২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

বিজয়ের আরেক গল্প

-

সবাই মিলে ঠিক করেছে জনপ্রতি তিন হাজার টাকা করে দেবে আর এলাকার ছোট-বড় সব দোকান থেকে ৫০০ করে চাঁদা নিয়ে সব মিলে লাখখানেক টাকা কালেকশন করা হবে।
এই টাকা দিয়ে বড় এক কাণ্ড করার পরিকল্পনা রাশেদদের। মুক্তিযোদ্ধাস্তম্ভের পাশের খালি মাঠে বিশাল আকারের একটা বাংলাদেশের মানচিত্র বানানো হবে। হাজারো ফুল দ্বারা তৈরি হবে এ মানচিত্রটি, নিচে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা থাকবে তাদের সব বন্ধুর নাম। সবার চোখে এখন এই স্বপ্ন উঁকি দিচ্ছে।
অন্য দিন এখানে সুনসান নীরবতা থাকলেও আজ লোকে লোকারণ্য। সিটি করপোরেশনের লোক ধোয়ামোছার কাজ করছে, কিছু মহিলা ঝাড়ু হাতে বসে আছে, রাস্তায় পানি ছিটানোর গাড়িকে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে।
স্মৃতিস্তম্ভের সামনের ফটকে দাঁড়িয়ে রাশেদরা। আগামীকাল মানচিত্র তৈরি করার কাজে হাত দেবে তারা। শ্রদ্ধা জানাতে আসা লোকজন ফুলের মানচিত্র দেখে চমকে উঠবে, বড় রকম এক সারপ্রাইজ হচ্ছে ভেবে সবার মনে এক অন্যরকম আনন্দের সুবাতাস বয়ে চলছে। মনির তো বলেই উঠল, ‘১৬ ডিসেম্বরের পরে এলাকার মানুষ আমগোরে মাথায় তুলে নাচব।’ মনিরের এমন বাক্যে সবাই হো হো করে হেসে উঠল।
খুব চিন্তিত হয়ে বসে আছে সবাই, সকাল থেকে রাশেদকে পাওয়া যাচ্ছে না। ফোনের সুইচ অফ। কালেকশন করা লাখখানেক টাকা তার হাতে। তাকে ছাড়া অর্ডার করা ফুলগুলো আনা যাচ্ছে না; অথচ রাজ্যের কাজ বাকি।
পারভেজ অনেকক্ষণ বসে থেকে বিরক্তি ভাব নিয়ে বললÑ ‘আসবে না। সে আর আসবে না। ধোঁকা দিয়ে টাকা সব মেরে দিয়েছে।’ এ কথায় সবার উৎকণ্ঠা বাড়তে থাকে। পারভেজের সন্দেহ সত্যি করে ওইদিন আর রাশেদ আসেনি...।
১৬ ডিসেম্বরের পরের দিন রাশেদকে পাওয়া যায়। বন্ধুদের সামনে আসামির কাঠগড়ায় মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে সে। বন্ধুরা তাকে ঘিরে ধরে আছে।
কারো কোনো কথা নেই। সবার চোখ লালবর্ণ হয়ে আছে। চোখে মুখে ক্রোধ ঝড়ছে এমন।
নাঈম বললÑ ‘রাশেদ তোকে এখন কী করা উচিত বল? সামান্য কয়টা টাকার লোভ সামলাতে পারলি না!’
পাশ থেকে মনির বলে উঠলÑ ‘ছি: রাশেদ, ছি:! তুই এমন? ভাবতে পারিনি।’
পারভেজ সিগার টানতে টানতে বলেÑ ‘এত প্যাচাল কিসের? শালারে পুলিশে দে। হের কারণে এলাকায় আমগো মান-ইজ্জত ডুইবা গ্যাছে।’ সাদ্দাম কাছে আসেÑ ‘এই তোরা থাম, ওরে কিছু বলার সুযোগ দে।’
সবাই থামে, রাশেদ মাথা তুলে, চোখ থেকে ক্রমাগত অশ্রু জড়ছে, চোখেমুখে অবিশ্বাসের ছাপ স্পষ্ট। এরা কি তারই বন্ধু? মনে মনে ভাবে সে।
কথা বলার ভাষা নেই, তবুও অস্ফুট স্বরে বিড়বিড় করে বলে রাশেদÑ
‘মহান মুক্তিযুদ্ধে দুই পা হারানো কাশেম কাকুরে তো তোরা সবাই চিনিস।’
(বন্ধুরা হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ে)।
‘কাকু খেয়ে-না খেয়ে দিন পার করে যাচ্ছিলেন, কখনো কারো কাছে অভিযোগও করেননি, হাতও পাতেননি।
কিন্তু জানিস ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস, টাকার অভাবে দীর্ঘ দিন চিকিৎসা না হাওয়ায় ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে তিনি এখন মৃত্যুপথযাত্রী।’
(বন্ধুদের চোখেমুখে বিস্ময়ের ছাপ)।
এবার চোখ বড় করে রাশেদ, গালে লেগে থাকা পানি দুই হাত দিয়ে মুছে ফেলে, ঘাড়কে টান টান রেখে বন্ধুদের দিকে ফিরে তাকায়।
তাকে এখন প্রতিবাদী দেখাচ্ছে, বন্ধুরাও তাকিয়ে আছে কী বলবে শোনার অপেক্ষায়। রাশেদ কণ্ঠস্বর ভারী করে ফেলেÑ ‘একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা হাসপাতালের বারান্দায় মৃত্যুযন্ত্রণায় কাতরাবে আর আমরা চুপ করে বসে থাকব? এটা হতে পারে না।’
আমার বিবেক সায় দেয়নি, আমি অন্য ছক এঁকেছি। আমি বিজয় দিবস পালন করেছি টাকাগুলো কাকার চিকিৎসা খাতে ব্যয়ের মধ্য দিয়ে।’
দুই হাত উঁচিয়ে রাশেদ চেঁচিয়ে উঠে বলেÑ ‘এ অন্যায়ের জন্য দে আমাকে পুলিশে দে। আমার চুল কেটে এলাকায় ঘোরা।’
বন্ধুরা সবাই হাউমাউ করে কেঁদে উঠে রাশেদকে বুকে টেনে নেয়। রাশেদও কাঁদছে। আজ এদের কান্না থামার নয়...
নাজির রোড, ফেনী


আরো সংবাদ



premium cement