২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ফুলের গ্রাম

-

ফুলে ফুলে মধু আহরণ করছে শত শত মৌমাছি। সূর্যমুখীতে যেন সূর্যের হাসি ফুটে উঠেছে কৃষকের মুখে। সেসব নয়নাভিরাম দৃশ্য কেবলই সবাইকে কাছে টানে। সারি সারি ফুলের গাছ। লাল, হলুদ, বেগুনি আর সাদা রঙের ফুল এবং সবুজ পাতায় মোড়ানো অজস্রগাছ। পুরো মাঠ যেন রংয়ের মেলা। চারদিক থেকে হাওয়ায় ভেসে আসছে বাহারি ফুলের গন্ধ। ফুলের গন্ধে ম ম করা একটি গ্রাম সাবদি। যেদিকে দু’চোখ যায় কেবল ফুল আর ফুল। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেই চোখ জুড়িয়ে যায়। ফুলের সুবাস যেন মন ভরিয়ে দেয়। এমন ফুলের রাজ্যে যেতে চাইলে আপনাকে খুব বেশি কষ্ট করতে হবে না। ঢাকার কাছেই নারায়ণগঞ্জের বন্দরের সাবদি গ্রাম। এ গ্রামের আশপাশের সব জমি ও বাড়ির আঙ্গিনায় কাঠমালতি, গাঁদা, ডালিয়াসহ হরেক রকমের ফুলের বাগান। সাবদি গ্রামসহ আশপাশের আরো গ্রামগুলোতে কেউ পা রাখলেই বিস্মিত হয়ে ওঠে। গ্রামগুলোকে ঘিরে শুধু বাগান আর বাগান। কয়েক বর্গমাইল এলাকাব্যাপী কাঠমালতি, গাঁদা, ডালিয়া ও জিপসি ফুলের গুচ্ছ গুচ্ছ বাগান। বাড়ির আঙিনা থেকে শুরু করে গ্রামগুলোর রাস্তার দুই ধারে হাজারো কাঠমালতির সারি সারি বাগান। সারা গ্রামের সব জমিতে ফুল আর ফুল। ফুলের সাম্রাজ্য সাবদি ছাড়াও দেখা মেলে দিঘলদী, সেলশারদী, মাধবপাশা, আইছতলাসহ সোনারগাঁও উপজেলার সম্ভুপুরা ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রামে। এসব গ্রামে কাঠমালতি, গাঁদা, বেলী ও জিপসি ফুলের বাগান করে শতাধিক মানুষের পরিবারে সচ্ছলতা ফিরে এসেছে। তাই সাবদি ও দিঘলদী গ্রামকে এখন সারা দেশে ফুলের গ্রাম নামে পরিচিতি লাভ করে।
নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার সাবদি, দিঘলদী গ্রামের অবস্থান। গ্রামগুলোর পাশ ঘেঁষে বয়ে চলেছে ব্রহ্মপুত্র নদ। নদের পশ্চিম ধারে সারি সারি কাঠমালতির বাগান। ফুলের চাষাবাদ করে এ এলাকার লোকজন তাদের ভাগ্যের চাকার পরিবর্তন করেছে। বদলে গেছে এ গ্রামের দৃশ্যপট। ব্রহ্মপুত্র নদীর তীরে ছায়া ঢাকা, পাখি ডাকা শান্ত পরিবেশের গ্রামগুলোতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় পাঁচ-ছয় হাজার লোক জড়িত আছে ফুলবিষয়ক বাণিজ্যে। তারা ফুল উৎপাদন, ফুলের মালা তৈরি ও ফুল বিক্রিতে সরাসরি জড়িত আছেন। প্রতিদিন লাখ লাখ টাকার ফুল ঢাকা শাহবাগ ও চট্টগ্রামের ফুলের আড়তে যায়। এখানকার ফুল রাজধানী ঢাকাসহ বাংলাদেশের সব প্রান্তের চাহিদা পূরণ করে থাকে। এমনকি চাষকৃত ফুল কয়েকটি দেশে রফতানিও করা হয়। এতে যেমন কৃষকের লাভ বেড়েছে তেমনি অন্য দিকে বেড়েছে দেশের সুনাম। সরকারও লাভবান হচ্ছে। বিভিন্ন অনুষ্ঠানের সময় চাষিদের ব্যস্ততা খুব বেড়ে যায়।
জানা গেছে, দিঘলদী গ্রামের বেকার যুবক সুধেব চন্দ্র দাস প্রথম এ গ্রামে ফুলের চাষ শুরু করেন। পরে আরো কয়েকজন বেকার যুবক ওই গ্রামে সুধেবের দেখাদেখি ফুলের চাষাবাদ করেন। ওই গ্রামের রহমতউল্লাহ ১৯৯২ সালে ডেমরার বাওয়া জুট মিলের চাকরি চলে যাওয়ার পর তিনি ঢাকায় ফেরি করে ফুলের ব্যবসায় শুরু করে। পরে ওই গ্রামের অপর ফুল ব্যবসায়ী মোতালেবের উৎসাহে ১৯৯৫ সালে তিনি গ্রামে এসে বার্ষিক ইজারা ভিত্তিতে অন্যের জমিতে ফুল চাষ শুরু করেন। বর্তমানে রহমতউল্লাহর ফুল চাষ করে নিজে ২০ বিঘা জমির মালিক হয়েছেন। রহমতউল্লাহর মতো ওই গ্রামের ইসমাইল হোসেন, নকুল চন্দ্র হাওলাদার, শরীফ, আবদুল বাতেন, এমদান হোসেন, শফিকুল ইসলাম, মোসলেমউদ্দিন, আবদুল মান্নান, জাকির, আনোয়ার হোসেন, ইকবাল, মোস্তফা, সিরাজ, জহির, সিদ্দিক, ইউসুফ, মনিরসহ প্রায় দুই শতাধিক লোক কাঠমালতি গাঁদা, জিপসি ও বেলী ফুলের চাষ করছেন। এ ফুল চাষের পেশার সাথে জড়িয়ে আছে আরো প্রায় এক হাজার শ্রমিকের জীবিকা। এ ফুল চাষে পুরুষদের পাশাপাশি মহিলা ও স্কুলেপড়–য়া ছাত্রছাত্রীরা জড়িত রয়েছে। তারা প্রতিদিন খুব ভোরে ঘুম থেকে ওঠে কাঠমালতির ফুল বাগানে কলি আহরণের উদ্দেশ্যে যায়। সাংসারিক সুখ-দুঃখের আলাপচারিতার ফাঁকে ডালা ভরে ফুল কলি তুলে যার যার বাড়িতে ফিরে আসে। কাঠমালতির ফুল দিয়ে ‘গাজরা’ ও ফুল কলির লহর বানাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে সাবদি, দিঘলদীসহ ওই এলাকার সব মহিলা। স্কুলের ছাত্রছাত্রীরাও সকাল ৯টা পর্যন্ত কলি তুলে স্কুলে যায়। তারা আবার বিকেলে বাড়ি ফিরে ফুলের লহর বানাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এ দিকে, ফুলচাষিরা বাগান থেকে তুলে আনা ফুল বাড়ির আঙ্গিনায় মালা গেঁথে সেগুলো সন্ধ্যায় সাবদি বাজারে নিয়ে জড়ো করে। সাবদি বাজার থেকে ট্রাকে করে পাইকাররা প্রতি রাতে এসব ফুল ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে নিয়ে যায় বিক্রির জন্য। তিন ধাপে কাঠমালতি ফুল বাজারজাত হয়। প্রথম ধাপে বাগান করা, দ্বিতীয় ধাপে ফুল ক্রয় করা এবং তৃতীয় ধাপে তা শাহবাগে এবং চট্টগ্রামের ফুলের হাটে কাঠমালতির ফুলকলি বাজারজাত করা হয়। বাসরঘর সাজানোর জন্য এবং বিভিন্ন পূজা আর্চনায় কাঠমালতি ফুল কলির ব্যাপক চাহিদা আছে বাজারে। তাছাড়া বর্তমানে আধুনিক তরুণীদের খোঁপায় কাঠমালতির ফুলকলির ‘গাজরার’ ব্যবহার বেড়ে যাচ্ছে।
ফুলচাষি শফিকুল ইসলাম জানান, ১৯৯৯ সালে এসএসসি পাস করার পরে তিনি পৈতৃক সম্পত্তিতে ফুল চাষ শুরু করেন। আগে এসব জমিতে নানা রবিশস্যের চাষ করা হতো। গ্রামের অন্য ফুলচাষিদের দেখে তিনি অনেকটা শখের বশেই ফুল চাষ শুরু করেন। তবে সেসময় খুব বেশি ফুলচাষি ছিলেন না। গত এক যুগে তিনি ফুল চাষ করে নিজের ভাগ্য পরিবর্তন করেছেন।
ডালিয়া চাষি মোছলেউদ্দিন জানান, তিনি এক বিঘা জমিতে ডালিয়ার চাষ করেছেন। এক হাজার চারা ১০ টাকা দরে ১০ হাজার টাকার চারা রোপণ করেছিলেন। গত চার মাসে মজুরি ও সারের খরচ বাবদ আরো ৪০ হাজার টাকা গেলেও এ পর্যন্ত তিনি প্রায় এক লাখ টাকার ফুল বিক্রি করেছেন আরো ফুল জমিতে রয়েছে।
ফুলচাষি কৃষক আনোয়ার হোসেন জানান, কাঠবেলী ফুলের চাষ বেশি হয়ে থাকে। কারণ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ও ভালোবাসা দিবসে এর চাহিদা থাকে। আর এ কারণে এই ফুল চাষের প্রতি চাষিদের আগ্রহ বেশি। গ্ল্যাডিওলাস ফুল এক বিঘা জমিতে চাষ করা হলে প্রায় আট হাজার স্টিক পাওয়া যায়। এ ছাড়াও এখানে ডালিয়া, জিপসি, আলমেন্দা, গাঁদা ও রজনীগন্ধা ফুলের চাষ করা হয়। ফুলচাষিরা জানান, তারা রবিশস্য চাষ করে যা পান তার থেকে আট-দশগুণ বেশি লাভবান হচ্ছেন ফুল চাষ করে। এ কারণে অনেকেই বাপ-দাদার আদিম চাষ পরিবর্তন করে ফুল চাষের প্রতি ঝুঁকেছেন। আর এতে লাভও হচ্ছে। এ গ্রামের মানুষ ফুল চাষ করে তাদের পুরো এলাকার চিত্র পাল্টে দিয়েছে। গ্রামের সবাই এখন স্বাবলম্বী। একটু অবসর পেলেই দৃষ্টি এবং মন জুড়াতে চলে যেতে পারেন সাবদি এবং তার আশপাশের গ্রামে। আপনার জন্য অপেক্ষা করছে অপরূপ সৌন্দর্যের অন্য এক ভুবন।


আরো সংবাদ



premium cement
গাজায় ইসরাইলের যুদ্ধের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ অব্যাহত পাবনায় ১০ কোটি টাকার অনিয়মে ৩ ব্যাংক কর্মকর্তা আটক জীবন্ত মানুষকে গণকবর আগ্রাসন ও যুদ্ধকে ‘না’ বলার আহ্বান মার্কিন মানবাধিকার প্রতিবেদনে আনা অভিযোগ ভিত্তিহীন : পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বৃষ্টির জন্য সারা দেশে ইসতিস্কার নামাজ আদায় আরো ৩ দিনের হিট অ্যালার্ট তাপপ্রবাহ মে পর্যন্ত গড়াবে আঞ্চলিক নিরাপত্তা নিশ্চিতে ঢাকার ভূমিকা চায় যুক্তরাষ্ট্র বিদ্যুৎ গ্যাসের ছাড়পত্র ছাড়া নতুন শিল্পে ঋণ বিতরণ করা যাবে না মিয়ানমারে ফিরল সেনাসহ আশ্রিত ২৮৮ জন বিএনপি ক্ষমতায় যেতে মরিয়া হয়ে উঠেছে : কাদের

সকল