২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

সহনশীলতা শান্তি আনে

-


স্বাধীনতাবিহীন বুদ্ধিমত্তা যেমন Gulag Archipelago [আলেকজান্ডার সোলজেনিৎসিনের উপন্যাসে বর্ণিত দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকালীন স্টালিনের বন্দিশালা]-তে পরিণত হয় তেমনি প্রেমবিহীন বুদ্ধিমত্তা পরিণত হয় Auschwitz [একই সময়কার হিটলারের বন্দিশালা]-এ, প্রেমবিহীন স্বাধীনতা যেমন সমাজে শোষণ-বঞ্চনার দ্বার খুলে দেয়, বুদ্ধিমত্তাবিহীন স্বাধীনতা তেমনি আত্মসংহারের পথ খুলে দেয়।
আধুনিক বিশ্বের প্রতিটি শিল্পোন্নত দেশেই ইদানীং প্রকট দুর্ব্যবস্থার চিত্র ফুটে উঠেছে। এসব দেশে 'Green' সম্প্রদায়ের পরিবেশ সংরক্ষণবাদী আন্দোলনের মাধ্যমে তার বাস্তব চিত্রটি ফুটে উঠছে। যে ‘যন্ত্রশিল্প’ তাদের সম্পদ আর প্রাচুর্যের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দিলো তা যেন আজ ক্রমেই ‘যন্ত্রদানব’-এ রূপ নিচ্ছে। এ সভ্যতা তাদের সামাজিক স্বাধীনতা এনে দিলেও মুক্ত-নির্মল বাতাসে শ্বাস নেয়ার স্বাধীনতাকে যেন ক্রমেই কোণঠাসা করে ফেলছে। তাই তারা আজ সম্পদ, প্রাচুর্য আর স্বাধীনতার বিকল্প ব্যবস্থার কথা ভাবছে। এই সাধারণ দুর্ব্যবস্থা পাশ্চাত্যের তরুণ সমাজের ওপর তার বিশেষ বিশেষ যন্ত্রণাগুলো চাপিয়ে দিয়েছে, তার মাঝে রয়েছে বদ্ধ মানসিকতা বা অবসন্নতা, সর্ববিস্তৃত, ভীতি, স্নেহ-মমতার দুর্ভিক্ষ, শিল্পের বিভিন্ন শাখার অভিযান্ত্রিকায়নের কারণে কর্মচ্যুতির নিরবচ্ছিন্ন আশঙ্কা, ভোগ্যপণ্যের বাজারে সীমাহীন অনিশ্চয়তা- যার পাগলপ্রায় সঙ্কোচন ও প্রসারণের চাপে শ্রমিক সমাজের আজ নিত্য আতঙ্কগ্রস্ত অবস্থা। জাতীয় অর্থনীতির দাপট-ই হোক আর প্রত্যাঘাতের ভয় দেখিয়ে প্রতিপক্ষকে আণবিক বোমার আক্রমণ থেকে বিরত রাখার প্রক্রিয়া (nuclear deterrence)-ই হোক, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে নিষ্ঠুর বুদ্ধিবাদ সেখানে প্রতিনিয়তই মানবিক আদর্শবাদকে পদদলিত করে চলেছে। বিবেকবর্জিত দাপটে মানুষ আজ দিশাহারা।
বস্তুতপক্ষে মানুষের মতো একটি বুদ্ধিমান প্রাণী, যে তার অবশ্যম্ভাবী মৃত্যু তথা ইহজাগতিক ক্ষণস্থায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন, তার বুদ্ধিমত্তা ঐশ্বরিক বা পারলৌকিক বিশ্বাস থেকে বন্ধনচ্যুত হয়ে পড়লে সে বাধাবন্ধনহীন সর্বভুকে পরিণত হয়। কিন্তু সদা অসন্তুষ্ট চাহিদার কৃতদাসে পরিণত হয়ে সে তার যাবতীয় মানবিক গুণাবলি ও আত্মমর্যাদাবোধ হারিয়ে ফেলে। প্রকৃতপক্ষে সে আর ‘মানুষ’-পদবাচ্য থাকে না। পাশ্চাত্য সভ্যতার যাবতীয় রোগের এটাই মূল কারণ।
পাশ্চাত্য সভ্যতার এই সব নীতিবোধশূন্য সর্বভুক চাহিদা নিরীহ শিকারগুলোর দিকে একবার মানসচু মেলে চেয়ে দেখুন- ব্যক্তিস্বাধীনতা থেকে শুরু করে যৌনতার অভয়ারণ্য, পছন্দমাফিক মাদকদ্রব্যের ছড়াছড়ি, অবাধ বিচরণের অফুরন্ত সময়, প্রচুর অর্থ এবং মানবাধিকারের দীর্ঘাতিদীর্ঘ তালিকায় যা কিছু আছে তার সবসহ দোলনা থেকে কফিন পর্যন্ত যা কিছু প্রয়োজন তার সব কিছুর নিশ্চয়তাই তাদের রয়েছে, কিন্তু তবু একটি অব্যক্ত আত্মিক শূন্যতা তাদের জীবনকে কুরে কুরে খাচ্ছে। কাঙ্গালের মতো তারা আজ একটু সামাজিক উষ্ণতার খোঁজে ঘুরছে, ঘুরে ফিরছে এমন একজন শুরু বা আধ্যাত্মিক পুরুষের সন্ধানে, যে তাদের জীবনের অর্থ বলে দেবে।
পশ্চিমা সমাজের হালআমলের ‘মনস্তাত্ত্বিক’-এর বিস্ফোরণের এটাই মূল কারণ, সেটাকে পশ্চিমা বিজ্ঞানীরা কখনো বা phycho-theology বা মনস্তাত্ত্বিক ধর্মতত্ত্ব বা ধর্মতাত্ত্বিক মনোস্তত্ত্ব বলে আখ্যায়িত করছেন। ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠেছে বিভিন্ন প্রকার Seet বা উপধর্মীয় সম্প্রদায়।
‘অলীক চৈতন্য প্রসূত আত্মানুসন্ধানে তাদের মূল উপজীব্য’। এ কারণে প্রতিষ্ঠিত চার্চগুলোর ধর্মের ব্যবহারিক দিকগুলোকে ছেড়ে নিজেদের অস্তিত্বের মাঝে যত্রতত্র রহস্যবাদী উপাদান খুঁজে বের করতে ব্যাকুল হয়ে পড়েছে। অতি বিচিত্র সব অতীন্দ্রিয়ালোকে তারা নতুন করে এক ‘রহস্যময় যিশু’-কে খুঁজে ফিরছে। এই রহস্যময় বিকল্প পথের অনুসন্ধানপ্রক্রিয়া তাদের অবশেষে ইসলামের বৈপ্লবিক ধারার একেবারে সামনে এনে দেয়, যা ক্রমেই প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যে উভয় জগতেরই অলীক বস্তুবাদের একমাত্র বিকল্প হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে দিচ্ছে।
ইসলামী জগতের উল্লিখিত পরিবর্তনটি সূচিত হয়েছে বর্তমান (বিংশ) শতকে পরিচালিত তাদের রাজনৈতিক স্বাধীনতা পুনঃপ্রতিষ্ঠার আন্দোলনগুলোর মাঝ দিয়ে। (যা তারা ঊনবিংশ শতক থেকে ক্রমান্বয়ে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর কাছে হারিয়েছে)। যে আন্দোলন ক্রমান্বয়ে বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন মুসলিম জাতিসত্তার স্বাধীনতা অর্জনের মাধ্যমে সাফল্যের মুখ দেখে (যা ১৯৬২ সালে আলজিরিয়া কর্তৃক স্বাধীনতা অর্জনের পর একমাত্র ফিলিস্তিন ছাড়া মোটামুটি সবকটি প্রাচীন মুসলিম রাজনৈতিক জাতিসত্তাগুলোর স্বাধীনতা লাভের মাধ্যমে চূড়ান্ত রূপলাভ করেছে)।
প্রাথমিকভাবে মনে করা হচ্ছিল, পুনঃইসলামীকরণের এই আন্দোলনটি নিতান্তই একটি সামাজিক প্রতিবাদ মাত্র এবং আশা করা হয়েছিল, পূর্ব ও পশ্চিমের মাঝে বর্তমান প্রযুক্তিগত অসাম্যই এর কারণÑ যা অচিরেই দূর হয়ে যাবে। কিন্তু পরে বোঝা গেল, সমসাময়িক বিশ্লেষকেরা এই আন্দোলনের ধর্মীয় উপাদানটিকে ধরতে পারেননি। নিজেদের ধর্মকে যারা অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে গ্রহণ করেন এমন জনগোষ্ঠী সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণাই ছিল না। যদিও বা এদের কেউ কেউ এই আন্দোলনের মাঝে বর্তমান ধর্মীয় চেতনা সম্পর্কে সামান্য ধারণা রাখতেন, তারা স্বভাবতই এটাকে তৃতীয় বিশ্বের সহজাত রাজনৈতিক আবেগপ্রবণতা হিসেবে ধরে নিয়েছিলেন, যা চরিত্রগতভাবে বরাবরই অগভীর ও ক্ষণস্থায়ী। ইতোমধ্যে বাসাম তিবি ব্যাখ্যা করে দেখান যে, পুনঃইসলামীকরণ পরিভাষা ও প্রস্তাবনাটি সমূলে একটি বিভ্রান্তিকর ধারণা মাত্র। কারণ একমাত্র কিছুসংখ্যক পশ্চিমা ধ্যান-ধারণাসম্পন্ন বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের ছাড়া ইসলাম কখনো কোথাও একটি পরিপূর্ণ জীবনবিধান এবং প্রাণবন্ত দিকনির্দেশক হিসেবে তার স্থানচ্যুত হয়নি, এমনকি তুরস্কেও নয়; এটি এতদিন আধুনিকতার একটি সূক্ষ্ম বহিঃআবরণে আবৃত ছিল মাত্র।
আজকে এ সত্য সবার কাছেই পরিষ্কার হয়ে গেছে যে, ইসলামের পূর্ণাঙ্গ পুনর্জাগরণ জনজীবনে পবিত্রতার পুনর্বাসন ছাড়া আর কিছু নয়। (Gilles kepel তার গ্রন্থ Le revanche d'-তে বিষয়টি বিশেষ গুরুত্বসহকারে ব্যাখ্যা করে দেখিয়েছেন) যৌক্তিকভাবে ব্যাখ্যা করতে গেলে এর অর্থ দাঁড়ায়Ñ পশ্চিমা ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের সরাসরি প্রত্যাখ্যান। গণ-মানুসের সাথে ঐশ্বরিক চেতনার বন্ধন ছিন্ন করার প্রক্রিয়াকে ইসলাম মানবতার অঙ্গচ্ছেদ সমতুল্য মনে করে। এর বিপরীত প্রক্রিয়া গ্রহণের প্রকল্পটিকে আধুনিকতাবাদের বিলুপ্তি ঘোষণা বলে না ধরে বরং ইউরোপ কেন্দ্রিকতার বিলুপ্তি বলে ধরা উচিত (কমিউনিজমের পতনের পরও বিম্ব কিন্তু একমেরুভিত্তিক হয়ে যায়নি বরং মানবজাতির জ্ঞান বিকাশের ইতিহাসের বিচারে এখনো পৃথিবী দুই মেরুভিত্তিকই রয়ে গেছে।
ইসলামের এই পুনর্জাগরণ তৃতীয় বিশ্বের পক্ষঘাতগ্রস্ত মুসলমানদের পশ্চিমা সমাজের সাথে ভোগ-বিলাসের উন্মুত্ত প্রতিযোগিতা (যা কোনো দিনই জেতা সম্ভব ছিল না) থেকে ফিরিয়ে এনে তাদের আত্মসম্মানবোধ পুনরুদ্ধারের সম্ভাবনার দ্বার খুলে দেবে। দৃঢ় ধর্মবিশ্বাস এবং ঐতিহ্য-চেতনাই তাকে বিজয়ীর আসনে সসম্মানে অধিষ্ঠিত করবে।
প্রাচ্য আর পাশ্চাত্য যেন তাদের প্রাচীন ইতিহাসের সংহার পর্বের পুনরাবৃত্তি পর্যবেক্ষণ করছে। উপসাগরীয় যুদ্ধের সময় যেমনিভাবে ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত মুসলমানরা ঠিক তেমনিভাবে পশ্চিম আফ্রিকা ও নিকট প্রাচ্যে বসবাসরত ইউরোপীয়রাও আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে। উভয় দিকেই তখন নতুন এক ক্রুসেডের আশঙ্কা দানা বেঁধে উঠতে থাকে। খ্রিষ্টীয়-ইসলামী দ্বিপক্ষীয় আলোচনার সম্ভাবনার কথা তখন সবাই প্রায় ভুলতেই বসেছিল, ইসলামকে এমন দানবীয়রূপে আর কখনো উপস্থাপিত করা হয়নি।
বিগত ১৪০০ বছরের দুঃখজনক দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমানের সার্বিক ধ্বংসযজ্ঞে সক্ষম (Weapons of mass destruction) অস্ত্রশস্ত্রের যুগে এসে বিশ্বশান্তির লক্ষ্যে উভয় পক্ষকেই পারস্পরিক সহনশীলতার পরিচয় দিতে হবে এবং তথাকথিত সভ্যতার সঙ্ঘাতকে যেকোনো মূল্যে এড়িয়ে যেতে হবে। যত শিগগিরই পাশ্চাত্য ইসলামকে এবং ইসলাম পাশ্চাত্যকে বুঝতে শিখবে, একটি স্থায়ী বিশ্বশান্তির সম্ভাবনা ততই এগিয়ে আসবে।

অনুবাদ : মঈন বিন নাসির

 


আরো সংবাদ



premium cement