২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড

নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার ও প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদা - নয়া দিগন্ত

আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে হবে কি না- সেটা নির্বাচনী প্রচার শুরুর দ্বিতীয় দিন থেকেই একইভাবে প্রস্ফুটিত হচ্ছে। বিভিন্ন পত্রিকার খবরে প্রকাশ- কমপক্ষে ১৮টি জেলায় আওয়ামী লীগ-বিএনপির নির্বাচনী সঙ্ঘাতে দু’জন নিহত ও প্রায় ২০০ জন আহত হয়েছেন। নির্বাচন কমিশনের মৌখিক বাগাড়ম্বর ছাড়া নিরপেক্ষতা পরিলক্ষিত হচ্ছে না। পুলিশ ও প্রশাসনই নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার অনুঘটক।

অথচ ক্ষমতাসীনদের সাজানো ছকেই দলীয় আনুগত্যশীল কর্মকর্তাদের দিয়ে শেষ মুহূর্তে সাজানো হয়েছিল, কিন্তু নির্বাচন কমিশনের মন্তব্য হলো, কোনোমতেই তা রদবদল করা হবে না। ফলে নির্বাচনে প্রভাব সৃষ্টিকারী অপশক্তি শতগুণে শক্তি সঞ্চার করে ঝাঁপিয়ে পড়েছে ময়দানে। তাই শুরুতেই অশনি সঙ্কেত! দৈনিক প্রথম আলোর গত ১২ ডিসেম্বরের লিড নিউজ হলো- ‘প্রচারের শুরুতেই রক্ত ঝরল’। গত ১১ ডিসেম্বর নির্বাচন কমিশনে গিয়ে ভোলার বিএনপি প্রার্থী মেজর (অব:) হাফিজ অভিযোগ করে বলেছেন, তিনি তার নির্বাচনী এলাকায় মহাজোটের সন্ত্রাসীদের প্রতিরোধে ঢুকতেই পারছেন না।

নির্বাচন কমিশন ‘দেখছি’ বলে তাকে আশ্বস্ত করেছে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ঠাকুরগাঁও-১ আসনে গণসংযোগ ও পথসভা করে ফেরার পথে যুবদল সহসভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক গ্রেফতার হলে সহানুভূতি জানাতে তাদের বাড়িতে যাওয়ার পথে সন্ত্রাসীদের হাতে আক্রান্ত হন। দানারহাট আওয়ামী লীগ কার্যালয় থেকে ৪০-৫০ জন সন্ত্রাসী লাঠি ও ইটপাথর নিক্ষেপে প্রায় সাতটি মাইক্রোবাস ও মোটরসাইকেল আরোহীকে আহত করে এবং তা ভাঙচুর করে।

বগুড়ার ধুনটে যুবদলকর্মী মুরাদের বাড়ি পেট্রল ঢেলে পুড়িয়ে দেয়। মোদ্দা কথা, দেশব্যাপী ঐক্যফ্রন্টের কর্মী ও নেতাদের ওপর অজস্র গায়েবি মামলা দেয়ার পরও শারীরিক হামলা ও ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে তাদের নির্বাচনী দৃশ্যপট থেকে সরানোর পরিকল্পনা ও তা বাস্তবায়ন করছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে সংলাপে গায়েবি মামলার তালিকা মোতাবেক তাদের মুক্তি ও নির্বাচনকালীন সময়ে কোনো গায়েবি মামলা দেয়া হবে না- এ আশ্বাস দেয়া সত্ত্বেও তা শতগুণে বেড়ে গেছে। ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ এক হাস্যকর তত্ত্বে রূপান্তরিত হয়েছে।

নির্বাচন কমিশনের ইচ্ছাকৃত হেঁয়ালিপনায় সুশাসনের জন্য নাগরিক সুজনের চেয়ারম্যান মো: বদিউল আলম মজুমদার বলেন, শুরুতেই সুষ্ঠু নির্বাচনের যাবতীয় কার্যক্রম ভেঙে পড়েছে। এই যদি হয় বহু ঢাকঢোল পেটানো লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের অবস্থা, তবে সামনের দিনগুলোতে তা কী প্রকট আকার ধারণ করবে তা সহজেই অনুমেয়। ক্রিমিনিলোজি বা অপরাধ বিজ্ঞান অথবা আমাদের সিআরপিসিতে গায়েবি মামলা এক নতুন সংযোজন।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অপরাধ তত্ত্বে বহির্বিশ্বে তা আজো অজানা, কিন্তু বাংলাদেশে তা বহুল প্রচলিত হয়েছে বহু বিতর্কিত ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারিতে বিনাভোটে নির্বাচিত এই সরকারের আমলে। বাস পোড়েনি অথবা অগ্নিসংযোগ হয়নি, তবুও পুলিশ বাস পোড়ানো বা অগ্নিসংযোগের দায়ে বিশেষ দিনে মামলা করে শত শত বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীকে আটক করেছে। সাংবাদিকেরা এ ব্যাপারে পুলিশের জনৈক ডিআইজিকে প্রশ্ন করলে তিনি উত্তরে বলেছিলেন, ‘বাস তো পুড়তেই পারত না, অগ্নিসংযোগ হতে পারত’ তাই এ সন্দেহে মামলা হয়েছে।

‘অপরাধ হয়নি’ তারপরও নির্দিষ্ট দিনে মামলা হলো, আমাদের বিচারকেরা প্রশ্ন তুললেন না- কোন বাসে আগুন দিলো, তার নম্বর কত, চেসিস নম্বরই বা কত? কী আজব এই দেশ? এ প্রশ্নের মতো অজস্র প্রশ্ন দেখা দিলেও ঘুণে ধরা পচনশীল এ সমাজের বিচারব্যবস্থার এ কোন দশা, ভাবলেও শিহরিত হতে হয়। ইসলামী সাহিত্য বা তফসিল কেন চার্জশিটে জঙ্গি পুস্তক হলো- এ প্রশ্ন কেউ তুলবে না, তা বিলিয়ন ডলারের প্রশ্নের মতো বিবেচিত হতে পারে। সভ্য দেশ হলে চার্জশিট প্রদানকারীদের বিরুদ্ধেই ‘আইনের অপপ্রয়োগের’ দরুন উল্টো বিচার হতো!

কিন্তু এখানে তা হয় না। জানা গেছে, প্রায় চার হাজার গায়েবি মামলায় প্রায় দুই লাখ আসামি। মনে হয় পুরো বাংলাদেশই আজ কারাগার। কে এর প্রতিকার করবে? ক্ষমতাসীনেরা আজ মন্ত্রিত্ব বা এমপিগিরি টিকিয়ে, সংসদ বহাল রেখে মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন, বিরোধীদের উচ্ছেদ-ধ্বংসের হুঙ্কার দিচ্ছেন, আর বিরোধীরা পুলিশি ভয়ে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে! নির্বাচন কমিশনের কেউ বলছেন, উৎসবমুখর পরিবেশেই প্রচারণা চলছে। সংবিধান তাদেরকে এত ক্ষমতা দেয়া সত্ত্বেও তারা চোখ-মুখ বুজে অবলোকন করছেন।

এ যেন ভানু মুখোপাধ্যায়ের ‘দেখিনা কী করে’র সেই কৌতুকের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। মির্জা ফখরুলের গাড়িবহরে হামলায় তাৎক্ষণিক প্রশাসনিক পদক্ষেপ না নিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার নাকি ‘বিব্রত’ হয়েছেন- যা টিভি স্ক্রলে পরিদৃষ্ট হলো। এ যেন গণ্ডপারের সুড়সুড়ির অনুভূতির দশা। বিব্রত হওয়ায় কি সন্ত্রাসীরা লজ্জায় পরিশুদ্ধ হবে নাকি দ্বিগুণ উৎসবে প্রতিপক্ষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে- সদাশয় কমিশনের কাছে জানতে ইচ্ছে করে।

আদতে নির্বাচন কমিশন হয় অযোগ্য, অথবা তারা নিজেরাই বোঝে না সংবিধান তাদের কতটুকু ক্ষমতাবান করেছে। অথবা জেগে থেকে ঘুমের ভান করছে। চোখে আঙুল দিয়ে তাদের কি করণীয় বুঝিয়ে দিলেও তারা সেটা করছেন না- ভানু মুখোপাধ্যায়ের মতো ‘দেখি না কী করে’র ভান করছে! তারা কি একবার ভেবে দেখবেন : ইতিহাসের এই সন্ধিক্ষণে জাতির সামনে তারা হয় নায়ক অথবা খলনায়কে চিহ্নিত হয়ে যাবেন। কিছু প্রশাসনিক রদবদল আর কিছু চিহ্নিত এসপি বা ওসি রদবদল হলেই কিন্তু আতঙ্কের রব পড়ে যেত।

কিন্তু শত-সহস্র অপকর্মের অনুঘটকদের নাম চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেও কেন কমিশন সদস্যদের চৈতন্য ফিরছে না- বিস্ময় চোখে জাতি তা অবলোকন করছে। কিছু অনুভূতিহীন কুম্ভকর্ণের জন্য জাতির ভবিষ্যৎ মহাবিপদের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছে। অথচ শান্তিপ্রিয় এ জাতি তাদের কঠোর নিরপেক্ষতা ও পদক্ষেপকে স্বাগত জানাত। বিবেককে বন্ধক রেখে কেউ ইতিহাসের বিচার থেকে রেহাই পায় না, ইতিহাসই তার অনন্য সাক্ষী! দুঃখ লাগে, কিছু মানুষ ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয় না। তাদের জন্যই অপরিণাম ক্ষতি হয় দেশের ধ্বংস হয় সমুজ্জ্বল ভবিষ্যতের।

নির্বাচন কমিশন ১০ দিনের জন্য সেনাবাহিনী মোতায়েনের পরিকল্পনা করেছিল। অথচ এত সন্ত্রাস ও হামলা বেড়ে যাওয়ার প্রেক্ষাপটেও তারা সেটা পরিকল্পনা করে ১০ দিন থেকে ৯ দিনে কমিয়ে এনেছে। উপজেলা পর্যায়ে সেনাবাহিনী নিয়োজিত থাকলেও তাদের নিজস্ব ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা থাকছে না, থাকবে স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে। তাতে মনে হয়, সেনাবাহিনীর অবস্থা অবলোকন ছাড়া কোনো কাজ থাকবে না।

পলাশীর প্রান্তরে নবাব সিরাজউদ্দৌলার এক লাখ সেনাসদস্য ‘স্ট্রাইকিং ফোর্স’ হিসেবেই ছিল। সেনাপতি জাফর আলী খান তাদেরকে ব্যবহার করেনি বলেই বাংলার স্বাধীনতা বিপর্যস্ত হয়েছিল। সরকারের বিশেষ করে প্রচুর ক্ষমতাবান নির্বাচন কমিশনের উচিত বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে এখনি নির্দেশ জারি করে সংশ্লিষ্ট থানায় অস্ত্রগুলো জমা রাখার নির্দেশ জারি করতে। নির্বাচন কমিশনের সম্ভাব্য বিপদগুলোর আগাম সতর্কতা জারি না করলে যেকোনো বিপদ ঘটে যেতে পারে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসহ প্রশাসনিক ‘রিশাফল’ জরুরি হয়ে পড়েছে। তাতে দলীয়করণসহ ষড়যন্ত্রমূলক আনুগত্যের ভিত নড়বড়ে হয়ে পড়বে, নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ার পরিবেশ তৈরি হবে।

কিছুদিন আগে সিপিডি এক কর্মশালায় বলেছে, গত ১০ বছরে প্রায় সাড়ে ২২ হাজার কোটি টাকা বিভিন্ন ব্যাংক থেকে লোপাট হয়ে দেশের বাইরে চলে গেছে। গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি (জিএফআই) বলেছে, বাংলাদেশ থেকে সাড়ে ছয় লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে। তথ্য কোনটা সঠিক আল্লাহ রাব্বুল আলামিনই জানেন। তবে পাচার যে হচ্ছে সেটা সঠিক। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ফিলিপাইনে টাকা রহস্যজনকভাবে বেরিয়ে গেল- সেটার তদন্ত চলছে। আর্থিক অরাজকতা এখন তুঙ্গে।

বেগম খালেদা জিয়ার দুই কোটি টাকা কথিত আত্মসাতের (যা ব্যাংকে সাড়ে ছয় কোটি টাকা দৃশ্যমান) মামলায় পাঁচ বছরের জেল হলে এত টাকার লোপাট বা আত্মসাতের ভবিষ্যৎ মামলায় কত লাখ বছর জেল-জরিমানা হবে, তা ভবিষ্যতই বলে দেবে। তবে ভবিষ্যৎ সরকারে যে বা যারাই আসবে, আর্থিক শৃঙ্খলা অনিয়মই তাদের প্রধানতম কাজ হবে। দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন হোক, ভবিষ্যৎ সমৃদ্ধি জাতিকে আরো শীর্ষে নিয়ে যাক এবং সহকর্মী একটি সমাজ কাঠামো গড়ে উঠুক, এ প্রার্থনাই হোক সবার। পারস্পরিক বিদ্বেষ অনেক ক্ষতি করেছে- এর অবসান হোক।


আরো সংবাদ



premium cement
কলকাতার রাস্তায় চাকরি হারানো শিক্ষকরা শিল্পী-সাংবাদিক দ্বন্দ্ব নিয়ে এলো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত যশোর কারাগারে হাজতিদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, ব্যাপক আতঙ্ক চিকিৎসার জন্য ঢাকা ছাড়লেন বিএনপি নেতা আমীর খসরু কুষ্টিয়াতে মসজিদ কমিটি নিয়ে সংঘর্ষে আহত ৫ চেয়ারম্যান তপন ও অজিত মেম্বারকে ধরিয়ে দিতে পারলে পুরস্কার ঘোষণা নারায়ণগঞ্জে ২৪ ঘণ্টায় ১৪ ডাকাত সদস্য গ্রেফতার রাজশাহীতে মৌসুমের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪২ ডিগ্রি ছাড়াল যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশী শ্রমিকদের ভিসা সহজ করার আহ্বান প্রবাসী প্রতিমন্ত্রীর চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিদ্বন্দ্বী না হয়ে অংশীদার হওয়া উচিত : শি জিনপিং ওকাব সভাপতি নজরুল ইসলাম, সম্পাদক জুলহাস আলম

সকল