০৮ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১, ২৮ শাওয়াল ১৪৪৫
`


বুকার জয়ী মার্গারেট ও এভারিস্টো

-

ম্যান বুকার থেকে স্বনামে অর্থাৎ বুকার পুরস্কার নামে প্রত্যাবর্তনের পর বুকার পুরস্কার কমিটি একের পর এক নতুনতর সিদ্ধান্ত নিয়েই যাচ্ছিলেন। এর উদ্দেশ্য কি ছিল পুরস্কারের খোলনলচে বদলে দেয়া? হয়তো তাই। সাহিত্য সমালোচক ও সাহিত্যপ্রেমীদের কাছে সেরকমটাই মনে হতে পারে। নোবেল সাহিত্য পুরস্কারের পর বুকার বিশে^র আরেক মর্যাদাবান সাহিত্য পুরস্কার হিসেবে বিবেচিত। গত জুনে ম্যান বুকার থেকে আগের নামে অর্থাৎ বুকার নামে প্রত্যাবর্তনের পর বুকার পুরস্কার কমিটি লংলিস্ট ও শর্টলিস্ট প্রকাশের সময় কিছু চমক উপহার দেয়। সেই চমক ছিল প্রকাশ হয়নি এমন বইকে তালিকায় স্থান দেয়া। বিতর্কিত লেখক এর আগে একবার বুকার জয়ী সালমান রুশদীর বইসহ কয়েকটি বইয়ের ক্ষেত্রে এ ঘটনা ঘটতে দেখা গেছে। এগুলোকে ঠিক পাণ্ডুলিপি বলা যাবে না, যন্ত্রস্থ বা প্রকাশের পথে বলা যায়। যাই হোক, ইতোমধ্যে এগুলো প্রকাশ পেয়ে গেছে। দরকারি কথা হলো, শর্টলিস্ট বা লংলিস্ট প্রকাশ পর্বে বইগুলো কোনো শেলফে ছিল না। ফলে পাঠকের নাড়াচাড়া করে দেখা বা কেনার সুযোগ ছিল না। নতুনতর ঘটনা ঘটল ২০১৯ সালের পুরস্কার বিজয়ীর নাম ঘোষণার সময়। লন্ডনে এক জমকালো অনুষ্ঠানে ১৪ অক্টোবর সবাইকে অবাক করে দিয়ে নিয়ম ভেঙে এই প্রথমবারের মতো দুজন লেখিকাকে এ বছর পুরস্কার দেয়া হয়। তারা হলেন কানাডার প্রবীণ লেখিকা মার্গারেট অ্যাটউড ও নাইজেরীয় বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ লেখিকা বার্নারডাইন এভারিস্টো। পুরস্কারের ৫০ হাজার পাউন্ড দুজনে ভাগ করে নেবেন। বুকার ইন্টারন্যাল প্রাইজের ক্ষেত্রে যেমনটা হয়ে থাকে, অর্থাৎ মূল লেখক ও অনুবাদকের মধ্যে ৫০ হাজার পাউন্ড ভাগ করে দেয়া হয়। শর্টলিস্টে থাকা বাকি চারজন হলেনÑ লুসি এলম্যান, চিগোজি ওবিওমা, আলিফ শাফাক ও সালমান রুশদী। বুকার পুরস্কারের দরজা মার্কিন লেখকদের জন্য উন্মুক্ত থাকলেও এবার তাদের উপস্থিতি তেমন চোখে পড়ছে না। পরপর দু’বার মার্কিন লেখকরা পুরস্কার নিয়ে যাওয়ার পর হওয়া বিরূপ সমালোচনা এর কারণ কি না তা বলার সময় এখনো আসে নি। তবে দুজনকে একসঙ্গে পুরস্কার দেয়ায় লন্ডনের সাহিত্যাঙ্গনে রীতি মতো ঝড় বয়ে যাচ্ছে। সোজা কথায় এ নিয়ে বোদ্ধা মহলে বিতর্ক দেখা দিয়েছে। অ্যালিসন ফ্লাড গার্ডিয়ানে লিখেছেন, নিয়ম ভেঙে দুজনকে পুরস্কার দেয়ায় সমালোচনা হচ্ছে।
বাস্তবেও তাই ১৯৬৯ সালে বুকার চালুর পর মাত্র দু’বার ১৯৭৪ ও ১৯৯২ সালে দু’জন করে লেখক লেখিকা এই পুরস্কার পেয়েছিলেন। ১৯৭৪ সালে নাদিন গর্ডিমার ও স্ট্যানলি মিডলটন এবং ১৯৯২ সালে মাইকেল ওনডাটজে এবং ব্যারি আনসওয়ার্থ যৌথভাবে বুকার জিতেছিলেন। এ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা করা হলে প্রতি বছর একজনকেই পুরস্কার দেয়ার নিয়ম করা হয়। গত ২৬ বছরে এর আর কোনো ব্যত্যয় হয়নি। অ্যালিসন লিখেছেন, বিচারকমণ্ডলীর প্রধান পিটার ফ্লোরেন্সও এই ঘটনায় দুঃখ পেয়েছেন, যখন জানলেন জুরি বোর্ডের সদস্যরা এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। পাঁচ ঘণ্টা ধরে জুরি বোর্ডের সদস্যদের মধ্যে বিতর্কের পর বিজয়ী হিসেবে দুইজনের নাম ঘোষণা করা হয়। বোঝাই যাচ্ছে, তারা একমত হতে পারছিলেন না; আর প্যানেলের চেয়ারম্যানও ছিলেন কার্যত অসহায়। জুরি বোর্ড বা বিচারক প্যানেলের বাকি চার সদস্যই নারী। তারা হলেনÑ আফুয়া হিরশ, লিজ ক্যালডার, জিয়াওলু গুয়ো ও জোয়ানা ম্যাকগ্রেগর। বিচারকরা বলছেন, তারা নিয়ম ভাঙেননি, বরং বলতে হয় তারা দু’জনকে পৃথক করতে পারেননি। অর্থাৎ কাকে বাদ দিয়ে কাকে রাখবেন এ নিয়ে ছিলেন দোটানায়। শেষে তাদের ইচ্ছারই জয় হয়েছে।
সমালোচকদের মত হচ্ছে মার্গারেট অ্যাটউডের সাথে এভারিস্টোকে মেলানো ঠিক হয়নি। সমালোচনাকারীদের মধ্যে আছেন ঝলক প্রাইজের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সানি সিংহ, বিচারক প্যানেলের সাবেক সদস্য স্যাম লিথ ও আরেকজন সাবেক সদস্য। স্যাম লিথের ভাষায়, এটা পচা কাজ হয়েছে। এর মাধ্যমে পচা নজির সৃষ্টি হলো। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অপর সাবেক বিচারক প্যানেল সদস্য বলেন, তিনি এ ঘটনায় হতাশ হয়েছেন। তবে এ ঘটনাকে সমর্থনও করেছেন কেউ কেউ। যেমন মার্গারেট অ্যাটউড এতে অখুশি নন। ঘোষণা অনুষ্ঠানে তার উদযাপনে তা দেখা গেছে। ওয়াসাফিরি ম্যাগাজিনের প্রকাশনা পরিচালক মালাচি ম্যাকিনটস, ডায়ালগ বুকসের প্রকাশক শারমাইন লাভগ্রোভও এই দলে আছেন। লাভগ্রোভ বলেন, এটা একটা ব্যতিক্রমী রাত। দুজনকেই গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। নারীবাদী, কালো নারীদের জন্যও এটা সুসংবাদ। এটা সমতার ক্ষেত্রে বিরাট অগ্রগতি।

২. মার্গারেট অ্যাটউড বয়সে প্রবীণ। পুরস্কার ঘোষণা অনুষ্ঠানের ভিডিও চিত্রে দেখা গেছে, এই প্রবীণা নবীনা অ্যাংলো-নাইজেরিয়ান ইভারিস্টোকে জড়িয়ে ধরে আদর করছেন। যেন বলতে চাচ্ছেন, আমাদের দিন শেষ তোমরাই জায়গা করে নেবে, এসো স্বাগত। ইভারিস্টোও কম যান না, লাজুক ভঙ্গিতে কথা বলেছেন তার সাথে, দিয়েছেন সিনিয়রের মর্যাদা। মার্গারেট অ্যাটউড তার ‘দ্য টেস্টামেন্ট’ উপন্যাসের জন্য এই সম্মান অর্জন করেন। এ নিয়ে তিনবার বুকার পুরস্কারে ভূষিত হলেন তিনি। ২০০০ সালে তিনি প্রথম বুকার পুরস্কার পান ‘ব্লাই-অ্যাসাসিন ’ উপন্যাসের জন্য।
মার্গারেটের জন্ম ১৯৩৯ সালের ১৮ নভেম্বর কানাডার অটোয়াতে। টরন্টো ভার্সিটির অন্তর্গত ভিক্টোরিয়া কলেজে তিনি অধ্যয়ন করেন। সেই কলেজের বার্ষিকীতে তার প্রথম লেখা ছাপা হয়। পরে তিনি ইংরেজি বিষয়ে অনার্স করেন ১৯৬১ সালে। একে বলা হয় মেজর বা প্রধান বিষয়। দর্শন ও ফরাসি ভাষা ছিল তার মাইনর। আমাদের এখানে যাকে বলা হয় সাবসিডিয়ারি। কবিতার বই দিয়ে তার সাহিত্যজীবন শুরু হলেও নাম করেছেন উপন্যাস লিখে। তিনি একই সঙ্গে কবি, ঔপন্যাসিক, সমালোচক ও পরিবেশবাদী কর্মী। তার কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে ১৭টি। রয়েছে ১৬টি উপন্যাস, আটটি নভেলা বা ছোট উপন্যাস ও ১০টি নন-ফিকশন বই। তার বহু উপন্যাস নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। বলা যায়, একজন সফল লেখিকা হিসেবে তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন। তিনি কাফকা পুরস্কারসহ বহু পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। ১৯৬৮ সালে মার্কিন নাগরিক জিম বাককে বিয়ে করেন, তবে ১৯৭৩ সালে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। পরে ঔপন্যাসিক গ্রায়েম গিবসনের সাথে বসবাস করেন। গিবসন ও মার্গারেটের এলিনর নামে একটি মেয়ে আছে। গত ১৮ সেপ্টেম্বর গিবসন মারা যান। শেষ বয়সে এই পুরস্কার তাকে যে নতুন প্রাণশক্তি জোগাবে তা বলাই বাহুল্য।
৩. বার্নারডাইন এভারিস্টোর জন্ম ১৯৫৯ সালে লন্ডনের দক্ষিণ পূর্বে এলথামে। তার মূল নাম হচ্ছে বার্নারডাইন অ্যানি মোবোলাজি এভারিস্টো। সংক্ষেপে বার্নারডাইন এভারিস্টো।
তার মা ব্রিটিশ আর বাবা নাইজেরীয়। এ জন্য তাকে অ্যাংলো নাইজেরিয়ান বা নাইজেরীয় বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ বলা হয়ে থাকে। তিনি আসলে লন্ডনেই বেড়ে উঠেছেন। লন্ডনই তার আরাধ্য। তিনি বর্তমানে লন্ডনের ব্রুনেল ভার্সিটির কিয়েটিভ রাইটিংয়ের প্রফেসর। তার মা-বাবার অতীত আরো বৈচিত্র্যময়। তার নানার বাড়িও নাইজেরিয়ায় আর নানী আয়ারল্যান্ডের। তার দাদার মূল বাড়ি ব্রাজিলে। আগে এভারিস্টো লেসবিয়ান ছিলেন বলে জানা যায়। পরে অবশ্য একজনকে বিয়ে করেন। আর তা করেন ইন্টারনেটে যোগাযোগের মাধ্যমে বন্ধুত্ব হওয়ার পর। এটা ২০০৬ সালের ঘটনা। এভারিস্টোর নাট্য সাহিত্যের দিকে ঝোঁক বেশি দেখা যায়। তবে লেখালেখিতে উপন্যাসই এগিয়ে। তিনি গার্ডিয়ানসহ বিভিন্ন পত্রিকায় সাহিত্য বিষয়ে লেখালেখি ও সাহিত্য সমালোচনা করে থাকেন। এ পর্যন্ত তার আটটি উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে। কালো লেখিকা হিসেবে বুকারের শর্টলিস্টে স্থান করে নেয়ার পর থেকেই তিনি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। এভারিস্টো বুকার জয়ী প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ নারী এবং সেই সাথে ব্রিটেনেরও প্রথম কালো নারী। স্বভাবতই কালোরা তার এই সাফল্যে খুশি।

৪. এভারিস্টো যে উপন্যাসের জন্য বুকার পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন তার নাম ‘গার্ল, ওম্যান, আদার্স’। এটি ১২ জন কালো ব্রিটিশ রমণীর কাহিনী। তাদের চরিত্র যেমন বিচিত্র্য, বয়সও তেমনি বিচিত্র্য। এই নারীদের বয়স ১৩ থেতে ৯৩। অর্থাৎ টিনএজ কন্যা যেমন আছে, তেমনি আছে থুত্থুরে বুড়ি। এই চরিত্রগুলো নানা কালচারে ও সেক্সুয়ালিটিতে বিভক্ত। বাংলায় কি বলা যায়? বুঝে নেয়াই উত্তম, আশা করি পাঠকের বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। এর ভেতর ট্রান্সজেন্ডার থাকা স্বাভাবিক। আর তারাও তো মানুষই। এসব চরিত্রের সুখ-দুঃখ, কামনা-বাসনা, চাওয়া ও অচরিতার্থতার বেদনা, তাদের জীবন সংগ্রাম উপন্যাসে ফুটে উঠেছে। জুরি বোর্ড হয় তো সেটারই মূল্যায়ন করেছেন। আরো বিস্তারিত করলে বলতে হয় ‘গার্ল, ওম্যান, আদারস’-এ কালো ব্রিটিশ, জীবনযুদ্ধে জয়ী, পরাজিত এমন ১২ জন নারীর পরিবার, বন্ধু এবং প্রেমের গল্প নিয়ে গড়ে উঠেছে। আনন্দ এবং শব্দময়তায় ভরা প্রাণবন্ত এই উপন্যাসটি যেন সমকালীন ব্রিটিশ নারীদের হৃদয়ের ইতিহাস ধারণ করে আছে। ১২ জন নারী চরিত্রের মধ্য দিয়ে আমাদের সমকালীন সামাজিক জীবনের উদযাপন, অপ্রতিরোধ্য জীবনযাপন আর গতিময়তাকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
বিচারকরা উপন্যাসটি সম্পর্কে বলেছেন, বর্তমান সময়ের ব্রিটিশ নারীবাদী উপন্যাস হিসেবে এটি অতুলনীয়। বর্তমান ব্রিটিশ সমাজের প্রত্যেকটি ধ্বনি এই উপন্যাসের মাধ্যমে প্রতিধ্বনিত হয়েছে। একটি কৃষ্ণাঙ্গ ব্রিটিশ পরিবারের জীবন, তাদের সংগ্রাম, বেদনা, হাসি, আকাক্সক্ষা ও ভালোবাসা একই সাথে একটি চিত্তাকর্ষক হয়ে উঠেছে উপন্যাসটিতে। ১২টি প্রধান চরিত্র সামাজিক জীবনের উত্থান-পতন উভয়ই প্রকাশ করে। শিল্পী, ব্যাংকার, শিক্ষক, ক্লিনার, গৃহিণী, কৈশোর থেকে বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত নারীত্বের বিভিন্ন পর্যায়কে তিনি দারুণভাবে বিশ্লেষণ করেছেন।
এভারিস্টোর লেখা অন্যান্য উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে আইল্যান্ড অব আব্রাহাম, হ্যালো মাম, লারা ও ব্লন্ড রুটস। সব বই-ই কমবেশি জনপ্রিয়তা পেয়েছে। আগেই বলেছি লন্ডনে বেড়ে উঠেছেন বলে এভারিস্টোর চিন্তা-চেতনায় এই শহর আচ্ছন্ন। তিনি একজন কৃষ্ণাঙ্গ নারী। লন্ডনে হয়তো তাকে এ জন্য বয়ে বেড়াতে হয়েছে গ্লানি। লন্ডন আধুনিক বটে, বর্নবাদ থেকে তো একেবারে মুক্ত নয়। কালো কেন বাদামিরাও সেখানে বৈষম্যের শিকার। এভারিস্টো লেখালেখি ও শিক্ষকতার পাশাপাশি কিছু সামাজিক দায়িত্বও পালন করেছেন। তিনি লন্ডনে ব্লাক ওমেন থিয়েটারের প্রতিষ্ঠাতা। এটি সেখানে এ ধরনের প্রথম সংগঠন। ১৯৯০ সালে তিনি প্রথম ব্লাক ব্রিটিশ রাইটিং ফেস্টিভ্যালের আয়োজক আর ১৯৯৫ সালে করেন ব্লাক থিয়েটার ফেস্টিভ্যাল। তিনি নাট্য বিষয়ে পড়ালেখা করেন গ্রিনউইচ ইয়ং পিপল থিয়েটারে। এ শিক্ষাই তিনি কাজে লাগিয়েছেন এসব উৎসব পালনে।


আরো সংবাদ



premium cement