২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

সুবর্ণচরের বিবর্ণ বার্তা

এমন অনিয়মের নির্বাচনকে আদৌ নির্বাচন বলা যায় কিনা সে প্রশ্ন এখন সর্বমহলেই - ফাইল ছবি

নির্বাচনে ভোট দেয়াকে কেন্দ্র করে নোয়াখালীর সুবর্ণচরে নারী নিগ্রহ ও ধর্ষণের ঘটনা এবারের নির্বাচনী বিতর্কে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। এমনিতেই একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মহলে অভিযোগের অন্ত নেই। নির্বাচনের নিরপেক্ষতা ও গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে খোদ জাতিসঙ্ঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেসসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো গুরুতর প্রশ্ন উত্থাপন করেছে। ‘বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক চরিত্রের বিচ্যুতি ঘটেছে’ এমন অভিযোগও উঠেছে বহির্বিশ্বে।

সদ্য সমাপ্ত নির্বাচনে বিরোধী দলগুলো যে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ করে আসছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআইবি) গবেষণায়ও সেই অভিযোগগুলোই জোরালো ভিত্তি পেয়েছে। আন্তর্জাতিক এই গবেষণা সংস্থা ৫০টি আসনের নির্বাচন নিয়ে গবেষণা করে ৪৭টিতেই গুরুতর অনিয়মের প্রমাণ পেয়েছে বলে দাবি করেছে। এমন অনিয়মের নির্বাচনকে আদৌ নির্বাচন বলা যায় কিনা সে প্রশ্ন এখন সর্বমহলেই।

টিআইবির গবেষণা প্রতিবেদনের অভিযোগগুলো হচ্ছে, নির্বাচনের আগের রাতেই ব্যালটে সিল মেরে বাক্স ভর্তি করা, ভোটারদের হুমকি দিয়ে তাড়ানো এবং ভোটকেন্দ্রে প্রবেশ করতে না দেয়া, পোলিং বুথ দখল করে প্রকাশ্যে সিল মেরে জালভোট দেয়া, ভোটারদের বিশেষ মহলের পছন্দের প্রতীকে ভোট দিতে বাধ্য করা, ভোট গ্রহণ শুরু হওয়ার আগেই ব্যালট বাক্স ভর্তি, ভোট শেষ হওয়ার আগেই ব্যালট পেপার শেষ হওয়া এবং বিরোধী দলের পোলিং এজেন্টকে কেন্দ্রে প্রবেশ করতে না দেয়া। নতুন সরকারের একজন মন্ত্রী এসব অভিযোগ বিরোধী দলের কথার প্রতিধ্বনি বলে নিজেদের দায় শেষ করেছেন। কিন্তু অভিযোগগুলোর অসারতা প্রমাণের কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি।

বাংলাদেশের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে গুরুতর অভিযোগ উত্থাপন করে যুক্তরাষ্ট্রের খ্যাতনামা উইলসন সেন্টারের সিনিয়র স্কলার ও ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রদূত উইলিয়াম বি মাইলাম বলেছেন, ‘সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙার পর পৃথিবীর গণতান্ত্রিক ইতিহাসের নিকৃষ্ট নির্বাচন হলো বাংলাদেশের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচন। মূলত ক্ষমতাসীনেরা নির্বাচনের ফলাফল চুরি করেছে। যারা নিজেদের সরকার বলে দাবি করছে তারা অবৈধ।’ তিনি বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থার বার্তাটা তুলনা করেছেন ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক এবং সাংবাদিক জর্জ ওরওয়েলের সেই বার্তার সাথে। বার্তাটি হচ্ছে, ‘সরকার নিজের ইচ্ছেমতো করে কোনটা সত্য সে ঘোষণা দেয় কিন্তু দিন শেষে মানুষ সেটাকে মেনে নেয় না। তারা প্রকৃত সত্যের ছাঁকনি দিয়েই সব কিছু বিচার করে।’

যদিও ‘নির্বাচন যথাযথ হয়নি’ ইউএন মহাসচিবের এমন দাবির প্রত্যুত্তরে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘কোন দেশে ইলেকশন পারফেক্ট হয়েছে, একটা দেশ দেখান। গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে পারফেক্ট বলে যে কথাটি বলা হয় তাতেও কিছু খুঁত তো থাকেই। তাতে ইলেকশনের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে না।’ কিন্তু কোনো দেশের নির্বাচনকে কখনো পুরোপুুরি অগ্রহণযোগ্য ও সরকারকে অবৈধ বলা হয়েছে এমন ঘটনাও তো বিশ্বের গণতান্ত্রিক ইতিহাসে নজিরবিহীন। নির্বাচনে গুরুতর অনিয়মে শুধুই ‘খুঁত’ তকমা লাগিয়ে দিয়ে কি এই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব? বিষয়টি নিয়ে ক্ষমতাসীনদের ভাবার অবকাশ আছে বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

নির্বাচন নিয়ে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মহলে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগের মধ্যেই ক্ষমতাসীনেরা গত ১৯ জানুয়ারি রাজধানীতে বিজয় সমাবেশে ‘এই বিজয় মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের অনুকূলে গণরায়’ বলে আখ্যা দিয়েছে। যদিও সরকারের এমন দাবি ‘আপনরূপে নিজেই পাগল’-এর মতোই শোনাচ্ছে। অথচ বিরোধী পক্ষ সরকারের বিজয় উদযাপনের প্রতিক্রিয়ায় ‘পরাজয়ের গ্লানি ঢাকতেই বিজয় উৎসব’ বলে মন্তব্য করেছে। এবারের নির্বাচন যখন নানাবিধ প্রশ্নবাণে বিদ্ধ তখন নোয়াখালীর সুবর্ণচরে ভোট দেয়াকে কেন্দ্র করে নারী নিগ্রহ ও সম্ভ্রমহানির ঘটনা সাধারণ মানুষের মধ্যে একটা নেতিবাচক বার্তাই দিয়েছে।

দলীয় সরকারের অধীনে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হয় না- এমন অভিযোগ সর্বসাম্প্রতিক নয়। এমন অভিযোগেই ২০১৪ সালে বিরোধী দল দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করেছিল। মহল বিশেষে বিরোধী দলের নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত সঠিক মনে করা হয়নি। কিন্তু ৩০ ডিসেম্বর প্রমাণ হয়েছে, মাঠের বাইরে থেকে খেলোয়াড়ের ভুল অন্বেষণ করা সহজ হলেও বাস্তবতা কিন্তু তত সহজ নয়। যা হোক এবার বোধহয় প্রমাণ হয়ে গেছে, আমাদের দেশের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির প্রেক্ষাপটে দলীয় সরকারের অধীনে কোনোভাবেই অবাধ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্ভব নয়। শুধু তাই নয় নির্বাচনকেন্দ্রিক ঘটনার ধারাবাহিকতা ও পারিপার্শ্বিকতা বিরোধী দলের দাবিকে জোরালো ভিত্তিও দিয়েছে। সুবর্ণচরের অনাকাক্সিক্ষত ঘটনাও বিরোধীদের জন্য শুধুই ‘শাপেবর’ হয়নি বরং পুরো নির্বাচনী প্রক্রিয়াকেই প্রশ্নবিদ্ধ বিবর্ণ করেই ছেড়েছে।

সুবর্ণচরের ঘটনা তৎপরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ জনমনে একটা নেতিবাচক বার্তাই দিয়েছে বলেই মনে করা হচ্ছে। কারণ, সদ্য সমাপ্ত নির্বাচনে নির্বাচন কমিশন ও নির্বাচন সংশ্লিষ্টরা তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেনি বা পালন করতে ব্যর্থ হয়েছে। রাষ্ট্্র তথা রাষ্ট্রযন্ত্রও যে যথাযথাভাবে কাজ করেনি বা করতে পারছে না তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। কারণ, নির্বাচনকালীন সময়ে সরকার, নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসন দেশের মানুষের জানমালের নিরাপত্তাসহ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে পারেনি। ভোটারদের জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়নি। যদিও আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় রাষ্ট্রের কার্যাবলী ও দায়িত্ব বেশ বিস্তৃত। রাষ্ট্রচিন্তকেরা আধুনিক রাষ্ট্রে আইনশৃঙ্খলার ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন।

আর এম ম্যাকাইভার তার 'The Modern State' গ্রন্থে বলেছেন, ‘আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা রাষ্ট্রের প্রাথমিক কাজ বা দায়িত্ব।’ নাগরিকদের জীবন ও সম্পত্তির নিরাপত্তা এবং ব্যক্তিস্বাধীনতা রক্ষার নিশ্চয়তা থেকে রাষ্ট্র নামক সংগঠনের সৃষ্টি হয়। জনসাধারণকে আইন মেনে চলতে বাধ্য করা, আইন ভঙ্গকারীদের শাস্তির বিধান করা এবং সামগ্রিক অভ্যন্তরীণ শান্তিÍশৃঙ্খলা বজায় রাখা রাষ্ট্রের প্রধান কাজ।

সে উদ্দেশ্য সাধনের জন্যই রাষ্ট্র স্থানীয়, আঞ্চলিক এবং জাতীয় পর্যায়ে রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে থাকে। বিশ্বের সব রাষ্ট্রই আইন ও সংবিধান দিয়ে পরিচালিত হয়। সার্বভৌমত্বও আইন ও সংবিধান দিয়ে নিয়ন্ত্রিত। বস্তুত, সবার আগে রাষ্ট্রকে মানুষের অধিকারের নিশ্চয়তা দিতে হবে। গ্রিনের মতে, 'Right is a claim of an individual to will his own ideal object.' অর্থাৎ ব্যক্তির নিজের আদর্শ চরিতার্থ করার দাবিই অধিকার।

এ কথা অস্বীকার করার সুযোগ নেই যে, সদ্য সমাপ্ত নির্বাচনে রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রযন্ত্র জনগণের অধিকার রক্ষায় যথাযথভাবে ক্রিয়াশীল থাকতে পারেনি বরং রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় জনগণের ভোটাধিকার কেড়ে নেয়ার অভিযোগই বেশ জোরালো ভিত্তি পেয়েছে। নোয়াখালীতে নারী ভোটার ধর্ষণের পর পুলিশ একটি ধর্ষণ মামলা এন্ট্রি করলেও ওই মামলায় প্রধান অভিয্ক্তুকে এজাহারভুক্ত করা হয়নি। পুলিশের দাবি ভিকটিম পক্ষই তাকে আসামি করেননি। কিন্তু ভিকটিম পক্ষ দাবি করছে, পুলিশ সাদা কাগজে তাদের কাছে স্বাক্ষর নিয়ে তাদের মনমতো এফআইআর করে মূল অভিযুক্তকে এফআইআর থেকে বাদ দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের নিরপেক্ষতা নিয়েই প্রশ্ন ওঠাই তো সঙ্গত।

রাষ্ট্রযন্ত্র যে নিরপেক্ষ ও যথাযথভাবে কাজ করতে পারছে না তার প্রমাণ মিলেছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের বক্তব্য থেকেও। ভিকটিম পক্ষ ভোট দেয়াকে কেন্দ্র করে গণধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে বলে দাবি করলেও ঘটনার সাথে নির্বাচনের কোনো সম্পর্ক থাকার ‘প্রমাণ মেলেনি’ বলে প্রতিবেদন দিয়েছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের তথ্যানুসন্ধান কমিটি। খোদ ভিকটিমের দাবির পরও ধর্ষণের ঘটনার সাথে কেন নির্বাচন সংশ্লিষ্টতা মেলেনি তা রীতিমতো রহস্যজনকই মনে করা হচ্ছে।

সুবর্ণচরে গণধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে এ কথা কোনো পক্ষই অস্বীকার করছেন না। কিন্তু পুলিশ এ বিষয়ে এফআইআর করার পর জনমনে নতুন করে প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। ‘দুষ্টের দমন ও শিষ্টের লালন’ করে জনমনে শান্তিশৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলেও সংশ্লিষ্ট ঘটনায় রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রযন্ত্রের কার্যকারিতা নিয়ে জোরালো প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। যা কার্যকর রাষ্ট্র, আইন ও সাংবিধানিক শাসনের সাথে মোটেই সঙ্গতিপূর্ণ নয়।

মূলত সদ্য সমাপ্ত নির্বাচনের সার্বিক দিক পর্যালোচনা ও সুবর্ণচরে নারী ভোটার ধর্ষণের ঘটনা নির্বাচন নিয়ে সরকারের দাবিকে মোটেই আনুকূল্য দেয় না। তার পরও তারা তাদের অবস্থানে অটল। যদিও অ্যাডলফ হিটলার বলেছেন, যদি তুমি কোনো অসত্যকে বারবার এবং সাবলীলভাবে বলতে পারো তবেই তা বিশ্বাসযোগ্য হবে। কিন্তু টমাস হুদ বলেছেন ভিন্ন কথা। তার ভাষায়, অসত্যের অহমিকা ক্ষণস্থায়ী, আর সত্যের অহঙ্কার চিরস্থায়ী। সংশ্লিষ্টদের বিষয়টি বিবেচনার নিয়ে আগামী দিনে কর্মপন্থা নির্ধারণ করা উচিত বলেই মনে করেন রাজনীতিসংশ্লিষ্টরা।


আরো সংবাদ



premium cement