২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

মন ও মৃত্তিকার কবি

-

মন ও মৃত্তিকার কবি আহসান হাবীবের আবির্ভাব চল্লিশের শেষপ্রান্তে। ১৯৪৭ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ রাত্রিশেষ। কাব্যটি প্রকাশের মধ্য দিয়ে তিনি পরিচিতি পেয়ে গেলেন রেড রোডের কবি হিসেবে। বাংলা কবিতায় তার স্থান নির্মাণ করে নিলেন প্রথম কাব্যগ্রন্থের মাধ্যমেই। তার শব্দ চয়নের মধ্য দিয়ে। এ প্রসঙ্গে সৈয়দ আলী আহসানের মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য, তিনি বক্তব্যে সমাজ সচেতন কিন্তু শব্দ ব্যবহারে রোমান্টিক।
তার অগ্রজ কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়, ফররুখ আহমদ, আবুল হোসেনের ঘরানার বাইরে এসে নিজস্ব কাব্যভাষা তৈরি প্রয়াস তার ছিল আগাগোড়ায়। আর তাই তিনি চল্লিশের স্লোগানমুখর কবি সুভাষের মতো রাজনৈতিক ভাষ্য তৈরি করলেন না; বরং ত্রিশের ব্যক্তিবাদিতাকে পরিহার করে বাঙালি মধ্যবিত্ত মুসলমান সমাজের চিত্র তুলে ধরলেন তার কবিতায়। এ ধারায় ফররুখ আহমদ অগ্রজ হলেও; তিনি ফররুখ আহমদের পথ মাড়াননি। নিজস্ব নির্মিত পথে চলেছেন আমৃত্যু। রাত্রিশেষ দিয়ে কাব্য যাত্রা শুরু করেছিলেন দেশ স্বাধীনের (ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে পাকিস্তান সৃষ্টি) প্রাক্কালে। আর মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা লাভ করা বাংলাদেশে প্রকাশিত হয় তাঁর অসামান্য কাব্যগ্রন্থ আশায় বসতি। কাব্যগ্রন্থগুলোর নামের মধ্য দিয়ে এক ধরনের মানসিক ভাবাবেশ প্রকাশ করেছেন তিনি।
তার সর্বশেষ কাব্যগ্রন্থ বিদীর্ণ দর্পণে মুখ প্রকাশিত হয় ১৯৮৫ সালে। এই কাব্যগ্রন্থে প্রকাশ পেয়েছে তার কাব্য চেতনার বহিঃপ্রকাশ। সে সম্পর্কে কবি বলছেন :
সুধীজনদের কেউ-কেউ বলেন, বলতে-বলতে চালু হয়ে
গেছে, আহসান হাবীব মৃদুভাষী কবি। কবিতায় মৃদুভাষিতা কি
জিনিস আমি কিন্তু বুঝি না। ভালো কবিতা আর মন্দ
কবিতা বুঝি, সার্থক রচনা আর অসার্থক রচনা বললে বুুঝি।
কবিতার নির্মাণ আর উপস্থাপন যদি সার্থক হয় সেই-ত বলিষ্ঠতা,
বরং অসার্থক কবিতায়ই থাকতে পারে চিৎকারের প্রাধান্য।
...কবিতাকে রাজনৈতিক বক্তৃতা করে তোলার পক্ষপাতী
নই বলি। বরং কবিতা হোক রাজনৈতিক মঞ্চের বিশুদ্ধ
প্রেরণা, আমি পেয়েছি।
(পরিক্রম এবং অবস্থান প্রসঙ্গ, বিদীর্ণ দর্পণে মুখ)
আসনান হাবীব সমুদ্র পাড়ের পাংশা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৯১৭ সালের ২ জানুয়ারি। তখন বিশ্বজুড়ে প্রথম মহাযুদ্ধের তাণ্ডব। তবে সেই যুদ্ধ প্রত্যক্ষ করার সুযোগ তার ছিল না। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞ প্রত্যক্ষ করেছিলেন যুবক বয়সে। যুদ্ধের ভয়াবহতা, নির্মমতা তাঁকে মানস পটে ছাপ ফেলেছিল। মানুষ কত নিষ্ঠুরভাবে মারতে পারে মানুষকে। আর বিশ্বপরিমণ্ডলে যখন যুদ্ধের দামামা, সেই মুহূর্তে ভারতবাসী ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে মুক্তি লাভের প্রত্যাশায় করছেন আন্দোলন। বাঙালি মুসলমান সেই আন্দোলনের অগ্রগামী সৈনিক। সেই স্রোতে যাত্রী ছিলেন আহসান হাবীব। যদিও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সাথে তাঁর সরাসরি সম্পৃক্ততা ছিল না। মনের মুকুরে ছিল কবি হওয়ার বীজ মন্ত্র। আর তাই কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার অভিপ্রায়ে রাজনীতির মঞ্চ থেকে নিজেকে সরিয়ে রেখেছিলেন নিভৃতে। যদিও রাত্রিশেষে ছিল কিছুটা রাজনৈতিক উচ্চাভাস। তবে পরবর্তী কাব্যগ্রন্থগুলোতে নিজেকে ক্রমান্বয়ে সরিয়ে নিয়েছেন। ঐতিহ্যের পথ ধরে চলছে তার কাব্য পথের বিস্তার ঘটেছে। এই মাটিলগ্ন মানুষের কথা বলেছেন। বলেছেন স্বদেশ মৃত্তিকা নিসর্গের কথা। সুকন্যার প্রেমে নিজেকে কখনো অভীষ্ট হয়েছেন। মানিলীর সাথে করেছেন ভাব। আহসান হাবীব তার কাব্যের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ছিলেন আশাবাদী কবি। ঝরা পালকের ভস্মস্তূপে যে নীড় বেঁধেছিলেন চেনা পৃথিবীর সবটুকু না জেনেই। সেই বন্ধনের গন্তব্য স্থল নির্ণয় করলেন এভাবে : ‘কেন যাবো স্বদেশ ছেড়ে বিদেশ বিভূঁইয়ে অন্ধকারে?’ (যাবো না, বিদীর্ণ দর্পণে মুখ)।
বৃহত্তর বরিশালের প্রকৃতির কোলে বেড়ে উঠতে উঠতে আহসান হাবীবের মনে যে কবি মানস তৈরি হয়েছিল তাতে নাগরিক প্রলেপ পড়ল নগর কলকাতায় গমনের পর। আর সেই নাগরজীবের ব্যথা বেদনার সুর তার কবিতায় যেমন আছে, আছে পাংশার প্রকৃতি। আর এই দু’য়ের মিলেই স্বতন্ত্র কাব্যচারিত্র নির্মাণ করেছেন কবি আহসান হাবীব।

 


আরো সংবাদ



premium cement