০৪ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`


নোবেলজয়ী অভিজিৎ ডুফলো ও ক্রেমারের মডেলটি আলাদা কেন?

-

অভিজিৎ বিনায়ক ব্যানার্জি, অ্যাস্থার ডুফলো এবং মাইকেল ক্রেমারকে নোবেল দেয়ার ক্ষেত্রে যে বিষয়টি গুরুত্ব পেয়েছে সেটি হলো দারিদ্র্য বিমোচনে তাদের পরীক্ষানির্ভর গবেষণা পদ্ধতি।
মি. ব্যানার্জি ও অ্যাস্থার ডুফলো পরে এমআইটিতে সংবাদ সম্মেলন করেছেন। সেখানে পরিষ্কার বাংলায় মিস্টার ব্যানার্জি বলেছেন, ‘...এখুনি অর্থনীতিতে পয়সা আনতে হবে এবং গরিবের হাতে আরো বেশি টাকা আনতে হবে।’ যদিও দারিদ্র্য বিমোচন নিয়ে গত দুই দশকে বিশ্বজুড়ে। গবেষকরা নানা দৃষ্টিকোণ থেকে কাজ করেছেন।
বাংলাদেশ থেকেই যাত্রা শুরু করা গ্রামীণ ব্যাংক কিংবা ব্র্যাকের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোও এক্ষেত্রে প্রশংসিত হয়েছে।
অভিজিৎ ব্যানার্জি ও অ্যাস্থার ডুফলো তাদের একটি বইয়ে অবশ্য বলেছেন, দিনে সোয়া এক ডলার বা তার চেয়ে কম আয় করা চরম দরিদ্রদের দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র থেকে বের করে আনা খুবই কঠিন। অবশ্য তাদের গবেষণায় তারা সেই চেষ্টাই করেছেন, যাতে করে দারিদ্র্যের ফাঁদ থেকে মানুষকে বের করে আনার উপায় বের করা যায়।
আর এজন্য তারা দারিদ্র্য বিমোচন বা নিরসনের এতদিনকার তাত্ত্বিক উপায় থেকে বেরিয়ে এসে প্রায়োগিক ক্ষেত্রে পরীক্ষা-নিরীক্ষার ওপর জোর দিয়েছেন। আর এক্ষেত্রে তারা গবেষণা করেছেন অনেক দরিদ্র দেশে।
ব্র্যাকের চেয়ারপারসন ও অর্থনীতিবিদ হোসেন জিল্লুর রহমান বলছেন, দারিদ্র্য বিমোচনের ক্ষেত্রে আগের গবেষণা বা কাজগুলোর সাথে অভিজিৎ ব্যানার্জি, এসথার ডুফলো ও মাইকেল ক্রেমারের কাজের পার্থক্য হলো এতে দর্শন বা তত্ত্বকে গুরুত্ব না দিয়ে প্রায়োগিক পরীক্ষা-নিরীক্ষায় জোর দেয়া হয়েছে।
‘যদিও এর সীমাবদ্ধতা নিয়েও আলোচনা হচ্ছে, তার পরেও এখানে দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচির ডিজাইন ও তা সফল হচ্ছে কি না তা নিয়ে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপের কথা বলা হয়েছে।’
আরেক অর্থনীতিবিদ মুস্তাফিজুর রহমান বলছেন, এককথায় কোনো কোনো পদক্ষেপে দারিদ্র্য আরো দ্রুত নিরসন করা যায় সেটিই এবারের নোবেলজয়ীরা বের করার চেষ্টা করেছেন।
সৌদি ব্যবসায়ীর অর্থে ম্যাসাচুসেটস ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজি বা এমআইটিতে গবেষণার জন্য প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে আব্দুল লতিফ জামিল পোভার্টি অ্যাকশন ল্যাব।
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইকেল ক্রেমারকে সাথে নিয়ে সেখান থেকেই গবেষণাটি করেছেন অভিজিৎ ব্যানার্জি ও এসথার ডুফলো।
দ্য রয়েল সুইডিশ একাডেমি অব সায়েন্সেস বলেছে তাদের নতুন নিরীক্ষাভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গি উন্নয়ন অর্থনীতিতে রূপ নিয়েছে, যা এখন গবেষণার নতুন ক্ষেত্র হিসেবে বিকশিত হচ্ছে।
ব্যানার্জি-ডুফলো-ক্রেমারের কাজের বিশেষত্ব : ধরুন কোনো এলাকার মানুষ দরিদ্র। স্বাভাবিকভাবে সেখানকার মানুষজন তাদের সন্তানদের স্কুলে পাঠানোর বদলে কোথাও কাজে দিয়ে অর্থ পেতে আগ্রহী থাকেন। এই গবেষকরা বলছেন, এই অভিভাবকদের কিছু অর্থ দিলে হয়তো তারা তাদের সন্তানদের স্কুলে পাঠাবেন। কিন্তু তারা এই পরামর্শ দেয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেননি, বরং তারা তাদের গবেষণায় নির্দিষ্ট এলাকা থেকে নমুনা ব্যক্তি বাছাই করে তাদের অর্থ দিয়ে দেখার চেষ্টা করেছেন যে সেটি আসলেই কাজ করছে কি না।
অর্থনীতিবিদ মুস্তাফিজুর রহমান বলছেন, এই গবেষকরা দেখার চেষ্টা করেছেন যেকোনো ধরনের শিক্ষা দরকার এবং কী করলে মানুষ তাদের সন্তানদের শিক্ষা নেয়ার জন্য পাঠাবে।
‘ধরুন একটি দরিদ্র এলাকায় মানুষ কৃষিকাজ করছে। সেই এলাকার লোকদের শহরে আসার বাসের টিকিট দেয়া হলো। এই টিকিট দেয়ার পর এই গবেষকরা দেখার চেষ্টা করেছেন যে ওই টিকিট ব্যবহার করে মানুষগুলো তাদের পণ্য নিয়ে শহরে যেতে উৎসাহী হচ্ছে কি না এবং গেলে তাদের লাভ হচ্ছে কি না।’
হোসেন জিল্লুর রহমান বলছেন, দারিদ্র্য বিমোচন করতে হলে দার্শনিক জায়গা নয় বরং অবকাঠামোগত সংস্কারÑ কিছু কর্মসূচির মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচন করতে হবে, এটিই এবারের নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদরা বোঝানোর চেষ্টা করেছেন।
অর্থাৎ দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচির ডিজাইন এবং বাস্তবায়ন পর্যায়ে কোনো অংশের কারণে সফল হচ্ছে বা হচ্ছে না সেটার জন্য পদ্ধতিগত অভিনবত্ব এনেছেন তারা। যেমন ধরুন দারিদ্র্য বিমোচন প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে কোথাও একটি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র খোলা হলো এবং এর পরিচালন সময় নির্ধারণ করা হলো সকাল ৮টা থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত। কিন্তু ওই এলাকার মানুষ বা সম্ভাব্য যারা সেবাগ্রহীতা হবেন তাদের সেবা নেয়ার সময় হয় বিকেলে। তাহলে দেখা গেল উদ্যোগ ভালো হলেও সময় নির্ধারণে ভুলের কারণে সেটি কোনো কাজে লাগল না।
আবার স্কুল থেকে শিশুরা ঝরে পড়ছে কেন এটি দেখতে গিয়ে তারা দেখেছেন যে কর্মসূচির ডিজাইন বা রূপরেখায় ভুল আছে কি নাÑ সেক্ষেত্রে তারা ডিজাইনের বিভিন্ন উপাদানে জোর দিয়েছেন। এক্ষেত্রে তারা সেবাগ্রহীতা এবং গ্রহীতা নন এমন দুই ক্ষেত্রেই পরীক্ষা করেছেন এবং এর ফল নিয়ে গবেষণা করেছেন।
জনাব রহমানের মতে, ‘এবারের নোবেলজয়ী তিন অর্থনীতিবিদের কাজের বৈশিষ্ট্য হলো : ১. তারা একটি কর্মসূচির রূপরেখা তৈরি করছেন এবং ২. সেটি ঠিকমতো কাজ করছে কি না তা বোঝার জন্য গবেষণার পদ্ধতিতে নতুনত্ব এনেছেন।’ যদিও হোসেন জিল্লুর রহমান ও মুস্তাফিজুর রহমানÑ দুজনই বলছেন, নোবেল জয় করলেও উন্নয়ন অর্থনীতির এই নতুন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েও বিতর্ক শুরু হয়েছে এবং এ নিয়ে প্রশ্নও আছে।
অর্থনীতিবিদ নাজনীন আহমেদ বলছেন, এই গবেষকরা দারিদ্র্যের বড় ক্যানভাস ভাগ করে এক্সপেরিমেন্ট করেছেন। ‘তারা কৃত্রিমভাবে পরিস্থিতি তৈরি করেছেন। মানুষের আচরণ বিশ্লেষণ করেছেন। এবং দারিদ্র্যের কারণগুলো ভেঙে এর ভেতরে ঢুকে বিশ্লেষণ করে পলিসি সাজেশন দিয়েছেনÑ এটাই তাদের বিশেষত্ব।’ একেক এলাকায় একেক ধরনের দারিদ্র্য। তাদের অর্থ দিয়ে তারা কী করবে? এ ধরনের ছোট ছোট ভাগে ইস্যুগুলো বের করে তারা দেখেছে যে আসলে কোথায় জোর দিতে হবে।
‘অর্থাৎ যেসব কারণে দারিদ্র্য হয় সেগুলো কারণগুলোর ভেতরে ঢুকে বিশ্লেষণ করা এবং সে মোতাবেক কয়েকটি দেশকে নীতি পরামর্শ দিয়েছেন তারা। অর্থাৎ দারিদ্র্যের যে বিশাল ক্যানভাস সেটিকে ভেঙে ভেঙে গবেষণাগারে এক্সপেরিমেন্ট করা।’
নাজনীন আহমেদ বলছেন, এতদিনকার যেসব ধারণা এসেছে দারিদ্র্য বিমোচন নিয়ে সেগুলো চেয়ে এ ধারণা নতুন ও সম্পূর্ণ আলাদা। তিনি বলেন, এর ফলে শিক্ষা বা স্বাস্থ্যের মতো বিষয়গুলোতে আরো কার্যকর পদক্ষেপ নিয়ে তা বাস্তবায়ন সম্ভব হবে বলে গবেষকরা মনে করছেন।
ব্র্যাকের মডেল নিয়ে কাজ করেছেন অভিজিৎ ডুফলো : ব্র্যাকের আলট্রা পুওর গ্র্যাজুয়েশন কর্মসূচির প্রধান রোজিনা হক বিবিসিকে বলেন, ব্র্যাকের এই কর্মসূচি শুরু হয়েছিল ২০০২ সালে, যা পরে ফোর্ড ফাউন্ডেশন অন্য দেশেও এটি সফল হয় কি না তা দেখার চেষ্টা করে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের ৪৭টি জেলার পাশাপাশি বিশ্বের ৪০টিরও বেশি দেশে এ কর্মসূচি চলছে। আর এসব কার্যক্রমের কার্যকারিতা পরীক্ষার লক্ষ্যে বিশ্বের ছয়টি দেশে এমআইটির গবেষক অভিজিৎ, ডুফলো এবং তাদের সহযোগীরা গবেষণা করেছেন। দেশগুলো হচ্ছেÑ ইথিওপিয়া, গানা, হন্ডুরাস, ভারত, পাকিস্তান ও পেরু।
ব্র্যাক বলছে, তাদের এ মডেলটির ওপর গবেষণা তাদের দারিদ্র্য বিমোচনবিষয়ক গবেষণার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ‘অভিজিৎ ও তার সহযোগী গবেষকদের দারিদ্র্যবিষয়ক গবেষণার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ব্র্যাকের আলট্রা পুওর গ্র্যাজুয়েশন মডেল। তা ছাড়া এই মডেলটি বিভিন্ন দেশের স্থানীয় পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে সেখানকার চরম দরিদ্র মানুষের অবস্থা পরিবর্তনের কিভাবে কাজে লাগানো সম্ভব সে বিষয়ে তাদের গবেষণা গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা দিয়েছে।’


আরো সংবাদ



premium cement
ইসরাইলগামী সকল জাহাজে হামলার হুমকি হাউছিদের কংগ্রেস সর্বোচ্চ চেষ্টা করেও ৫০ আসন পাবে না : মোদি প্যারিসের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিলিস্তিনিপন্থী শিক্ষার্থীদের সরিয়েছে পুলিশ চুক্তিতে সম্মত হতে হামাসকে ৭ দিনের আল্টিমেটাম ইসরাইলের গফরগাঁওয়ে লরিচাকায় পিষ্ট হয়ে নারী নিহত রোহিঙ্গা গণহত্যা : মিয়ানমারের বিরুদ্ধে মামলার দ্রুত নিরসনে আশাবাদী বাংলাদেশ-গাম্বিয়া দোয়ারাবাজারে মইন হত্যাকারীদের গ্রেফতার দাবিতে বিক্ষোভ সাংবাদিকদের সুরক্ষায় প্রতিটি দেশের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের আহ্বান জলবায়ু সঙ্কট মোকাবেলায় অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন জোরদারের আহ্বান এডিবি প্রেসিডেন্টের মিরসরাইয়ে তীব্র তাপদাহে মরছে মাছ : লোকসানের মুখে চাষিরা মহেশখালীতে ত্রিমুখী লড়াইয়ের সম্ভাবনা, এগিয়ে জয়নাল

সকল