুলে ধরা হয়। তবে এই সুপারিশমালা প্রতিবেদনের মলাটে সীমাবদ্ধ থাকে। কিছু দিন পত্রপত্রিকার শিরোনাম হওয়ার পর আবারো সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি আর পুরাতন সংস্কৃতি। কিন্তু লাশের মিছিল তো বন্ধ হয় না।

কেউ বলে না দুর্ঘটনা প্রতিরোধে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার কথা, পরিকল্পিত উদ্যোগ ও কার্যকর ব্যবস্থাপনাই পারে দুর্ঘটনার হার কমিয়ে দিতে। কর্তা ব্যক্তিদের বোঝা উচিত আজ হয়তো হতভাগা মানুষগুলোর এমন করুণ মৃত্যু হয়েছে, কিন্তু কালতো আমারও একই পরিণতি হতে পারে?

লেখক : উদ্যোক্তা ও প্রতিষ্ঠাতা, সাদার্ন ইউনিভার্সিটি


আরো সংবাদ



premium cement