২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ব্যস্ততার কেন্দ্রে কোরবানির পশু

-

দু’দিন পরেই পবিত্র ঈদুল আজহা। মুসলমানদের সর্ববৃহৎ এ উৎসব ঘিরে সারাদেশ এখন উৎসবমুখর। ছেলে-বুড়ো প্রত্যেকের মাথায় এখন কোরবানির পশু। কোরবানির অংশীদার ঠিক করা। দল বেঁধে হাটে যাওয়া। দিনরাত পছন্দ করে পশু কেনা। কোরবানির জন্য ক্রয়কৃত পশুর যতœ-আত্মী। দা-বটিতে ধার দেয়া। কসাই ঠিক করাসহ সবই যেন ব্যবস্থার অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ঈদের দিনক্ষণ যতই ঘনিয়ে আসছে ততই বাড়ছে ব্যস্ততা। কোরবানির পশু বেচাকেনার কারণে জমজমাট হয়ে উঠেছে ঢাকাসহ সারা দেশের হাটগুলো। কৃষক তার সারা বছরের যতেœ লালন করা পশুটি নিয়ে এসেছেন হাটে। নিজে না খেয়েও পশুকে খাবার কিনে খাইয়েছেন তিনি। এখন তিনি আশা করছেন পশুটির উপযুক্ত দাম পাবেন। ঘুচিয়ে নেবেন নিজের কষ্ট। যদিও পাশের দেশ থেকে গরু আসছে দলে দলে। দাম নিয়ে কৃষকের রয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া।
এবারের ঈদুল আজহা উপলক্ষে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন সাতটি পশুর হাট বসানোর অনুমোদন দিয়েছে। এ ছাড়া এই সিটি এলাকায় আরো ছয়টি পশুর হাট বসছে, যদিও এসব হাটের ইজারা দেয়া হয়নি। অনুমোদিত ও অননুমোদিত মিলিয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় মোট ১৩টি পশুর হাট বসেছে। অপর দিকে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এবার গাবতলী স্থায়ী পশুর হাটসহ মোট ১০টি পশুর হাট বসানোর অনুমোদন দিয়েছে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের তথ্য অনুযায়ী, ইজারা দেয়া সাতটি হাট হচ্ছে মেরাদিয়া বাজার সংলগ্ন খালি জায়গা, উত্তর শাজাহানপুর খিলগাঁও রেলগেট বাজারের মৈত্রী সঙ্ঘের মাঠ সংলগ্ন খালি জায়গা, জিগাতলার হাজারীবাগ মাঠ সংলগ্ন খালি জায়গা, রহমতগঞ্জ খেলার মাঠ সংলগ্ন খালি জায়গা, কামরাঙ্গীরচর ইসলাম চেয়ারম্যানের বাড়ির মোড় থেকে দক্ষিণ দিকে বুড়িগঙ্গা নদীর বাঁধসংলগ্ন খালি জায়গা, পোস্তগোলা শ্মশানঘাট সংলগ্ন খালি জায়গা ও শ্যামপুর বালুর মাঠ সংলগ্ন খালি জায়গা। আর ইজারা ব্যতীত দক্ষিণ সিটি এলাকায় ছয়টি পশুর হাট বসেছে। সেগুলো হচ্ছেÑ ৩২ নম্বর ওয়ার্ডের সামসাবাদ মাঠ সংলগ্ন সিটি করপোরেশনের খালি জায়গা, কমলাপুর লিটল ফ্রেন্ডস ক্লাব সংলগ্ন বালুর মাঠ ও কমলাপুর স্টেডিয়াম সংলগ্ন বিশ্বরোডের আশপাশের খালি জায়গা, শনির আখড়া ও দনিয়া মাঠ সংলগ্ন আশপাশের খালি জায়গা, ধূপখোলা মাঠ সংলগ্ন আশপাশের খালি জায়গা, ৪১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউয়ার টেক মাঠ সংলগ্ন আশপাশের খালি জায়গা, গোলাপবাগ মাঠ সংলগ্ন আশপাশের খালি জায়গা, দাওকান্দি ইন্দুলিয়া ভাগ্যপুর নগর (মেরাদিয়া মৌজা) লোহারপুলের পূর্ব অংশ ও খোলা মাঠ সংলগ্ন আশপাশের খালি জায়গা এবং ডেমরা আমুলিয়া মডেল টাউন ও আশপাশের খালি জায়গা।
এ দিকে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকায় গাবতলী স্থায়ী পশুর হাট ছাড়াও অস্থায়ী ৯টি হাট বসানো হয়েছে। হাটগুলো হচ্ছে উত্তরা ১৫ নম্বর সেক্টরের ২ নম্বর ব্রিজের পশ্চিমে গোলচত্বর পর্যন্ত সড়কের উভয় পাশের ফাঁকা জায়গা, মিরপুর ডিওএইচএসের উত্তর পাশের সেতু প্রপার্টি সংলগ্ন খালি জায়গা, মিরপুর সেকশন-২ (ইস্টার্ন হাউজিং)-এর খালি জায়গা, মোহাম্মদপুর বুদ্ধিজীবী সড়ক সংলগ্ন (বছিলা) পুলিশ লাইনের খালি জায়গা, খিলক্ষেত বনরূপা আবাসিক প্রকল্পের খালি জায়গা, ৩০০ ফুট রাস্তার পাশে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার খালি জায়গা, ভাটারা (সাঈদ নগর) হাট, তেজগাঁও শিল্প এলাকার পলিটেকনিক্যাল কলেজ মাঠ ও উত্তরখান হাট।
গরু আসছে অবৈধ পথে
ঈদুল আজহা উপলক্ষে সিলেটের বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে বানের পানির মতো অবৈধপথে ভারত থেকে আনা হচ্ছে গরু। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি গরু আসছে সিলেটের অন্যতম পর্যটন এলাকা গোয়াইনঘাটের বিছনাকান্দি সীমান্ত দিয়ে। সীমান্ত পেরোনোর পর গরুগুলো কিছুটা নৌপথ এবং কিছুটা সড়কপথ ভ্রমণ শেষে সিলেট নগরে ঢুকছে করছে।
স্থানীয়রা জানান, বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে নিয়ে আসা গরুর একটা ছোট অংশ বিজিবি আটক করে নিয়ে যায় নিকটবর্তী করিডোরে। সেখানে ৫০০ টাকা রাজস্ব প্রদান করে সেগুলোকে বৈধ করিয়ে নেয়া হয়। তবে প্রতিদিন আসা গরুর বড় অংশই কোনো রাজস্ব না দিয়ে অবৈধভাবে দেশে নিয়ে আসা হয়। গোয়াইনঘাটের বিছনাকান্দি ছাড়াও একই উপজেলার পাংথুমাই, জাফলং, বিয়ানীবাজার উপজেলার শ্যাওলা, সুনামগঞ্জের বড়ছড়াসহ কয়েকটি সীমান্ত দিয়ে অবৈধ পথে গরু আসছে।
কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেট, সিলেটের কমিশনার ড. মো: শফিকুল ইসলাম জানান, গত বছর থেকে সিলেটের কোম্পানীগঞ্জের ভোলাগঞ্জের মাঝেরগাঁও, হবিগঞ্জের বাল্লা ও সুনামগঞ্জের ছাতকে গরু আমদানির জন্য করিডোর উন্মুক্ত করে রাজস্ব বিভাগ। অথচ করিডোরের চেয়ে অবৈধ পথেই বেশি গরু আসছে। আর সীমান্ত দেখভালের দায়িত্ব তো আমাদের নয়। তাই আমরা এগুলো ঠেকাতে পারছি না।
তিনি বলেন, অনেক সময় অবৈধভাবে প্রবেশ করা গরু বিজিবি আটক করে আমাদের স্থানীয় অফিসে নিয়ে যায়। কাস্টমস কর্মকর্তা নির্ধারিত অঙ্কের জরিমানা আদায় করে গরুর গায়ে একটি সিল মেরে বৈধতা প্রদান করেন।
কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেট সূত্র জানায়, ভারত বৈধভাবে বাংলাদেশে গরু রফতানি করে না। তবুও প্রতি বছর ঈদুল আজহার আগে সিলেটের সীমান্তগুলো দিয়ে অসংখ্য গরু ভারত থেকে আসে। এসব গরু আমদানি বন্ধ করতে না পেরে গত বছর সিলেটের বিভিন্ন সীমান্তে চারটি করিডোর খোলা হয়েছে। এসব করিডোর দিয়ে আনা গরু মাত্র ৫০০ টাকা রাজস্ব প্রদানের মাধ্যমে দেশে প্রবেশের বৈধতা দেয়া হয়। তবে চোরাকারবারিরা এই টাকা ফাঁকি দেয়ার জন্য করিডোর দিয়ে না এনে অন্য সীমান্ত দিয়ে অবৈধভাবে গরু নিয়ে আসছে। এই চোরাচালানে বিজিবির স্থানীয় দায়িত্বশীলেরা জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে।
এ বিষয়ে বিজিবি ৪৮ ব্যাটেলিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল মহসেনুল হক কবির বলেন, করিডোর দিয়ে নির্ধারিত রাজস্ব প্রদান করেই গরু বাংলাদেশে আসছে। করিডোরের বাইরে কোনো সীমান্ত দিয়ে গরু আসছে না। সীমান্তে বিজিবির কড়া নজরদারি রয়েছে। অবৈধভাবে কোনো গরু নিয়ে এলে বিজিবি তা জব্দ করে নিকটবর্তী রাজস্ব কার্যালয়ে হস্তান্তর করে। এরপর রাজস্ব বিভাগের কর্মকর্তারা জরিমানা করে গরুগুলো ছেড়ে দেন।
ব্যস্ততা বেড়েছে কামারশালায়
কোরবানি ঈদ সামনে রেখে এখন ব্যস্ত সময় পার করছেন রাজধানীর কামাররা। দিনরাত পরিশ্রম করছেন এসব কারিগর। দা, বটি, ছুরি, চাকু তৈরি এবং পুরনো অস্ত্রে শাণ দিতে তারা এখন দারুণ ব্যস্ত। কোরবানি ঈদে এসবের প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি। পশু কোরবানিকে কেন্দ্র করে এ সময় রাজধানী ঢাকাসহ প্রত্যন্ত জনপদের কামারপল্লীগুলো অনেকটাই ব্যস্ত সময় পার করা শুরু করেছে। লাল টকটকে আগুনে গরম লোহায় কামার ওস্তাদ-সাগরেদদের পেটাপিটিতে মুখর হয়ে উঠেছে কামারশালা। ঈদের সময় ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে আবার এসব ধাতব সরঞ্জামাদিতে শাণ দিতে কামারের সঙ্গে সঙ্গে শাণের দোকানগুলোতেও ভিড় ক্রমেই বাড়ছে। ভ্রাম্যমাণ শাণদানিদেরও অনেক ভালো সময় কাটে এই মওসুমে।
রাজধানীর অন্যতম বৃহৎ পাইকারি কাঁচাবাজার কারওয়ান বাজারের কামারশালাগুলোর ব্যস্ততা এখন সবচেয়ে বেশি। ঈদে হাজার হাজার গরু, খাসি, ভেড়া, মহিষ, উট, দুম্বা ইত্যাদি পশু কোরবানি করা হয়ে থাকে। এসব পশু জবাই থেকে শুরু করে রান্নার চূড়ান্ত প্রস্তুতি দা-বটি, ছুরি-ছোরা, চাপাতি ইত্যাদি ধাতব হাতিয়ার ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
এ দিকে ঈদের আগেই পশু জবাই করার ছুরি, চামড়া ছাড়ানোর ছুরি, চাপাতি, প্লাস্টিক ম্যাট, চাটাই, গাছের গুঁড়িসহ সবকিছু প্রস্তুত রাখতে ক্রেতারা ছুটতে শুরু করেছেন হাটের দিকে। ছুরি বা চাপাতির কামারশালা ছাড়াও চাটাই ও গাছের গুঁড়িও মিলছে রাজধানীর হাটে। এ বিষয়ে কারওয়ান বাজারের মা জননী ভোলা কর্মশালের দোকানের কর্ণধার সালাহ উদ্দিন বলেন, এ শিল্পের প্রধান উপকরণ লোহা, ইস্পাত ও কয়লার দাম বেড়ে যাওয়ায় কামারেরা সারা বছর কিছুটা সঙ্কটে থাকলেও প্রতি বছর কোরবানির ঈদের মওসুমে ব্যবসা মোটামুটি ভালো হয়।

 


আরো সংবাদ



premium cement