২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ব্যক্তিগত গল্প : জীবনের বাঁকে বাঁকে

-

জীবনের লম্বা একটি পথ অতিক্রম করে আজ শুধুই মনে হয় ‘সার্থক জনম আমার’। পূর্ণতার এই যে নিবিড় দোলাচল, এখানে আমি সার্থকই বটে। জীবনের পর্বে পর্বে যত ছিল আকাক্সক্ষা আর সাধনা, তা কখনো গগনচুম্বী ছিল না। যখন চাঁদ চেয়েছি, পেয়েছি পূর্ণিমার প্রবল কিরণ, জোছনার নিমন্ত্রণ। যখন সূর্য চেয়েছি, পেয়েছি রাঙা আলোক থেকে তপ্তময় উৎকর্ষতা। বৃষ্টি চেয়েছি তো পেয়েছি শ্রাবণধারার ঢল, পদ্মফুলের লাবণ্যতা। ঘুম না আসা মধ্যরাতের নিশুতি বিছানায় গল্প চেয়েছি, পেয়েছি ভাষা, বর্ণ আর বাক্যের পরিপূর্ণতা, হৃদয় ভরা আবেগ আর মৌলিক ভাবনার কালিতে ফুটিয়েছি গল্পের অপরিমেয় ভিত্তি। এসব কিছুর মধ্য দিয়ে কোনো কোনো দিনের একান্ত নিরালায় বসে অকপটে মনে হয়েছে, এক জীবনের কোনো ঘটনাই আমার অপচয় হয়নি। পুরনো যত ছিল অভিজ্ঞতা, সব কিছুই জীবনের কোনো কোনো ঘটনা। হোক সেটি সুখের পাশাপাশি দুঃখেরও। তাতে কি, দুঃখও যে জীবনের জন্য বড় দরকার।
পরাজয়কে আমার মনে হয়েছে নীল সাগরের মুক্তো। ব্যর্থতাকে ভেবেছি নিজেকে আরেকবার শুদ্ধ করার প্রক্রিয়া। গ্লানিকে ভেবেছি নির্মল নিয়তি। দুর্বলতা ছিল আমার নিজেকে চেনার অবিনাশী আয়না। সেই আয়নায় আজো আমি নিজেকে দেখি, জানি, চিনি, বুঝি। এসব কিছুর মধ্য দিয়ে মুগ্ধ হয়েছি বারবার। মুগ্ধতার অবারিত নীল আকাশে সাজিয়েছি চৈতন্য রামধনু। সাত রঙের সপ্তর্শী সরলতলায় রাঙিয়েছি নিজের নিজস্বতাকে। অভিসারের দেয়াল বেয়ে তাই আমার আবেগময় রঙগুলো খসে খসে পড়ছে নিজেকে প্রথম চেনার শুরু থেকে। তাই কখনো কখনো হ্যামেলিনের বাঁশিওয়ালা হয়ে অনুভূতির সুরে বেদনাগুলোকে ডুবিয়েছি অলৌকিক এক পানসি স্রোতে। সেখানে ডুবে তলিয়ে গেছে এক খণ্ড অতীত। নতুন করে আগামীর স্বপ্নজাল বুনতে হয়েছি আরেক বংশীবাদক। সুরে সুরে তালে তালে স্বপ্নকে প্রশ্রয় দিয়েছি বেঁচে থাকার দায় থেকে।
স্বপ্ন দেখার জোড়া চোখ রাঙাই অহর্নিশি। তাই আমার এক খণ্ড আকাশ চাই। দিনের আকাশের রুপালি মেঘগুলোও চাই। রাতের আকাশের সবগুলো তারাও। সাথে বর্ষাবেলার কালো মেঘমল্লারও চাই। চাই বজ্রপাতের ভয়ও।
অবারিত একটি বাগান দরকার আমার। বাগানের সেরা গোলাপটির পাশাপাশি কাঁটাগুলোও দরকার। রক্ত গোলাপের মনোহর সুঘ্রাণ নেবো না শুধু, কাঁটার দংশনে যে একরাশ কষ্ট; সেটিও দরকার আমার। সুনসান দুপুরে নীলকণ্টক পাখির কূজন শুনতে চাই। দুষ্ট ভ্রোমর কী করে তাজা ফুলের মধু খায়, সেটিও দেখতে বাকি আমার।
একটি নদী চাই আমি। পাল তোলা নৌকার মাঝি কী করে কূল দিক ঠিক রাখেন, সেটি শিখতে চাই আমি। খাঁ খাঁ দুপুরে পড়ন্ত সূর্যের আলো নদীর জলে পড়ে ঝিলমিল নাচন করুক, শুধুই সে দৃশ্যই দেখতে চাই না আমি। নদীতে তুফান এলে জল উথলানোর পর নদী কিভাবে শান্ত বালক হয়, সেটিও দেখতে চাই। আমার চাই আয়না। আমি কতখানি সুপুরুষ আর কতখানি কালপুরুষ, অনুভূতির তৃতীয় চোখের যে স্বচ্ছ আলো, সে আলোয় আমি আমার দ্বৈতটা দেখতে চাই সহসা।
আধুনিকতার এই বিশ্বায়নেও আমি মার্জিত। ফেসবুক আমার সারা দিনের দোসর। ঘণ্টার পর ঘণ্টা আমি ফেসবুকে পড়ে থাকতে পারি। ধৈর্যে কুলায় বলে। ইমো, ভাইবার, হোয়াটসআপে কাছের মানুষ আমার আরো বেশি আপন। উন্নত রেস্টুরেন্টের অধুনা খাবারে আমার দীর্ঘ দিনের তৃষ্ণা। কোকাকোলা থেকে শুরু করে আজকের জিরা পানি, এসবেও আমার বিরল পিপাসা। ফ্যাশনেও আমি রোমান্টিক। আমার জিন্সপ্যান্টের কাটা অংশগুলো দেখে প্রবীণেরা ঠোঁট বাঁকিয়ে সমালোচনা করেনÑ ‘এসব তো বখাটেরা পরে।’
আমি বখাটেও। সিগারেটের বেপরোয়া ধোঁয়ায় নির্মল পরিবেশ নষ্ট করি। সদ্য কলেজে ভর্তি হওয়া বেণী দোলানো যে তরুণী চোখের সামনে দিয়ে হিল জুতায় ঠকঠক কাঁপন তুলিয়ে ক্লাসে হেঁটে যায়, তাকে দেখে আমার অভিলাষেরা নিঃশব্দে বলেÑ ‘টুনিরে দেইখা আমার পরান জুড়াইবো।’ না না, আমি পরিমল মাস্টার নই। বয়সের তাণ্ডব ঝড়ে ঝাপ্টে পড়া যুবক বিহঙ্গ আমি।
এই যে আমার এক ধরনের অধঃপতন, তবুও আমি শুদ্ধ মানুষ। যে বুড়োটি হাত পাতে দারিদ্র্যে, ইচ্ছে করে তার হাত টাকায় টাকায় ভরিয়ে দিই। কোনো এক বস্তিপাড়ায় একটি ছয়তলা প্রাসাদ গড়তে ইচ্ছে করে। নিচতলা থেকে ছয়তলার যে অবারিত ছাদ, সেখানেও আয়েসে থাকবে এই শহরের সব হাত পাতা মানুষ।
একটি জেলখানাও গড়তে ইচ্ছে করে। যেথায় সারা জীবন পড়ে রবে ধর্ষকের জাতগুলো। যারা তনুর মতো আমার ফুলবোনদের কলঙ্কিত ইতিহাসের রানী বানিয়েছে। এই সমাজের মুখোশধারী পশুগুলো আমার সেই জেলখানায় পচে মরবে।
আমার এই ভাবনাগুলো যতই হোক আকাশ-কুসুম বা ধোয়া তুলসী পাতা, এসব কিছুর মধ্য দিয়ে রচিত হতে থাকে আমার ব্যক্তিগত গল্প। এই গল্পের নাম ‘জীবন’। এ গল্প আমায় বাঁচায়। মরায়। কাঁদায়। হাসায়। এভাবে পথ চলি। পথ চলতে শিখি। এগিয়ে যাই সামনে। হাঁপিয়ে উঠি। জিরিয়ে নিই সান্দ্র আবেসে। তৃপ্তির বৃক্ষতলে বসে শান্ত হই। ভাবিÑ বহুদূর যেতে হবে। ধূসর ধূলির পথ, ভেঙে পড়ে আছে রথ...। Ñ আমিশাপাড়া, নোয়াখালী


আরো সংবাদ



premium cement