২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

বইপ্রেমী এক চিকিৎসকের গল্প : জীবনের বাঁকে বাঁকে

-

বই পড়ে কেউ দেউলে হয়নি। সত্যি কেউ দেউলিয়া হয়নি। বইপড়ুয়া মানুষের সংখ্যা খুব বেশি না। আবার অনেকেই আছেন যারা অবসর পেলেই বই পড়তে বসে যান। বইপ্রেমী মানুষেরা বই নিয়েই সময় কাটাতে পছন্দ করেন। আজ তেমনি এক বইপ্রেমী মানুষের গল্প শুনব।
নাম রিয়াজ উদ্দিন। পেশায় চিকিৎসক। বইয়ের প্রতি তার ভালোবাসা কেমন তা দেখতে হলে একবার বাসায় গেলেই বোঝা যাবে। তাকে হাজার হাজার বই সাজানো। বইয়ের কোথাও একটু ধুলোর আস্তরণ নেই। দেশী-বিদেশী বইয়ের সমাহার এই তাকগুলোতে। এই বইগুলো কি নিতান্তই সংগ্রহের জন্য? এমন প্রশ্ন করার পর মুচকি হেসে রিয়াজ উদ্দিন বললেন, না, এগুলো শুধু সংগ্রহের জন্য না। এসব বই আমি পড়েছি। তাও একবার নয়, বহুবার। বই পড়াটাই আমার নেশা। যখন যেখানে ভালো বই চোখে পড়ত, সেটাই কিনে নিতাম। পড়া শেষ হলে সুন্দর করে তাকে সাজিয়ে রাখি। আবার ইচ্ছে হলে এখান থেকে নিয়ে পড়ি।
কিভাবে বই পড়া শুরু হয় কিংবা বই নিয়ে নানা কথা বলতে লাগলেন এই বইপ্রেমী চিকিৎসক। বই পড়া কিভাবে শুরু হয় তা ঠিক মনে নেই। তবে বাবা-মা প্রচুর বই পড়তেন। তাদের নিজস্ব একটা লাইব্রেরি ছিল। আমার মামারাও অনেক বই পড়তেন। নানুর বাড়িতে গেলে দেখতাম তারা বই নিয়ে পড়ে আছে। আমার মনে হয় বইয়ের মাঝে থাকতে থাকতে একসময় বই পড়া শুরু হয়ে যায়। প্রথম বই বাবাই কিনে দিয়েছিলেন। কিছু শিশুতোষ বই সম্ভবত। তবে নামধাম এখন মনে নেই।
ছোটবেলায়ও তিনি অসংখ্য বই পড়েছেন। ওই সময়গুলো কেটেছে ফেলুদা, তিন গোয়েন্দা, প্রফেসর শঙ্কু, চাচা চৌধুরী, টিনটিন, কুয়াশাসহ আরো অনেক বই নিয়ে। তবে চাচা চৌধুরী আর তিন গোয়েন্দা তার ভীষণ প্রিয় ছিল। রিয়াজ উদ্দিন আমাদের আরো জানালেন, ছোটবেলার অবসর সময়গুলো তার বই পড়েই কাটত। কোথাও বেড়াতে গেলে তার ব্যাগে বই থাকত। বাসে বসে কিংবা বাসস্ট্যান্ডে বসেও তিনি বই পড়তেন। ক্লাসে যাওয়ার সময় ব্যাগে করে বই নিয়ে যেতেন। ওই সময়গুলোতে কোনো বাধা পেয়েছেন কি না পরিবার বা অন্য কারো কাছ থেকে? এমন প্রশ্নের জবাবে রিয়াজ উদ্দিন জানালেন, বই পড়তে গিয়ে তেমন বাধার সম্মুখীন হইনি। পারিবারিকভাবেই বই পড়ায় আগ্রহ জন্মেছে। বাধা যা একটু পেয়েছিলাম স্কুলে থাকতে। অষ্টম বা নবম শ্রেণীতে ব্যাগে আউট বই নিয়ে স্কুলে যেতাম বই আদান-প্রদানের জন্য। অদ্ভুত ব্যাপার, অনেক শিক্ষক ব্যাগ চেক করতেন পাঠ্যবই বাদে বই আছে কি না, আর থাকলে জব্দ করার চেষ্টা করতেন। আমি আজো এই মন-মানসিকতার কারণ খুঁজে পাইনি, আউট বই পড়লে কী এমন ক্ষতি হয়, কেউ উচ্ছন্নে তো আর যাচ্ছে না! বলতে দ্বিধা নেই, এখনো এমন ছোট মনের লোকজন অনেক আছেন, যারা মনে করেন পাঠ্যবই বাদে অন্য বই পড়লেই পড়ালেখার বিরাট ক্ষতি হয়ে যাবে। মা-বাবা তেমন বাধা দেননি। এমনকি আমি বৃত্তি পরীক্ষা, এসএসসি বা অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষার সময়ও পড়ার মাঝে আউট বই পড়েছি। যেহেতু রেজাল্ট ভালো ছিল, তাই এ ব্যাপারে ছাড় ছিল।
বই পড়াতে সবচেয়ে বেশি উৎসাহ দিতেন বাবা-মা ও ছোটমামা। বাবা-মা কোনো উপলক্ষ থাকলেই বই কিনে দিতেন; জন্মদিন, পরীক্ষা, রেজাল্ট। এর বাইরে তিন মামা, সামসু কাকা বই কিনে দিতেন। তবে একটা বই গিফটের কথা খুব মনে আছে। আমার কাজিন আবদুল্লাহ আল মামুন বর্তমানে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হিসেবে কর্মরত। তিনি আমাকে ড. জাফর ইকবালের আমার বন্ধু রাশেদ বইটা কিনে দেন। আমার ডাকনাম রাশেদ। আর বইয়ের প্রধান চরিত্রের নামও রাশেদ। ওই সময় বইটা পড়ে খুব মজা পেয়েছি। আমি বাবা-মায়ের কাছে বই কিনে দেয়ার জন্যই বায়না ধরতাম। তারা আমাকে কখনোই হতাশ করেননি।
রিয়াজ উদ্দিন ছাত্রজীবনে খুব ভালো ছাত্র ছিলেন। পঞ্চম, অষ্টম শ্রেণীতে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পান। এসএসসি ও এইচএসসিতে পান এ প্লাস। এরপর চান্স পান ফরিদপুর মেডিক্যাল কলেজে। চিকিৎসাবিজ্ঞানে পড়া শেষ করে বিসিএস দেন। ৩৩তম বিসিএসে তিনি ক্যাডার হন। বর্তমানে নোয়াখালী জেলার সোনাইমুড়িতে কর্মরত।
এক মজার তথ্য জানালেন তিনি। পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণীতে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পাওয়ার টাকা দিয়ে তিনি বই ছাড়া কিছুই কিনেননি। আস্তে আস্তে কিভাবে যে তার বইয়ের সংখ্যা বাড়তে লাগল তা তিনি টেরই পেলেন না। বইয়ের সংখ্যা প্রায় সাড়ে তিন হাজারেরও বেশি। গল্প, উপন্যাস, থ্রিলার, অনুবাদ, ইতিহাস, সায়েন্স ফিকশন, কবিতা, ধর্মীয়, কমিকস। সিরিজের মধ্যে মাসুদ রানা, তিন গোয়েন্দা, ফেলুদা, শঙ্কু, টিনটিন, ফ্যান্টম, ক্রুসেড, দস্যু বনহুর, অদ্ভুতুড়ে। এ ছাড়াও ল্যাংডন, এম্পায়ার অব দ্য মোগল, রামেসিস, সিগমা ফোর্স, হ্যারি পটার সিরিজ আছে। বিদেশী লেখক ড্যান ব্রাউন, জেমস রলিন্স, ডেভিড বালদাশি, উইলবার স্মিথ, পাওলো কোয়েলহো, জে কে রাওলিংসহ অনেকের বই-ই সংগ্রহে আছে। ঐতিহাসিক ফিকশন-ননফিকশন অনেক বই আছে। সাক্ষী ছিল শিরস্ত্রাণ, মুর্শিদাবাদ কাহিনী, কিংবদন্তির ঢাকা, এম্পায়ার অব দ্য মোগল সিরিজ, রামেসিস সিরিজ, ফারাও সিরিজ, দাস পার্টির সন্ধানে, আরো বই আছে।
বই নিয়ে কোন প্ল্যান আছে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন। বই নিয়ে তেমন প্ল্যান নেই। মনের খোরাক হিসেবেই বই পড়ি। ব্যস্ততা আর কাজের ফাঁকে বই একটু স্বস্তি এনে দেয়। বই পড়তে পড়তে জমানোর চেষ্টাও করছি, সেভাবেই সংগ্রহ গড়ে উঠেছে। অবচেতন মনেই একটা ইচ্ছে কাজ করে, বইবিমুখ আধুনিক প্রজন্মকে বই পড়ার আনন্দের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়ার, বই পড়তে উৎসাহ দেয়ার।
কথার মাঝেই প্রিয় বই কোনটি তা জানতে চেয়েছি। তিনি বলেন, প্রিয় বই অনেক, কোনটা ছেড়ে কোনটার কথা বলি! যা যা মনে পড়ছে, তার মাঝে আয়না (আবুল মনসুর আহমেদ), অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট (এরিখ মারিয়া রেমার্ক), ফাউন্ডেশন সিরিজ (আইজাক আজিমভ), আবু ইব্রাহীমের মৃত্যু (শহীদুল জহির), টুকি ও ঝায়ের (প্রায়) দুঃসাহসিক অভিযান (মুহাম্মদ জাফর ইকবাল), দ্য ব্রিজ অন দ্য রিভার কওয়াই (পিয়েরে বুলে), সত্যজিতের শঙ্কু আর ফেলুদা সিরিজ, শরদিন্দুর ব্যোমকেশ বক্সি সিরিজ, জামশেদ মুস্তফীর হাড় (আবদুল হাই মিনার) উল্লেখযোগ্য।
তার ভুবন হলো বই নিয়ে। ঘুম থেকে উঠেই বইগুলো দেখেন। আবার ঘুমানোর সময় বইগুলো ঠিক করে রাখেন। ছুটির দিনগুলোতে বইগুলো মুছে রাখেন তিনি। আর যেগুলো রোদে দেয়া দরকার সেগুলো রোদে দেন।
কথা বলতে বলতে আমাদের সময়ও শেষ হয়ে এলো। ডাক্তার রিয়াজ উদ্দিনের কাছ থেকে বিদায় নেয়ার সময়ও হয়ে এল। আমরা উঠে পরলাম।


আরো সংবাদ



premium cement