১৯ মার্চ ২০২৪, ০৫ চৈত্র ১৪২৯, ০৮ রমজান ১৪৪৫
`
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা

প্রশ্নফাঁস হওয়া ঘ-ইউনিটের ফল প্রকাশ

-

নানা নাটকীয়তার মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদভুক্ত ঘ-ইউনিটের প্রশ্নফাঁস হওয়া পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ করা হয়েছে। এতে রেকর্ড সংখ্যক শিক্ষার্থী পাস করেছে। এবছর পাসের হার বিগত পাঁচ বছরের রেকর্ড ছাড়িয়েছে। গত বছরের তুলনায় পাসের হার বেড়েছে প্রায় ১২ (১১ দশমিক ৮৬) শতাংশ। বিতর্কের মুখে প্রকাশিত এ ফলাফলকে অস্বাভাবিক বলে মন্তব্য করার পাশাপাশি এর মধ্যে গোলমাল রয়েছে বলে মনে করছেন জাতীয় অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। অন্যদিকে পরীক্ষা বাতিলের দাবিতে অনশনে বসেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের এক শিক্ষার্থী। প্রকাশিত এ ফলাফলকে প্রত্য্যাখান করে প্রশ্নফাঁসের দায়ে উক্ত ঘ-ইউনিটের সমন্বয়ক অধ্যাপক সাদেকা হালিমের পদত্যাগ দাবি করেছে প্রগতিশীল ছাত্র জোট।

এর আগে গত ১২ অক্টোবর শুক্রবার অনুষ্ঠিত ঘ-ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁসের প্রমাণ রয়েছে। পরীক্ষা শুরুর প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা আগে হাতে লেখ উত্তরসহ ৭২টি প্রশ্ন সাংবাদিকদের হাতে আসে। পরে সেটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে জানানো হয়। অনুষ্ঠিত ঘ-ইউনিটের প্রশ্নের সাথে এর শতভাগ মিল রয়েছে। এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রোভিসি (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ সামাদকে প্রধান করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। ঘটনার পরদিন রাতে ৬ জনকে আসামী করে শাহবাগ থানায় মামলা করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

এদিকে, সোমবার সকাল ১১টায় মঙ্গলবারে উক্ত পরীক্ষার ফল প্রকাশের বিষযে গণমাধ্যমে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়। এর দু’ঘণ্টা পরে ১টা ৪ মিনিটে দ্বিতীয় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে পূর্বোক্ত বিজ্ঞপ্তির কার্যক্রম স্থগিত করা হয়। পরে মঙ্গলবার সকালে আবার তৃতীয় বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে বিকেল সাড়ে ৩টায় ফল প্রকাশের বিষয়টি জানানো হয়। পরে মঙ্গলবার বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ভর্তি অফিসে সমন্বিত ঘ-ইউনিটের ফলাফল প্রকাশ করেন ভিসি অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান। এ সময় অন্যান্যের মধ্যে ছিলেন প্রোভিসি (প্রশাসন) অধ্যাপক মুহাম্মদ সামাদ, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন এবং ঘ-ইউনিট ভর্তি কমিটির সমন্বয়ক অধ্যাপক সাদেকা হালিম, অনলাইন ভর্তি কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. হাসিবুর রশীদস প্রমুখ।

প্রকাশিত ফলাফল অনুযায়ী, এবছর বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় এ তিন শাখা হতে ৭০ হাজার ৪৪০ জন পরীক্ষার্থী অংশগ্রহণ করে। এর মধ্যে পাস করে ১৮ হাজার ৪৬৩ জন। পাসের হার ২৬ দশমিক ২১ শতাংশ। যার মধ্যে বিজ্ঞান বিভাগে ২৪ দশমিক ৫৬ শতাংশ, মানবিকে সর্বাধিক ৪৭ দশমিক ৮৯ এবং ব্যবসায় শাখা হতে ১৭ দশমিক ৯৪ শতাংশ শিক্ষার্থী পাস করে।

তবে বিগত পাঁচ শিক্ষাবর্ষের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষে পাসের হার ছিলো ১১ দশমিক ৪০, ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষে ১৬ দশমিক ৫৫, ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষে ৯ দশমিক ৯৪, ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষে ৯ দশমিক ৮৩, ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষে ১৪ দশমিক ৩৫ এবং সর্বশেষ চলতি ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষে ঘ-ইউনিটের পাসের হার ২৬ দশমিক ২১ শতাংশ। যা বিগত পাঁচ বছরের রেকর্ড ছাড়িয়েছে। এর আগে উল্লিখত পাঁচ শিক্ষাবর্ষে সর্বাধিক পাসের হার ছিলো ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষে। গত বছরের তুলনায় এ বছর পাসের হার বেড়েছে ১১ দশমিক ৮৬ শতাংশ। আবার এ বছরের অন্য ইউনিটগুলোর বিবেচনায়ও ঘ-ইউনিটে পাসের হার সর্বাধিক। অন্যান্য ইউনিটগুলোর মধ্যে ক-ইউনিটে পাসের হার ২৩ দশমিক ৩৭, খ-ইউনিটে ১৪ শতাংশ এবং গ-ইউনিটে ১০ দশমিক ৯৮ শতাংশ।

বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা, উচ্চ-মাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফল বিবেচনা করে প্রশ্নফাঁস প্রকাশিত এ ফলাফলে প্রভাব ফেলেছে বলে মনে করছেন শিক্ষাসংশ্লিষ্টরা। তবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সে দাবিকে নাকচ করে দিয়েছেন। পরীক্ষার প্রশ্ন তুলনামূলক সহজ করা হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক আখতারুজ্জামান।

তিনি বলেন, বিভিন্ন সময় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেয়া নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। সেদিক থেকে এবছর শিক্ষার্থীদের কথা বিবেচনা করে ভর্তি পরীক্ষার ইংরেজি এবং সাধারণ জ্ঞানের বাংলাদেশ বিষয়াবলি প্রশ্ন যথেষ্ট সহজ করা হয়েছে। যার প্রভাব এবার ফলাফলে পড়েছে। প্রশ্নফাঁসের বিষয়ে তিনি বলেন, প্রশ্নপত্র ফাঁস আর ডিজিটাল জালিয়াতি যে যেভাবে শব্দগুলো ব্যবহার করছে আমরা সেটি গ্রহণ করছি না। তদন্ত কমিটি আছে। আইন শৃঙ্খলা বাহিনী আছে তারা বিষয়টি দেখবে। যারা জালিয়াতির সাথে জড়িত তারা কেউ ছাড় পাবে না।

প্রশ্নফাঁসের কারণে পরীক্ষা বাতিল করা হবে কিনা জানতে চাইলে ভিসি বলেন, পরীক্ষার ফল তো প্রকাশ করা হয়ে গেছে। এটা তো বাতিলের বিষয় না। কেননা ৭০ হাজার শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছে। তাছাড়া নানা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পরীক্ষা হয়ে গেছে। কিন্তু যারা জালিয়াতিতে জড়িত, যাদেরটা যেভাবে চিহ্নিত করা হবে তাদের পরীক্ষা বাতিল করা হবে। আইনের মাধ্যমে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। তবে প্রোভিসি অধ্যাপক সামাদ বলেন, প্রয়োজনে সন্দেহভাজনদের পরীক্ষা নেয়া হতে পারে।

এদিকে, বিতর্কের মুখে প্রকাশিত এ ফলাফলকে অস্বাভাবিক বলে মন্তব্য করার পাশাপাশি এর মধ্যে গোলমাল রয়েছে বলে মনে করছেন জাতীয় অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এ প্রবীণ শিক্ষাবিদ বলেন, সংখ্যা দেখলেই বোঝা যাচ্ছে এর মধ্যে গোলমাল আছে। হঠাৎ করেই এতো বৃদ্ধি পাওয়া নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে ঢাবির সাবেক এই অধ্যাপক বলেন, প্রশ্নফাঁস হওয়ার খবর না পেলেও আমরা মনে করতে পারতাম হঠাৎ করে মান এতো বাড়েনি। অন্যসব পরীক্ষার ক্ষেত্রে মান কমেছে। কাজেই এটাকে অস্বাভাবিকই মনে হচ্ছে। অন্য ইউনিটগুলোর রেজাল্টগুলোও অতো বাড়েনি। সে দিক থেকেও এ ফলাফল সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

ফল বাতিল করে পুনরায় পরীক্ষার দাবিতে অনশন: ভর্তি পরীক্ষা বাতিল করে পুনরায় পরীক্ষা নেয়ার দাবিতে আমরণ অনশন করছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের তৃতীয় বর্ষের আখতার হোসেন নামের শিক্ষার্থী। বিশ্ববিদ্যালয়ের সন্ত্রাসবিরোধী রাজু ভার্স্কযের পাদদেশে মঙ্গলবার সাড়ে ১২ টা থেকে অনশন শুরু করেন তিনি।

সরেজমিন দেখা যায়, অনশনে বসেই আহম্মদ ছফার ‘গাভী বিত্তান্ত’ বইটি পড়ছেন। তার পাশে একটি ছাতা, একটি ব্যাগ, পায়ের নিচে একটি গামছা, পিছনে কিছু প্রতিবাদী লেখা সম্বলিত প্ল্যাকার্ড রয়েছে। প্ল্যাাকার্ডে লেখা ছিলো-‘যদি পরীক্ষা শুরুর ১ মিনিট আগেও প্রশ্ন পাওয়া যায়, তবুও সেটা প্রশ্নফাঁস’, ‘প্রশ্নপত্রের নিরাপত্তা চাই’, ‘ জালিয়াতদের বহিষ্কার চাই’, ‘হোতাদের বিচার চাই’, ‘প্রশ্নফাঁস!! না মেধাবীদের গলায় ফাঁস? এ দায় নেবে কে? ইত্যাদি।

জানতে চাইলে আখতার হোসেন বলেন, আমি ‘ঘ’ ইউনিটের পরীক্ষা বাতিলের দাবিতে এখানে বসেছি। যে প্রশ্নে পরীক্ষা নেওয়া হয়েছে সেটা ফাঁস হওয়া প্রশ্ন। ফাঁস হওয়া প্রশ্নে আপনারা নতুন শিক্ষার্থী ভর্তি করাবেন, এটা আমি মেনে নিতে পারিনা।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর একেএম গোলাম রব্বানী বলেন, গণতান্ত্রিক পরিবেশে সবাই দাবি পেশ করতে পারে, তবে কে, কী দাবি করছে তা তাদের একান্ত ব্যাপার।

ডিনের পদত্যাগ দাবি প্রগতিশীল ছাত্র জোটের: এদিকে প্রশ্নফাঁসের দায়ে ঘ-ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার সমন্বয়ক ও সমাজবিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক সাদেকা হালিমকে পদত্যাগ করার দাবি করেছে প্রগতিশীল ছাত্র জোট। মঙ্গলবার বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মধুর ক্যান্টিনে এক সংবাদ সম্মেলনে এ দাবী করা হয়। এই সময় ঘোষিত ফলাফল প্রত্যাখ্যান করেন তারা। এসময় তারা ঘোষিত ফলাফল বাতিল, প্রশ্নফাঁসে জড়িতদের গ্রেপ্তার ও বিচারেও দাবি জানান। একই দাবিতে আজ সন্ধ্যা ৬ টায় রাজু ভাস্কর্য থেকে মশাল মিছিলের কর্মসূচী পালনের ঘোষণা দেওয়া হয়।

সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন, বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন এর ঢাবি শাখার সভাপতি উম্মে হাবীবা বেনজীর। অন্যান্যের মধ্যে ছিলেন সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট ঢাবি শাখার সভাপতি সালমান সিদ্দিকী, ঢাবি ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি ফয়েজুল্লাহ প্রমুখ।


আরো সংবাদ



premium cement