২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

এত চাল গেল কোথায়!

-

খাদ্য বিভাগের তথ্যানুযায়ী দেশে প্রতি বছর চালের চাহিদা সোয়া তিন কোটি টন। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্যানুযায়ী, বোরো-আমন মিলিয়ে এ বছর দেশে চালের উৎপাদন হয়েছে সোয়া তিন কোটি টনের বেশি। এর পরও বিদেশ থেকে এ পর্যন্ত আমদানি করা হয়েছে ৪০ লাখ টন চাল। আরো ৪৫ লাখ টন চাল আমদানির প্রক্রিয়া হয়ে আছে। আন্তর্জাতিক বাজারেও চালের দাম কমেছে প্রতি টনে চার টাকা। এত কিছুর পরও দেশের বাজারে চালের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। প্রশ্ন উঠেছে, এত চাল গেল কোথায়? অযৌক্তিক এ মূল্যবৃদ্ধির জন্য খুচরা বিক্রেতারা দুষছেন পাইকারদের। আর পাইকারি বিক্রেতারা দায়ী করছেন মিল মালিকদের। মিল মালিকদের দাবি, সরকার নিজেই শুল্ক আরোপের মাধ্যমে পরিকল্পিতভাবে চালের দাম বাড়াচ্ছে। এ প্রশ্নে সরকারের অবস্থান, সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে কৃষকের স্বার্থে। যদিও সরকারের নীতিনির্ধারকেরা ভালো করেই জানেন, চালের মূল্যবৃদ্ধির সুফল কখনো কৃষক ভোগ করতে পারে না। এ সুযোগে আঙুল ফুলে কলাগাছ হচ্ছে মধ্যস্বত্বভোগীরা। পরিস্থিতির শিকার হচ্ছে তিন থেকে চার কোটি মানুষ, যারা প্রতিদিনই বাজার থেকে চাল কিনে খান।
রাজধানী ঢাকার কয়েকটি পাইকারি ও খুচরা বাজার ঘুরে দেখা যায়, গত এক সপ্তাহে খুচরাপর্যায়ে প্রতি কেজি চালের দাম চার থেকে পাঁচ টাকা বেড়েছে। পাইকারি বাজারে দাম বেড়েছে তিন থেকে চার টাকা। কেজিতে দুই থেকে তিন টাকা দাম বাড়িয়েছেন মিল মালিকরা। এর অর্থ দাঁড়ায় মিল মালিকরা দাম যা বাড়িয়েছেন পাইকারি আড়তদাররা বাড়িয়েছেন তার চেয়ে বেশি। খুচরা বিক্রেতারা বাড়িয়েছেন পাইকারদের চেয়েও বেশি। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর হলো, শুল্কমুক্ত উপায়ে আমদানি করে মজুদ রাখা লাখ লাখ টন চালের দাম আমদানিকারকেরা কোনো কারণ ছাড়াই বাড়িয়ে দিয়েছে। সেই সুযোগে মিল মালিকরাও দেশী চালের দামও বাড়িয়ে দিয়েছেন। অথচ যে কৃষকের স্বার্থের কথা ভেবে চাল আমদানির ওপর শুল্ক আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছে তাদের ঘরে কোনো ধান নেই। ধান চলে গেছে মধ্যস্বত্বভোগী ও মিলমালিকদের নিয়ন্ত্রণে।
সমস্যার মূলে সরকারি উদ্যোগ
বিভিন্ন পর্যায়ের পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নতুন ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেটে আমদানি শুল্ক ২৮ শতাংশ পুনর্বহালের পর থেকেই আমদানিকারক ও মিল মালিকরা চালের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। সাথে যুক্ত হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি প্রজ্ঞাপন। গত ২৬ জুন জারি করা ওই প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, কোনো অবস্থায়ই শূন্য মার্জিনে অর্থাৎ বাকিতে চাল আমদানির এলসি (ঋণপত্র) স্থাপন করা যাবে না। এতে আরো বলা হয়, ধান ও চাল ব্যবসায়ীদের ঘূর্ণায়মান ঋণের ক্ষেত্রে ৪৫ দিন পর অবশ্যই পুরো টাকা শোধ করতে হবে। আগে ৩০ দিনের মধ্যে ঋণ সমন্বয়ের সুযোগ ছিল। ঋণপত্র খুলতে ব্যবসায়ীদের এখন ৪৫ দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। চাল আমদানি বাড়াতে ২০১৭ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বিনা মার্জিনে ঋণপত্র খোলার সুযোগ ছিল। এখন নগদ টাকা নিয়ে ঋণপত্র খুলতে হচ্ছে ব্যবসায়ীদের।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, আগে চাল আমদানির ওপর কোনো শুল্ক ছিল না। এলসি খুলতে এত দিন কোনো টাকাই লাগত না। সমানে আমদানি হয়েছে, দামও কিছুটা সহনীয় ছিল। নতুন বাজেটে আমদানির ওপর ২৮ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। স্বাভাবিক কারণেই আমদানি প্রায় বন্ধ। সুযোগ বুঝে মিলের মালিকরা দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। স্বাভাবিক কারণেই পাইকারি ও খুচরা বাজারে চালের দাম বাড়ছে। বাজেট ঘোষণার পর থেকেই চালের দাম ধীরে ধীরে বাড়ছে জানিয়ে তারা বলেন, এত দিন অনেকে মনে করেছিলেন বাজেট পাসের আগে এ বিষয়ে কিছুটা হলেও সংশোধনী আনা হবে। কিন্তু সংশোধনী ছাড়াই বাজেট পাস হলে নতুন করে দাম বেড়েছে কেজিতে তিন থেকে চার টাকা।
সরকারি দাবির বাস্তবতা
খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলামের দাবি, ‘শুল্কমুক্ত সুবিধায় চাল আমদানি বেশি হওয়ায় কৃষক ধানের দাম পাচ্ছিল না। এমন কথা আপনারা পত্রিকায় লিখেছিলেন। কৃষক যাতে ভালো দাম পায়, সে জন্য আমরা আবার শুল্ক আরোপ করেছি। তাই চালের দাম দু-এক টাকা বাড়তেই পারে। এতে অসুবিধা কী? কৃষক তো ভালো দাম পাচ্ছে।’ অথচ বাংলাদেশকে নিয়ে করা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কৃষিবিষয়ক সংস্থা ইউএসডিএর সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ সরকার প্রতি কেজি ধানের সংগ্রহ মূল্য নির্ধারণ করেছে ২৪ টাকা। কিন্তু বাজারে মানভেদে প্রতি কেজি ধান ১৭ টাকা ৫০ পয়সা থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ২২ টাকা ৫০ পয়সা করে বিক্রি হচ্ছে। অর্থাৎ বাজারে কৃষকের পণ্য ধানের দাম কম। প্রক্রিয়াজাত পণ্য হিসেবে চালের দাম অনেক বেশি। অর্থাৎ লাভের বড় অঙ্কই যাচ্ছে মধ্যস্বত্বভোগীদের পকেটে।
নতুন আমদানিকারকদের জন্য!
প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, দেশে এ বছর চালের চাহিদা সোয়া তিন কোটি টনের মতো। অথচ জোগান আছে প্রায় চার কোটি টন। লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে এবার বোরো ধান উৎপাদন হয়েছে প্রায় দুই কোটি টন। আমন উৎপাদন হয়েছে প্রায় দেড় কোটি টন। গত এক বছরে আমদানি করা হয়েছে প্রায় ৩৮ লাখ টন চাল। আরো ৪৫ লাখ টনের এলসি খোলা হয়েছে বাজেটকে মাথায় রেখে। মূলত বাজেটে চাল আমদানির ওপর শুল্ক আরোপ করা হচ্ছে এমন সংবাদটি যারা আগেই জানতে পেরেছিলেন, এলসি খোলার ক্ষেত্রে তারা রয়েছেন অগ্রবর্তী পর্যায়ে। অভিযোগ রয়েছে, জীবনে কোনো চালের ব্যবসায়ের সাথে যুক্ত ছিলেন না এমন অনেকেই এবার চাল আমদানিকারকের খাতায় নাম লিখিয়েছেন। অভিযোগ রয়েছে, নতুন আমদানিকারকদের বাড়তি লাভের সুযোগ করে দিতেই সরকার বাজারের ওপর কোনোরূপ হস্তক্ষেপ করা থেকে বিরত রয়েছে।
দুই মন্ত্রীর ভিন্ন তথ্য
এ দিকে চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরে চাল আমদানি নিয়ে জাতীয় সংসদে ভিন্ন ভিন্ন তথ্য দিলেন বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ ও খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম। সংসদ অধিবেশনে প্রশ্নোত্তরে সরকারি দলের সংসদ সদস্য হাবিবুর রহমানের প্রশ্নে তোফায়েল আহমেদ বলেন, গত ২৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ২২ লাখ ৩৮ হাজার মেট্রিন টন চাল আমদানি করা হয়েছে। অন্য দিকে সরকারি দলের আরেক সংসদ সদস্য শেখ মো: নুরল হকের প্রশ্নের জবাবে খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম বলেন, চলতি অর্থবছরে ১৫ লাখ মেট্রিন টন চাল আমদানির লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। এর মধ্যে ৮ লাখ মেট্রিক টন দেশের বন্দরে এসে পৌঁছেছে। দেশে বর্তমানে খাদ্য ঘাটতি নেই বলেও খাদ্যমন্ত্রী দাবি করেন।
বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের অবস্থান
অন্য কোনো ক্ষেত্রে না হলেও সাম্প্রতিক ঘটনাবলির প্রেক্ষিতে চালের বিশ্ববাজারে বাংলাদেশ যে একটি শক্তিশালী অবস্থান দখল করে আছে সেটি টের পেয়েছেন বাণিজ্য বিশ্লেষকেরা। অবস্থান এতটাই পোক্ত, বাংলাদেশ সরকার আমদানির ওপর ২৮ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেয়ার তিন সপ্তাহের মধ্যে বিশ্ববাজারে চালের দাম প্রতি টনে ৩৫ ডলার কমে গেছে। বিশ্ববাজারে এখন প্রতি টন চালের দাম ৪০০ ডলারের নিচে। গত দুই বছরে প্রথম এমন দরপতন হলো। কারণ হিসেবে বিশ্লেষকেরা বলছেন, বাংলাদেশ এখন বিশ্বের প্রথম আমদানিকারক। গত এক বছরে বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়েছে ৪০ লাখ টন চাল। আমদানির প্রক্রিয়াসম্পন্ন হয়ে আছে আরো ৪৫ লাখ টনের। বাংলাদেশে ব্যবসায়ীরা ভারত, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম ও মিয়ানমার থেকে এসব চাল আমদানি করেন। এর মধ্যে ভারত থেকে আনা হয় ৩০ লাখ টন।


আরো সংবাদ



premium cement