২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

শিক্ষার্থী নিপীড়নের শেষ কোথায়!

-

ক্ষমতাসীনরা মনে করে যারা সমালোচনা করে তারা দেশ ও জাতির শত্রু। অথচ বিশ্বের প্রতিটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বিরোধী দল ছায়া সরকারের ভূমিকা পালন করে। কোটা সংস্কার শিক্ষার্থীদের যেভাবে নিপীড়ন করা হয়েছে ঠিক একই কায়দায় কোমলমতি শিশুদের নিপীড়নের কষাঘাতে জর্জরিত করা হয়েছে। কোমলমতি শিশুরা সরকার উচ্ছেদের আন্দোলনের দাবিতে রাজপথে নামেনি। তারা নাগরিক জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেই ট্রাফিকের দায়িত্ব পালন করেছিল। সরকার উন্নয়নের জোয়ারে মহাকাশে স্যাটেলাইট পাঠাতে পারে; কিন্তু দেশের মাটিতে নিরাপদ সড়কের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পারেনি। প্রতিনিয়ত যন্ত্রদানবের বর্বরতায় মানুষের জীবন বিপন্ন হলেও সংশ্লিষ্ট মহলের টনক নড়েনি।
নিকট অতীতে কোটা সংস্কার শিক্ষার্থীদের দমনের নামে যখন নিপীড়ন করা হচ্ছিল তখন অনেকে কানে তুলো দিয়ে রেখেছিল। কিন্তু এবার যখন নিজের সন্তান রাজপথে নেমে নিপীড়নের প্রতিবাদ করছে তখন অনেকেরই টনক নড়ছে। সবারই মনে রাখা প্রয়োজন অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে দু’জনই সমান অপরাধী। সরকারের সোনার ছেলেরা যেভাবে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ওপর নগ্ন হামলা করেছে তা মোটেও সুখকর নয়! এসব নির্যাতন আমাদের স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের ছাত্রসংঠন এনএসএফের জুলুম নির্যাতন-অত্যাচার-নিপীড়নের কথাই মনে করিয়ে দেয়। আইয়ুব খান উন্নয়নের আফিমে জাতিকে বুঁদ রেখে ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারেনি। তৎকালীন ন্যাশানাল স্টুডেন্টস ফেডারেশন (এনএসএফ) ও পুলিশ বাহিনীকে ব্যবহার করে সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে দাবিয়ে রেখে এক ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী কোনো স্বৈরশাসক ও ফ্যাসিবাদী শাসক নিষ্ঠুর নির্যাতন চালিয়ে ক্ষমতার মসনদে বেশি দিন টিকে থাকতে পারেনি।
জুলুম-নিপীড়ন-নির্যাতনের বিরুদ্ধে মানবতার অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য গণতন্ত্রের সৃষ্টি হয়েছিল। গণতন্ত্র মানে শুধু একদলীয় শাসনব্যবস্থাকে জায়েজ করার জন্য সাজানো মাঠে পাতানো নির্বাচন নয়। গণতন্ত্র আজ শৃঙ্খলিত নিষ্পেষিত। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলে ছাত্রলীগ যখন শিক্ষার্থীকে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে জখম করে তখন সত্যি মনে দাগ কাটে। পুলিশের সামনে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরা যেভাবে বেপরোয়া সন্ত্রাসী কার্যক্রমে লিপ্ত হয়েছে তার ছিটেফোঁটাও যদি অন্য কোনো ছাত্র সংগঠনের দ্বারা হতো তাহলে চিরুনি অভিযানের নামে কত মায়ের বুক যে খালি হতো তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। অথচ আদালতের রায়ে দণ্ডপ্রাপ্ত অপরাধীরা সাধারণ ক্ষমা পেয়ে প্রকাশ্যে দাপিয়ে বেড়ায় আর নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলকারী ২২ শিক্ষার্থী দিনের পর দিন রিমান্ডের অমানুষিক নির্যাতন ভোগ করে। সভা-সমাবেশ করার অধিকার তো সংবিধান স্বীকৃত। তাহলে কেন মানুষের অধিকার আজ ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে, এ বিষয়টি ভেবে দেখা দরকার।
নিরাপদ সড়ক আন্দোলন থেকে শিক্ষার্থীরা ঘরে ফিরে গেলেও স্বস্তির দেখা মেলেনি। দেশের সন্তানতুল্য শিশুদের জীবনের নিরাপত্তা যদি রাষ্ট্র দিতে পারত তাহলে সড়কে মৃত্যুর মিছিল বহু আগেই থেমে যেত। সরকারের আজ্ঞাবহরা যেভাবে তাদের ওপর নিষ্ঠুরতা চালিয়েছে তা কেবল স্বৈরতান্ত্রিক দেশে মানায়। গত ৯ দিনে ৩৬টি মামলা হয়েছে। হাজার হাজার অজ্ঞাতনামা আসামি উল্লেখ করে দায়ের করা মামলায় অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থীকে গ্রেফতার করা হলেও শিক্ষার্থী ও সাংবাদিকদের ওপর হামলার সাথে জড়িত কাউকে গ্রেফতার করা হয়নি। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২২ জন শিক্ষার্থীকে রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। অথচ হেলমেট ও লুঙ্গিপরা হামলাকারীদের ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়ার পরও তাদের ধরা হচ্ছে না, কিন্তু কেন? এ বিষয়টি জাতির সামনে উন্মোচন করা প্রয়োজন।
বাংলাদেশে নিপীড়নমূলক রাজনীতি এ সরকারের আমলেই শুরু হয়েছে তা কিন্তু নয়, অতীতে যারা ক্ষমতায় ছিল তারাও কম-বেশি নিপীড়ন চালিয়েছে। তবে নিপীড়ন শুধু ক্ষমতাসীন সরকারই করে বিষয়টি এমন নয়। কখনো কখনো প্রতিষ্ঠানের এমডি কিংবা বসরাও সাধারণ কর্মকর্তার ওপর নিপীড়নের স্টিমরোলার চালায়। এক কথায় সরকার যখন নিপীড়নের পথে হাঁটে তখন সর্বত্র নিপীড়নের শিকার হয় মানুষ। রাষ্ট্রে যখন ফ্যাসিবাদের উত্থান কায়েম হয় তখন সেখানে কেউ নিরাপত্তার নিশ্চয়তা পায় না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে জার্মান রাষ্ট্রনায়ক হিটলার তার দেশে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করে রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করে ফ্যাসিবাদের জন্ম দিয়েছিল। জার্মানিতে ফ্যাসিবাদের উত্থানের কারণেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সঙ্ঘটিত হয়েছিল। এ যুদ্ধে পাঁচ কোটি মানুষ প্রাণ দিয়েছিল।
আমরা মনে করি, গণতন্ত্র, মানবাধিকার, শান্তি ও নাগরিকদের স্বস্তির স্বার্থেই সরকার শিক্ষার্থীদের ওপর থেকে নিপীড়ন বন্ধ করবে; এমনটিই দেশের মানুষের প্রত্যাশা।

 


আরো সংবাদ



premium cement