মানুষ বিক্রির হাটে : চারাগল্প
- মোনোয়ার হোসেন
- ০৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ০০:০০
সাতসকালেই মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল।
হবে না?
শরতের সকাল। চারপাশে ছোপ ছোপ কুয়াশা পড়ছে, ঝিরিঝিরি ঠাণ্ডা বাতাস বইছে। সেই বাতাস মামার তিনতলা ফ্ল্যাটের জানালা দিয়ে হু হু করে রুমে ঢুকছে। আমার শরীরে, মুখে ঝাপটা মারছে। গায়ে একটু একটু শীত লাগছে। এ রকম শীতে গায়ে কম্বল জড়িয়ে খুব ভালো ঘুম হয়। আমি ঠিক করলাম গায়ে কম্বলটা টেনে নিয়ে একখান জব্বর ঘুম দেবো। কিন্তু বিধিবাম। কম্বলটা গায়ে জড়িয়ে নিতে না নিতেই বড় মামার ডাক পড়ল।
এই সোহাম, এই সোহাম, ওঠ। ওঠ।
মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল। কোনোরকম মেজাজটাকে চেক দিয়ে বললাম, জি মামা।
মামা বললেন, একটু তাড়াতাড়ি ওঠ। দরকার আছে।
কম্বলের নিচে শরীরটা লেপ্টে রেখেই বললাম, এই সাতসকালে কী দরকার, মামা?
তোমাকে একটু বাজারে যেতে হবে।
এই সাতসকালে বাজার! আমি অবাক। বাজারে এখন মানুষ আসা তো দূরের কথা, পক্ষীকুলও ভিড়ছে বলে মনে হয় না।
মামা বললেন, আরে গর্দভ! তোমাকে মাছ বা সবজির বাজারে যেতে বলছি না।
তবে?
মানুষ বিক্রির হাটে যেতে বলছি। দেরি করে গেলে মানুষ পাওয়া যাবে না। কাজটা আবার পিছিয়ে যাবে।
অবাক বিস্ময়ে আমার চোখ কপালে উঠল। মানুষ বিক্রির হাট! মুখ হাঁ করে বললাম, বলো কী মামা, আজকাল বাজারে মানুষও বিক্রি হয় নাকি?
মামা বললেন, হুম, হয়। আমাদের ষষ্টিতলায় প্রতিদিন ভোরে মানুষ বিক্রির হাট বসে। গ্রাম থেকে খেটে খাওয় মানুষেরা দলবেঁধে এখানে আসে। বসে থাকে। যাদের কাজের লোকের প্রয়োজন হয়, তারা সেখানে যায়। প্রয়োজন মতো লোক ডেকে নিয়ে আসে। বিকেলে কাজ শেষে মজুরি দিয়ে বিদায় করে দেয়।
আমি গরু-ছাগলের হাট দেখেছি, হাঁস-মুরগির বাজার দেখেছি, কিন্তু মানুষ বিক্রির হাট! দেখিনি কোনো দিন। তাই দেখার খুব কৌতূহল হলো। বললাম, হ্যাঁ মামা, আসছি।
তাড়াতাড়ি এসো। বেশি দেরি করলে মানুষ পাবে না।
খাট থেকে নেমে ড্রেসিং আয়নার সামনে দাঁড়ালাম। এলোমেলো চুলগুলো আচড়ে নেবো বলে।
আয়নার নিজেকে দেখে চমকে উঠলাম। এ কী হাল হয়েছে আমার? চোখ দুটো জবা ফুলের মতো টকটকে লাল হয়ে আছে।
পরক্ষণেই মনে হলো আজ রাতে একদম ঘুম হয়নি। প্রিয়তির সাথে চ্যাটিং করতে করতে কখন যে ভোর হয়ে গেছে টেরই পাইনি। সবে ঘুমে চোখ বুজেছি। তখনই গায়ে ঠাণ্ডা লাগল। কম্বল টেনে নিয়ে গায়ে জড়াতে না জড়াতেই মামার ডাক। ঘুমটাই মাটি হয়ে গেল। চোখ টসটসে লাল। জবা ফুলের মতো ফুলে আছে। খচখচ করছে।
বাথরুমে গিয়ে চোখে-মুখে পানি ছিটিয়ে নিলাম।
মামা বললেন, তোমার মামীর গ্যাস চুলার রান্না, ম্যাজিক চুলার রান্না আর রাইস কুকারের রান্নায় এলার্জি আছে। খেতে পারে না। তার জন্য একটা রান্নাঘর তৈরি করতে হবে। চুলোয় রান্না করতে হবে। তুমি বাজার গিয়ে দু’জন কাজের লোক ডেকে নিয়ে এসো। বাজার থেকে কিভাবে মানুষ কিনে নিয়ে আসতে হবে মামা সব বুঝিয়ে বললেন।
মানুষ বিক্রি হাটে গিয়ে আমার চোখ চড়কগাছ। শরৎ-ঋতু। ভাদ্র-আশ্বিন মাস। এই দুই মাসে গ্রামে মঙ্গা চলে। কোনো কাজকাম পাওয়া যায় না। একটি কাজের জন্য, একমুঠো ভাতের জন্য গ্রাম থেকে ক্ষুধার্ত মানুষেরা ছুটে এসেছেন শহরে। রাস্তার দুই পাশে সারি সারিভাবে দুই শ’র মতো লোক দাঁড়িয়ে আছেন। সবার গায়ে তেল চিটচিটে ময়লা জামা। এবড়োখেবড়ো চুল। মলিন মুখ। সবারই একটা কাজ চাই।
দু-চারজন শার্ট-প্যান্ট পরা ভদ্রলোক আলাপ আলোচনা করে দু-একজন করে লোক নিয়ে যাচ্ছেন।
আমি কাছাকাছি যেতেই দেখি সবাই উৎসুক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
আমি বিব্রত। সবাই কী আমার ফোলা ফোলা টসটসে লাল জবা চোখ দেখছে? নেশাখোর ভাবছে না তো?
আমার অহেতুক ভাবনা দূর করল দুইজন মাঝবয়সী লোক এসে। আচমকা একজন এসে আমার হাত ধরলেন। সাহেব, আপনার কাজের লোক লাগবে?
জি।
কী কাজ করতে হবে?
কাচা রান্নাঘর তৈরি করতে হবে। মানে বাঁশের রান্নাঘর।
আমরা বাঁশ দিয়ে ভালো রান্নঘর তৈরি করতে পারি সাহেব। আপনার কয়জন লোক লাগবে?
দুইজন হলেই চলবে।
তাহলে আমাদের দুইজনকে নিয়ে চলুন সাহেব। বলে আবেগতাড়িত হয়ে পড়লেন লোকটা। বললেন, আমরা গরিব মানুষ। আজ চার দিন আমরা আসছি আর ঘুরে ঘুরে যাচ্ছি। কোনো কাজকাম পাই না। দুর্বল বলে কেউ আমাদের কাজে নেয় না। বাসায় আমার স্ত্রী অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে আছে। টাকার অভাবে তার জন্য ওষুধ কিনতে পারছি না। আপনি কাজ দিলে রাতে অন্তত অসুস্থ স্ত্রীর জন্য ওষুধ কিনে নিয়ে যেতে পারব। আপনি কাজের একদম ভয় করবেন না। ছেলেদের চেয়েও আমরা ভালো কাজ করতে পারব।
আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ়! কী বলব? কোনো ভাষা খুঁজে পাই না। শুধু আস্তে করে বললাম, চলুন।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা