২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`
চিকিৎসাসেবার বেহাল দশা

এত বছরে উন্নতি হলো কতটুকু!

-

‘বরিশালের ১০ উপজেলা হাসপাতালে ডাক্তার সঙ্কট’, ‘এক ডাক্তারই ভরসা চার লাখ পরিবারের’, ‘চিকিৎসাসেবা পাচ্ছে না অর্ধশতাধিক গ্রামের জনগণ’Ñ এবারে পত্রিকার খবরের তিনটি শিরোনাম। আমরা যে আজো ‘সবার জন্য স্বাস্থ্য’ থেকে বহু দূরে এবং দেশে চিকিৎসাসেবা তথা স্বাস্থ্যব্যবস্থার ক্ষেত্রে জনগণকে ব্যাপক দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে, এর নমুনা হিসেবে এই তিন শিরোনাম উল্লেখ করা হলো। প্রতিদিনই এ ধরনের খবর, সংবাদচিত্র, অভিযোগ প্রভৃতি মিডিয়ায় প্রকাশ পাচ্ছে। তবুও অবস্থার বেশি উন্নতি ঘটেনি, যদিও প্রচারণা-বাগাড়ম্বর মিলিয়ে সরকারের সাফল্যের বয়ান সে অনুপাতে বেশি।
একটা জাতীয় পত্রিকায় নিজস্ব প্রতিনিধি তুলে ধরেছেন বরিশালের গৌরনদী, উজিরপুর, হিজলা, মুলাদী, মেহেন্দিগঞ্জ প্রভৃতি উপজেলায় সরকারি হাসপাতালে স্বাস্থ্যসেবার করুণচিত্র। এসব হাসপাতালের শয্যাসংখ্যা ৫০ থেকে ১০০। তবে চিকিৎসক ও নার্সসহ জনবল, ওষুধপত্র, যন্ত্রপাতি, সাজসরঞ্জামসহ সুযোগ-সুবিধা একেবারেই অপর্যাপ্ত। প্রতিবেদনে জানানো হয়, ঢাকা-কুয়াকাটা মহাসড়কের পাশেই গৌরনদী ও উজিরপুর হাসপাতাল। এলাকার বিপুল রোগী ছাড়াও, মাদারীপুর জেলার কালকিনি থেকে বরিশালের বাবুগঞ্জ উপজেলার রহমতপুর পর্যন্ত মহাসড়কের ৫০ কিলোমিটারজুড়ে প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় আহতদের প্রথমেই নিতে হয় এই দু’টি হাসপাতালের যেকোনো একটিতে; কিন্তু প্রধানত ডাক্তারের অভাবে তাদের চিকিৎসা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে নামমাত্র চিকিৎসা দিয়ে তাদের পাঠিয়ে দেয়া হয় বরিশাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। উজিরপুর উপজেলার স্বাস্থ্য কর্মকর্তা অকপটে বললেন, ‘হাসপাতাল নামেই এক শ’ শয্যার; কোনো সুযোগ-সুবিধা নেই এখানে।’ সড়ক দুর্ঘটনায় আহতদের জন্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নেই। ২১ জন ডাক্তারের স্থানে কাগজ-কলমে ১০ জন এবং বাস্তবে পাঁচজন আছেন হাসপাতালে। অন্য পাঁচ ডাক্তার কাজ করছেন শেরেবাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। বিশেষজ্ঞ না থাকায় উজিরপুর হাসপাতালে ছোটখাটো অপারেশনও করা যায় না। কোনো কোনো সময় মাত্র দু’জন ডাক্তারের একটানা ২৪ ঘণ্টা ডিউটির মাধ্যমে হাসপাতাল চালাতে হয়েছে। মহাসড়কে দুর্ঘটনায় আহতদের সুচিকিৎসার্থে গৌরনদী উপজেলা হাসপাতালে ১৫ বছর আগে ট্রমা সেন্টার চালু হয়েছিল। উন্নত সরঞ্জাম থাকলেও আজ পর্যন্ত কোনো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সেখানে দেয়া হয়নি। ফলে ট্রমা সেন্টার এখন পরিত্যক্ত। উপজেলা হাসপাতালে ২৭ জন নির্ধারিত চিকিৎসকের পরিবর্তে মাত্র পাঁচজন থাকলেও তাদের দু’জন প্রশিক্ষণ নিতে ঢাকায় আছেন। হিজলা-মুলাদী-মেহেন্দিগঞ্জের ৫০ বা ১০০ শয্যার হাসপাতালে লোকবলের অভাবে নার্স বা চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীরাই ‘জরুরি চিকিৎসা দিচ্ছেন।’ মেহেন্দিগঞ্জ হাসপাতালে বেড ২০টি বাড়িয়ে ৫০টি করা হলেও ডাক্তারের পদ বাড়েনি একটিও। এখন সেখানে ডাক্তার আছেন চারজন। মুলাদী হাসপাতালে পাঁচজন ডাক্তারকে দেখতে হয় অর্ধশত বেডের রোগীসহ সব রোগীকে। তদুপরি কোনো কোনো হাসপাতালে রোগীর কাছ থেকে অতিরিক্ত অর্থ নেয়ার অভিযোগ উঠেছে।
একই দিন একই পত্রিকায় জানানো হয়, টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে মাত্র একজন ডাক্তার আছেন ১৬৮ গ্রামের চার লাখ পরিবারের চিকিৎসার দায়িত্বে। এখানকার হাসপাতাল ৫০ শয্যার। দেলদুয়ার রাজধানী থেকে বেশি দূরে নয়। সেখানেই যদি সরকারের চিকিৎসাসেবার এমন দুরবস্থা হয়, তাহলে ঢাকা থেকে দূরবর্তী, প্রত্যন্ত এলাকার উপজেলাগুলোতে স্বাস্থ্যসেবার মান কী রকম, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
আরেক পত্রিকার খবর, সুনামগঞ্জের তাহিরপুরে অর্ধশতাধিক গ্রামের মানুষ পাচ্ছেন না চিকিৎসাসেবা। সেখানকার কোনো কোনো স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র দীর্ঘ তিন দশক ধরে বন্ধ। এমন একটি কেন্দ্রের ভবন নির্মাণের জন্য স্থানীয় কর্মকর্তা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে লিখিত জানিয়েছেন তিন বছর আগে। এ ব্যাপারে আজ পর্যন্ত কোনো পদক্ষেপ দেখা যায়নি।
স্বাস্থ্যসেবা বা চিকিৎসা মানুষের পাঁচটি মৌলিক প্রয়োজনের একটি। তাই ‘সবার জন্য স্বাস্থ্য’ নিশ্চিত করা সরকারের একটি বড় দায়িত্ব। জনগণ সরকার ও প্রশাসনের কর্মকর্তাদের বাস্তব ও ফলপ্রসূ কাজ দেখতে চায়, বাগাড়ম্বর ও আত্মপ্রচারণা নয়। দেশের সত্যিকার উন্নয়নের জন্য অনিয়ম, দুর্নীতি, গাফিলতি, দলীয়করণ ও স্বজনপ্রীতির অবসান ঘটিয়ে তৃণমূলপর্যায়ে মানুষের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। চিকিৎসকসহ পর্যাপ্ত জনবল যাতে সব হাসপাতালে থাকেন, এ বিষয়কে সবিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে।


আরো সংবাদ



premium cement