২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ভাই জীবনের বাঁকে বাঁকে

-

পৌষ মাস। পৌষে ধানেভরা মামাদের আঙিনা। তখন আমি ছোট। বেশ কিছু দিন হয়েছে আমি আর মা মামাবাড়িতে গিয়ে রয়েছি। আব্বু মাঝে মাঝে যায়, আবার চলে আসে। সেদিন বিকাল থেকে হঠাৎ কেমন যেন মনে হলো মা কান্না লুকাচ্ছে। আমি বারবার বলছিÑ মা কী হয়েছে, মা কোনো উত্তর দিচ্ছে না বরং আমার মাথায় হাত বুলিয়ে কপালে চুমু খেয়ে বলছে কিছু হয়নি আব্বা। তুমি আজ তোমার খালামণির কাছে ঘুমাবা। আমার একটাই খালামণি। মাকে ছাড়া আমি কোনোদিন একা ঘুমোয়নি এর আগে। বিকেল থেকেই একটাই দুশ্চিন্তা রাতে মায়ের কাছে না ঘুমাতে পারা। আমার নানা গৃহস্থ মানুষ। চার ভিটায় চার চারটা ঘর। কেমন যেন বাড়ির সবাই কানাঘুষা করছে। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত। খালামণি আমাকে ঘুম পাড়ানোর জন্য হাজার প্রকারের কৌশল খাটাচ্ছে। কিন্তু ঘুম আনতে পারছেন না, আমার চোখে। আসবে কী করে। আমার দেহটায় রয়েছে শুধু বিছানায়, আমার মন-ধ্যান-জ্ঞান রয়েছে আমার মায়ের কাছে। আমার মা কী করছে। কোথায় ঘুমোচ্ছে। কেন আমাকে সাথে ঘুমোতে নিচ্ছে না। হঠাৎ কেমন যেন আমার মায়ের কান্নার আওয়াজ কানে এলো। খেয়াল করে দেখলাম আমার মা কান্না করছে। আমরা উত্তরের ঘরে, আর মায়ের কান্নার আওয়াজ আসছে উত্তর ভিটার ঘর থেকে। সেই থেকে শুরু হলো কান্না। সে কী কান্না, কথা একটাইÑ আমি মায়ের কাছে যাবো, আমার মায়ের কাছে যাবো। সারা রাত কেঁদেছিলাম। আমার মনে আছে আমার সেজো মামা আমার কান্নার চোটে ঘুমোতে না পেরে রেগে বলেছিলেন যে, ওকে খালের ভেতর ফেলে দিয়ে আয়। আর সহ্য হচ্ছে না। ঘুমাতেই দিলো না। কি ছেলে, ও মাকে ছাড়া একটা রাত ঘুমাতে পারছে না। বারান্দা থেকে নানা হরেক রকমের জিনিসের লোভ দেখাচ্ছিল। সকালে উঠে কাঠের ঘোড়া কিনে দেবো। মিষ্টি খাওয়াব এটা-ওটা। কিন্তু আমার কান্না আর থামে না। কান্নাকাটি করতে করতে ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়েই বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম আমি। সকালে ঘুম থেকে ছোট মামা ডেকে উঠালেন। সে দিন ছিল বৃহস্পতিবার। আমার জন্মবার। ১৯৯৩ সালের কোনো এক বৃহস্পতিবারে আমি জন্মেছিলাম। যা হোক, মামা বললেনÑ চলো মামা আমরা ধানের পালা থেকে ধান পাড়ি। খলাটে ধানের আঁটি বড় জায়গা নিয়ে পালা দিয়ে রাখা। মামার কথা শুনে খলাটে গিয়ে উঠলাম, ধানের পালায় হুড়–স হাড়–স করে ধানের আঁটি ফেলতে লাগলাম নিচে। ধান মাড়াই করবে জনেরা। ছোট মামা বললেন, আমার নাকি ভাই না হয় বুড্ডি হবে। মামা মানে কি। মানে তোমার আর একটা ভাই হলে ভালো লাগবে নাকি, বোন হলে? আমি কি উত্তর দিয়েছিলাম সঠিক মনে করতে পারছি না। তো ধানের পালার ওপর থেকে আমি আর মামা কথা বলাবলি করছি। ছোটমামা দুইটা নাম বললেন একটা ছেলের নাম ও একটা মেয়ে নাম। আর বললেন, ছেলে হলে এই নাম রাখতে হবে, আর মেয়ে হলে এটা রাখতে হবে। বারান্দা থেকে নানা বললেন, যদি ভাই হয়, নাম হবে অনু, শানুর ভাই অনু। আর যদি বোন হয় তাহলে শানুর বোন শাহানা। হঠাৎ বাড়ির ভেতর থেকে কান্নার আওয়াজ ভেসে এলো। ছোট মামা ধানের উঁচু পালা থেকে এক লাফে নিচে পড়েই বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়ল। আমি ছেঁচড়ে নামলাম। পেট-বুক ধানের নাড়ায় ছিঁড়ে ছুড়ে গেল। ভেতরে গেলাম। পাশের বাড়ির এক নানী ঘরের ভেতর থেকে ডাক দিয়ে বললেন, সুন্দর একটা ভাই হয়েছে। দুধের মতো সুন্দর। আমার নানী কোলে করে বাইরে নিয়ে এলেন। সত্যিই অসাধারণ সুন্দর একটা মানুষ। নানী কোলে নিয়ে চামচে করে চিনির পানি খাওয়াচ্ছেন। অনুও বৃহস্পতিবারে জন্মগ্রহণ করল। নানা অনুর দুই কানে আজান ও একামত দিলেন। আমি মাকে দেখতে যেতে চাইলে, দিলেন না কেউ। সবাই বলল, দুপুরে দেখতে। আমি দুপুরে গোসল করে মায়ের কাছে গেলাম। মাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেলাম। অনুকে কোলে নিলাম। এই তো মনে হচ্ছে সে দিনের কথা। অথচ দিন আসে রাত যায়, রাত শেষে দিন শুরু হয় করতে করতে কত বছর হয়ে গেল। অনু এখন বড় হয়েছে ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে। আকার আকৃতিতে বড় হলেও আমার কাছে কেন জানি মনে হয়Ñ সে দিনের সেই কোলের অনু আর এই অনুর কোনো পার্থক্য নেই। অনু যত বড়ই হোক না কেন, আমার কাছে আজীবনই সেই আঁতুরঘরের অনুই থেকে যাবে। আল্লাহর অশেষ রহমতে ভরে উঠুক অনুর জীবন। আল্লাহ অনুকে সুস্থ ও ভালো রাখুনÑ এই প্রত্যাশাই। পৃথিবীর সব ভাইয়েরা মিলে থাকুক এই কামনায়।
শালিখা, মাগুরা


আরো সংবাদ



premium cement