মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা অতীতে বিসওয়ালকে ‘দুই আনার মন্ত্রী’ বলে উপহাস করেছিলেন বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন দলের একজন সিনিয়র নেতা। এর আগে তিনি ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মোজিনাকে ‘কাজের বেটি মর্জিনা’ বলে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করেছিলেন। ক্ষমতাসীন দলের একজন দায়িত্বশীল ও জ্যেষ্ঠ নেতার কাছ থেকে এমন অশোভেন মন্তব্য কখনোই কাম্য ছিল না। তার এমন বক্তব্যে দেশে যেমন বিতর্কের ঝড় উঠেছিল, তেমনিভাবে আমরা কূটনৈতিক পর্যায়েও সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছিলাম। প্রশ্ন উঠেছিল আমাদের ভব্যতা ও শিষ্টাচার নিয়েও।
সরকারি দলের একজন শীর্ষ নেতা এমন মন্তব্য করে নিজের ব্যক্তিত্ব ও পদমর্যাদার প্রতি সুবিচার করেননি বলেই মনে করেন বেশির ভাগ মানুষ। কেউ কেউ মনে করেন, তিনি বহির্বিশে^ আমাদের অভদ্র ও অশিষ্টাচারী জাতি হিসেবে উপস্থাপন করেছিলেন। সরকার পক্ষে অবশ্য তাকে এই বলে ধন্যবাদ দেয়া হয়েছিল যে, তিনি বীরোচিত কাজটিই করেছিলেন। কিন্তু কাউকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করার মধ্যে বীরত্ব নেই। আর তা আমাদের ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও জাতীয় শক্তি-সামর্থ্যরে ক্ষেত্রেও মোটেই অনুকূল নয়। আধুনিক বিশ্বব্যবস্থা ও আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রেও তা মোটেই সঙ্গতিপূর্ণও নয়।
আমরা কেউই এই মুদ্রাদোষ থেকে মুক্ত হতে পারছি না। বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের মধ্যে ধরাকে সরাজ্ঞান করার একটা প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। ‘মুই কে হনুরে’ ধরনের অহংবোধ তাদেরকে পেয়ে বসেছে। কাউকে ছোট করে নিজেরা যে বড় হওয়া যায় না, এই উপলব্ধি তাদের মধ্যে লক্ষ করা যাচ্ছে না। কারো বক্তব্য মনঃপূত না হলে তির্যক ভাষায় তার শ্রাদ্ধ করার ঘটনা আমাদের দেশে এটাই প্রথম নয়। এর আগে দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন তোলায় সরকারের একজন মন্ত্রী অ্যামেনেস্টি ইন্টারন্যাশনালকে ঝাঁটাপেটা করার ঘোষণা পর্যন্ত দিয়ে ছিলেন। মন্ত্রী প্রবরের এমন ঘোষণা বীরোচিত, না কাপুরুষোচিত বা নারীসূলভ হয়েছিল তা নির্ধারণের ভার খোদ তাদের ওপরই ন্যস্ত করা শ্রেয়! তবে এ কথা সত্য যে, বিষয় প্রতিপক্ষের ওপর ঝাঁটা প্রয়োগের প্রমীলাদের সাথে সম্পর্কিত।
আমাদের দেশের গণতন্ত্র, আইনের শাসন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, বিরোধী দলের প্রতি অগণতান্ত্রিক আচরণ, গুম, গুপ্তহত্যা, নারীর প্রতি সহিংসতা, মানবাধিকার পরিস্থিতি, প্রভৃতি নিয়ে কূটনৈতিক মহল ও মানবাধিকার সংস্থাগুলো সব সময় সোচ্চার ছিল এবং এখনো আছে। কিন্তু ক্ষমতাসীনদের এ বিষয়ে কোনো উপলব্ধির সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে হয় না। কারণ, তারা কখনোই সমস্যার গভীরে যাওয়ার চেষ্টা করেননি কিংবা এসব সমস্যা সমাধানে তাদের কোনো আন্তরিকতা লক্ষ করা যায়নি। বরং এসব বিষয়ে সমালোচকদের বিরুদ্ধে সরকারের তরফে তীব্র প্রতিক্রিয়া এবং অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অনাকাক্সিক্ষত হস্তক্ষেপ বলে দাবি করে দায়দায়িত্ব শেষ করার প্রবণতা।
কোনো ক্রিয়ার প্রতিক্রিয়া দেখানোর অধিকার প্রত্যেকেরই থাকে। বিশেষত, গণতান্ত্রিক ও সভ্যসমাজে তা স্বীকৃত পন্থা। গণতন্ত্রের অন্যতম মূলমন্ত্র জনগণের শাসন ও ব্যক্তির অবাধ বাকস্বাধীনতা। কিন্তু এসব বিষয়ে প্রতিক্রিয়ার উপস্থাপনা, ভাষার প্রয়োগ ও শব্দচয়ন হতে হয় যথাযথ। কারো কোনো অভিযোগেরই আমরা যৌক্তিক বা তথ্য, উপাত্ত ও অকাট্য প্রমাণাদির ভিত্তিতে খণ্ডন করছি না। বরং ‘অভিযোগ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ বলেই সব দায়দায়িত্ব শেষ করা হচ্ছে। এমনটা গণতান্ত্রিক ও সভ্য সমাজের বৈশিষ্ট্য নয়।
সম্প্রতি খুলনা ও গাজীপুর সিটি করপোরেশনের নির্বাচন নিয়ে রাজনীতিতে নতুন করে উত্তাপ ছড়িয়েছে। এর সাথে নতুন করে যুক্ত হয়েছে রাজশাহী, বরিশাল ও সিলেট সিটির নির্বাচন। এসব নির্বাচন কেমন হয়েছে- সরকার, বিরোধী দল, আইনশৃঙ্খলাবাহিনী ও নির্বাচন কমিশন এসব নির্বাচনে কী ভূমিকা পালন করেছে বা জনমতের কতটুকু প্রতিফলন ঘটেছে তা সবার জানা। ইইউ-সহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো নির্বাচনের নিরপেক্ষতা ও গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। বিদায়ী মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাট বিশেষ করে গাজীপুর সিটি নির্বাচনের অবাধ ও নিরপেক্ষতার বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছেন এবং নির্বাচনগুলো যাতে অবাধ, সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক হয় সে বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
সরকার ও নির্বাচন কমিশন মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সমালোচনা করেছে। তবে এবারের সমালোচনা আগের তুলনায় কিছুটা হলেও শালীন। অন্তত মার্শা ‘কাজের বেটি’ হওয়া থেকে আপাতত রেহাই পেয়েছেন। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সরকারের অবস্থানের কোনো পরিবর্তন আসেনি। সদ্যসমাপ্ত নির্বাচনে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মহল যেসব অনিয়ম ও সমস্যার কথা উল্লেখ করেছে, সেসব বিষয়ে সরকারের কোনো জবাব নেই। তারা অভিযোগ ভিত্তিহীন বলেই দায়দায়িত্ব শেষ করতে চেয়েছে। অভিযোগ অনুযায়ী ব্যবস্থা অথবা অথবা অভিযোগ খণ্ডনের জন্য কোনো কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি।
সরকারের পক্ষে দলীয় সাধারণ সম্পাদক মার্কিন রাষ্ট্রদূতের ওই বক্তব্য ‘অনাকাক্সিক্ষত ও তা দু’দেশের মধ্যে সুসম্পর্কের ক্ষেত্রে বিঘœ সৃষ্টি করবে’ বলে উল্লেখ করেছেন। নির্বাচন কমিশনের পক্ষে রাষ্ট্রদূতের এ ধরনের বক্তব্যের এখতিয়ার নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়েছে।
এখানে লক্ষণীয় হলো- সরকার বা নির্বাচন কমিশন মার্কিন রাষ্ট্রদূতের অভিযোগের সত্যাসত্য নিয়ে কোনো মন্তব্য করেননি বা বক্তব্য সঠিক নয়Ñ এমন বক্তব্য শোনা যায়নি। সরকার ও নির্বাচন কমিশনের ভাষা ও শব্দচয়নে মনে হয়েছে তাদের বিশ্বাস নির্বাচন যেভাবেই হোক না কেন এসব আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়। তাই এসব নিয়ে বাইরের রাষ্ট্র বা সংস্থার মন্তব্য করার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু এ কথাও স্মরণ রাখতে হবে, অভ্যন্তরীণ বিষয়ের কথা বলে যেমন নিজের সন্তানকে হত্যা করার অধিকার থাকতে পারে না তেমনিভাবে নিজের ঘরে নিজেই আগুন দেয়াও বৈধতা পেতে পারে না। মূলত, সুশাসনের অনুপস্থিতিই আমাদের জাতির ভাগ্য বিড়ম্বনার অন্যতম কারণ। তাই দেশকে বাইরের রাষ্ট্রের উপদ্রব থেকে মুক্ত রাখতে হলে গণতন্ত্র, সুশাসন ও জাতীয় ঐক্যের কোনো বিকল্প নেই।
অবশ্য আমাদের দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে কথা বলা নতুন কিছু নয়। আমরা নিজেরাও এ জন্য কম দায়ী নই। এ জন্য ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতাহীন উভয় পক্ষই দায়ী। অবাধ গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার জন্য আমরা স্বাধীনতা অর্জন করলেও পাঁচ দশক অতিক্রান্ত হওয়ার পরও গণতন্ত্রের লড়াই যে আর কত দীর্ঘায়িত হবে বা এই লড়াই কখনো শেষ হবে কি না তা-ও নিশ্চিত নয়। মূলত, স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে আমাদের দেশে যতবারই রাজনৈতিক সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে তার প্রায় সবই গণতন্ত্র ও ভোটাধিকারকে কেন্দ্র করেই। কিন্তু সেসব সঙ্কট নিজেরা সমাধান করতে ব্যর্থ হয়েছি। আজ যারা নিজেদের অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে অনেক রূঢ় বাস্তবতাকে ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করছেন তারাও সঙ্কট সমাধানে বিদেশীদের দ্বারস্থ হয়েছিলেন।
আমাদের ব্যর্থতার কারণেই কমনওলেথ মহাসচিবের বিশেষ দূত স্যার নিনিয়ান মার্টিন স্টিফেনকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানে সালিস মানা হয়েছিল। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে জাতিসঙ্ঘের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোর দূতিয়ালির কথা কেউ বিস্মৃত হয়নি। মূলত, অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে অস্থিতিশীলতা, ভঙ্গুর গণতান্ত্রিক চর্চা, জাতীয় অনৈক্য, আইন ও সাংবিধানিক শাসনের অনুপস্থিতি এবং সুস্থধারার রাজনীতি চর্চার অভাবেই এসব উপসর্গ জাতীয় জীবনে স্থায়ীভাবে বাসা বেঁধেছে। তাই তো আমাদের বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্র আমাদের দেশের ‘সংবিধান রক্ষা’র দায়িত্ব নিচ্ছে এবং আগামী নির্বাচন ‘অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ’ হবে বলে তাদের কাছে থেকে প্রতিশ্রুতি শুনতে হচ্ছে। দুঃখজনক যে, আমরা কেউই এ ধরনের বক্তব্য অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ বলে দাবি করছি না বরং সে বক্তব্যকে ভিত্তি ধরেই আবর্তিত হচ্ছে এ দেশের গণতন্ত্র ও সরকার গঠনের ভবিষ্যৎ।
গাজীপুর সিটি করপোরেশনের নির্বাচন নিয়ে মার্কিন দূতের বক্তব্যে সরকারের প্রতিক্রিয়ার পর দূতাবাসও প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। বলা হয়েছে, নির্বাচন নিয়ে মার্শার বক্তব্য তার ব্যক্তিগত নয়, বরং মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর তথা মার্কিন সরকারেরই অভিব্যক্তি। মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টও বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। বার্নিকাটও আত্মপক্ষ সমর্থন করে বলেছেন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং নির্বাচন নিয়ে তিনি যা বলেছেন তা তার ব্যক্তিগত মতামত নয়। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানই জানিয়েছেন। বার্নিকাটের ভাষায়- সমালোচনা গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। এটা বাকস্বাধীনতার অংশ।
সরকারের প্রত্যুত্তরে মার্কিন রাষ্ট্রদূত বা প্রশাসন যে বক্তব্য দিয়েছে তার মধ্যে কোনো তীব্রতা ছিল না বরং যৌক্তিকতা ও বুদ্ধিমত্তাই প্রাধান্য পেয়েছে। তারা বিষয়টিকে গণতান্ত্রিক অধিকার বলে দাবি করেছেন। মার্কিন প্রশাসনের পক্ষে বলা হয়েছে, নির্বাচনের অনিয়ম নিয়ে কথা বলা যেমন গণতান্ত্রিক অধিকার রয়েছে, ঠিক তেমনি বাংলাদেশ সরকার বা নির্বাচন কমিশনের প্রত্যুত্তরও গণতান্ত্রিক অধিকারের আওতায় পড়ে।’ এটাকেই মার্কিন রাষ্ট্রদূত ‘গণতন্ত্রের সৌন্দর্য’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। কিন্তু গণতন্ত্রের জন্য দীর্ঘ সংগ্রামের পরও আমরা তার সৌন্দর্য অনুধাবন করতে পারলাম না, মূলত এটি আমাদেরই ব্যর্থতা। আর এ ব্যর্থতা যত দিন না আমরা দূর করতে পারছি তত দিন আমরা ভালো কিছু আশা করতে পারি না।
গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটলের মতে, ‘রাষ্ট্র হলো কয়েকটি পরিবার ও গ্রামের সমষ্টি, যার উদ্দেশ্য- স্বয়ংসম্পূর্ণ জীবন।’ মার্কিন প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসনের ভাষায়, ‘মানবজাতির অংশবিশেষকে সংগঠিত ও ঐক্যবদ্ধভাবে দেখা গেলে তাকে রাষ্ট্র বলে।’ ব্রুন্টস লি বলেন, ‘কোনো নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত জনসমাজই রাষ্ট্র।’ তাই রাষ্ট্রকেই অভ্যন্তরীণ সব সমস্যার সমাধান করতে হবে। নিজেরা নিজেদের সমস্যার সমাধান না করে এবং জাতিকে বিভক্ত রেখে কারো ওপর দোষ চাপানোর মধ্যে কোনো কল্যাণ নেই। এ বিষয়ে আমরা যত দিন নিষ্ক্রিয় থাকব বার্নিকাটরা ততই সরব হয়ে উঠবেন। ‘অভ্যন্তরীণ’ বিষয়ের কথা বলে বৈদেশিক উপদ্রব ঠেকানো কোনোভাবেই সম্ভব হবে না।
smmjoy@gmail.com
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা