২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

বার্ধক্যে জীবন

-

প্রবীণ মানেই ঘরের এককোণে নির্জনে একাকী পড়ে থাকা বয়োবৃদ্ধ একজন মানুষ। কিংবা চিকিৎসাবঞ্চিত হতভাগ্যদের কেউÑ এ ধ্যানধারণার বাইরে আমাদের ভাবার উপায় আছে কি? বর্তমান সমাজব্যবস্থা ও বাস্তবতার নিরিখে প্রবীণ মানেই সব কিছু জানা ও বোঝার পর পরাজিত একজন মানুষ। আমাদের দেশের মোট জনসংখ্যার বড় একটি অংশ প্রবীণ। সময়ের ব্যবধানে আমাদের দেশের প্রবীণ মানুষগুলো অপেক্ষাকৃত অবহেলিত ও অধিকারবঞ্চিত। যে বয়সে একটু ভালোবাসা, সান্নিধ্য কিংবা ছেলেমেয়েদের পরম যতেœ থাকার কথা, সেই বয়সে নিঃগৃহীত হওয়া ছাড়া কিছুই মিলছে না। না পাওয়ার সীমাহীন কষ্ট জমাট বাঁধছে বুকের এককোণে।
শেষ বয়সে এসে জানা-অজানা নানা অসুখ-বিসুখ বাসা বাঁধে শরীরে। শরীরটাকে ভীষণভাবে পীড়া দেয় তখন। অসহনীয় যন্ত্রণায় জীবন হয়ে ওঠে দুর্বিষহ। তখন প্রয়োজন পরিবারের সবার পূর্ণ সহযোগিতা, সেবা-শুশ্রƒষার। বৃদ্ধ বয়সে এসে সাধারণত চোখে কম দেখা, কানে কম শোনা, ডায়াবেটিস, কিডনিজনিত আরো অন্য জটিল ও কঠিন রোগে আক্রান্ত থাকেন। এ সময় প্রয়োজন সঠিক চিকিৎসা ও পুষ্টিকর খাবার খাওয়া। কিন্তু পারিবারিক টানাপড়েনে মৌলিক অধিকারগুলো ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে। অসুস্থ বয়োবৃদ্ধদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার মতো মূল্যবান সময়ও হয়ে ওঠে না অনেকের। তবে এ কথাও সত্য, আমাদের দেশে এমন অসংখ্য ঘটনা রয়েছে মা-বাবার সেবাযতেœ সন্তান বিন্দুমাত্র ত্রুটি করে না। তাদের কোনো স্বপ্নই অপূর্ণ রাখে না। বিপরীত চিত্রও আজকাল দেখা যায়, বয়সের ভাড়ে ন্যুব্জ তবুও পেটের দায়ে রিকশা চালাতে হচ্ছে। এমন দৃশ্য গ্রামগঞ্জেও চোখে পড়ে। কোনো না কোনো ঘটনার শিকার এসব মানুষ। এসব ঘটনার পেছনের যেসব কারণ রয়েছেÑ তার বেশির ভাগেই দেখা গেছে ছেলেকে বিয়ে করানোর পর মা-বাবাকে পরিবার থেকে বিছিন্ন করে দেয়া হয়েছে। এ বিষয়ে কথা হয় দোহার উপজেলার সুতারপাড়া ইউনিয়নের সোনারবাংলা এলাকার ষাটোর্ধ্ব এক রিকশাচালকের সাথে। প্রসঙ্গক্রমে তিনি জানান, তার সংসারে স্ত্রী, দুই ছেলে, দুই মেয়ে। মেয়েদের বিয়ে দিয়েছেন আর ছেলেরা বিয়ে করার পর আলাদা সংসার শুরু করার পর বাধ্য হয়ে এ বয়সে তিনি রিকশা চালিয়ে নিজের সংসারের জন্য আয় রোজগার করতে হচ্ছে। নানা অসুখে জর্জরিত তিনি। অসুস্থ শরীর নিয়ে রাস্তায় নামা কষ্টকর, তবু জীবন-জীবিকার তাগিয়ে নামতে হচ্ছে। যে বয়সে সুখ-শান্তিতে কাটানোর কথা, সে সময়ে সংসারের ঘানি টানতে হচ্ছে তাকে। একই চিত্র উপজেলার পালামগঞ্জ ফুলতলা এলাকার তমা মণ্ডলের। শুরু থেকেই রিকশার চাকা ঘুরানোর মধ্য দিয়ে আয় রোজগার। রিকশা চালানোর উপার্জিত আয় দিয়েই সন্তান-সন্তনিদের বড় করে তুলেছেন। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম লিখনী, ছেলেরা বিয়ে করার পর অন্যত্র নতুন জীবন শুরু করার ফলে শেষ বয়সে এসে তাকে পরিশ্রমের কাজ করতে হচ্ছে। জীবনের বাকি দিনগুলো কিভাবে কাটবে এ দুশ্চিন্তা তাকে ঘিরে ধরেছে। তমা মণ্ডল জানান, জীবনের দীর্ঘ সময় পরিশ্রমের কাজ করার পর এখন আর জীবন চলে না। মাঝে মধ্যেই অসুস্থ হয়ে পড়ি, কিন্তু ঘরে খাবার না থাকায় বেরিয়ে পড়ি রোজগারের সন্ধানে।
অনেক সময় বিনাচিকিৎসায় নিঃশেষ হয় জীবনযুদ্ধে পরাজিত মানুষগুলোর। বয়োবৃদ্ধ হলে মানুষের শখ-আহাদ বেড়ে যায় স্বাভাবিকভাবেই। আচরণগত পরিবর্তনের ফলে শিশুর মতো হয়ে যায়। প্রতিটি মানুষ নিজেকে সুখী দেখতে চান। স্ত্রী, ছেলেমেয়ে আর আদরের নাতি-নাতনীদের সাথে নিয়ে আনন্দময় জীবনযাপনের স্বপ্ন দেখেন তারা।
কিন্তু এ জায়গায় পারিবারিক স্বার্থ ও দ্বন্দ্বে বর্তমানে প্রবীণেরা একরকম কষ্টের মধ্যে জীবনযাপন করছেন। আবার অনেকে পরিবার থেকে ছিটকে আশ্রয় হয় অভিশপ্ত কোনো বৃদ্ধাশ্রমে কিংবা প্রবীণ নিবাসে। মাঝে মধ্যেই পত্রিকার পাতায় দেখা যায় স্বজনেরা বৃদ্ধ মা-বাবাকে বস্তাবন্দী করে রাস্তার পাশে ফেলে যান। এমন করুণ পরিণতির খবর শুনতে আমাদের অনেকের বিবেককে ভীষণভাবে নাড়া দেয়। সারাটি জীবন যে মানুষটি তার মেধা আর প্রজ্ঞা দিয়ে সংসারের হাল ধরে ছেলেমেয়েদের লালন পালন করে তোলেন, সময়ের ব্যবধানে তিনিই হয়ে যান ঘৃণার পাত্র।
অনেক সময় সন্তান বৃদ্ধমা-বাবাকে সহ্য করতে পারেন না এমনটি বুঝতে পেরে বৃদ্ধ বাবা-মা চোখের আড়ালে চলে যান। আমাদের দেশে গড়ে ওঠা বৃদ্ধাশ্রমে অনেক অভিজাত পরিবারের সদস্যের ঠাঁই হয়েছে। আশ্রিত এমন মানুষেরা কখনোই নিজেদের বংশমর্যাদাকে ক্ষুণœœ না করে সব কিছু লুকিয়ে যায়, তার পরও বেরিয়ে আসে কষ্টগাঁথা স্মৃতিকথা।
ঢাকার দোহার উপজেলার খালপাড় এলাকার আনছার আলীর বয়স প্রায় ৯৫ বছর। বয়সের ভারে অনেকটা ন্যুব্জ হয়ে পড়েছেন। শরীরে বিভিন্ন অসুখ জড়িয়ে ধরেছে। বৃদ্ধ বয়সে এসে তাকে জীবনের বাকি দিনগুলো কিভাবে কাটবে এ নিয়ে সীমাহীন ভাবনার মধ্যে পড়তে হয়েছে। একরকম জীবনের দুঃসময় পার করছেন তিনি। একসময় তাঁতে বোনা লুঙ্গির ব্যবসা করতেন তিনি। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে দোহারের তৈরি বিখ্যাত তাঁতের লুঙ্গি বিক্রি করে স্ত্রী ছেলেমেয়ে নিয়ে সুখের জীবন যাপন করতেন। বৃদ্ধ বয়সে এসে কোনো রকম দিন পার করলেও এ দুঃসময়ে পাশে দাঁড়ানোর মতো কেউ নেই। জীবনের কঠিন সময়ের মুখোমুখি হতে হয়েছে তাকে। দুই বেলা দুই মুঠো ভাতের জন্য অগ্নি পরীক্ষায় পড়েছেন। আনছার আলীর ছয় সন্তানের মধ্যে দুই মেয়ের বিয়ে হয়েছে আরো অনেক আগেই। ছেলেরা বিয়ে করে যার যার মতো আলাদা সংসার শুরু করায় আনছার আলী ও তার স্ত্রী ছমিরননেছা যেন এ বয়সে পরিবারের বোঝা হয়ে আছেন। সংসারের টানাপড়েনে আনছার আলীর ঠাঁই হয়েছে বড় ছেলের কাছে আর ছমিরন নেছার অন্য এক ছেলের কাছে। বর্তমানে শয্যাশায়ী হয়ে আছেন। বিনা চিকিৎসায় দিন কাটছে। খোঁজখবর নেয়ার মতো তেমন কোনো আত্মীয়স্বজনও নেই। আনছার আলী জানান, দৃষ্টিশক্তি কমে গেছে। শরীর দিন দিন দুর্বল হয়ে পড়ছে। চলাফেরা করতে পারি না। বৃদ্ধ বয়সে এসে জীবনের মূল্য দিতে হচ্ছে। বেঁচে থাকার রসদ নেই, তবু বেঁচে আছি।
১৯৯১ সালের ১ অক্টোম্বর থেকে বিশ্বব্যাপী পালন হয়ে আসছে প্রবীণ দিবস। আমাদের দেশেও দিবসটি পালন হয়ে থাকে। প্রবীণ দিবস উপলক্ষে বিশেষজ্ঞরা প্রবীণদের অধিকার, মর্যাদা ও তাদের নিরাপত্তার বিষয়ে কথা বলেন। প্রবীণদের উন্নয়নের জন্য যুগোপযোগী কোনো উদ্যোগে চোখে পড়ে না। প্রবীণদের জন্য দরকার নিরাপদ বাসস্থান ও মৌলিক চাহিদা পূরণ। প্রত্যেক প্রবীণ যেন পরিবারের অন্য সদস্যদের মতোই বসবাস করতে পারেন, এ ধরনের নিশ্চয়তা। প্রবীণ বা বয়স্করা সম্মানিত। তারা দ্বিতীয় শিশু। আমাদের মনে রাখা উচিত, আজ যারা প্রবীণ তারাও অতীতে তার পরিবার, সমাজ, দেশ ও জাতির কল্যাণে অনেকেই অনেক কিছু করে গেছেন। তাদের যেন কোনো রকম অবহেলা করা না হয়। আমরা যারা নবীন তারা যেন ভুলে না যাই, আমাদেরও এক দিন এ অবস্থায় উপনীত হতে হবে। আজ যদি আমরা তাদের প্রতি অবহেলা করি, তা হলে আমাদেরও এরকম অবহেলার শিকার হতে হবে।
পৃথিবীর অনেক দেশেই প্রবীণেরা অবহেলিত, উপেতি, সমাজে ও পরিবারে অনেকের কাছে বোঝাস্বরূপ। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে আমাদের সবার প্রয়োজনীয় পদপে নেয়া অবশ্যই কর্তব্য। বিশ^ প্রবীণ দিবসে সবার প্রত্যাশা বাবা-মা কিংবা প্রবীণেরা পরিবারের বোঝা নয়, বরং তারা আমাদের নীতি ও আদর্শের জায়গা।
সারা বিশে^র প্রবীণেরা করুণা নয়, মর্যাদার আসনে আসীন হয়ে পরিবারের সাথে একই প্লাটফর্মে থেকে জীবন অতিবাহিত করুন, এটাই হোক বিশ^ প্রবীণ দিবসের অঙ্গীকার।


আরো সংবাদ



premium cement