দেশে নারী নির্যাতন প্রতিরোধে নানা আইন ও নীতিমালা রয়েছে। নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে দেশে আইনের কোনো ঘাটতি নেই। তারপরও নির্যাতন বাড়ছেই। কিন্তু সেসব আইন ও নীতিমালা যে খুব একটা কাজে আসছে না, তা তো বোঝাই যাচ্ছে। তবে এটা পরিষ্কার যে, শুধু আইন করে নারীর ওপর নির্যাতন বন্ধ করা যাবে না। কেননা, মূল সমস্যা হচ্ছেÑ নারীর প্রতি সমাজের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি।
বেসরকারি সংস্থা ইনস্টিটিউট অব ইনফরমেটিক্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইআইডি) নির্বাহী প্রধান সাঈদ আহমেদ বলেন, আইআইডি গত পাঁচ বছর ধরে নারী নির্যাতন প্রতিরোধে কাজ করে চলেছে। তিনি জানান, নারী নির্যাতনের বিষয়ে মাঠ পর্যায় থেকে বিভিন্ন শ্রেণিপেশার প্রতিনিধিদের বক্তব্য শোনা হচ্ছে। এরপর বিষয়গুলো নিয়ে সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের সাথে কাজ করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু বলেন, বৈষম্যমূলক পারিবারিক আইন, মাদকের বিস্তার, মূল্যবোধের অবক্ষয়সহ বিভিন্ন কারণে নারী নির্যাতন বাড়ছে। এই কারণগুলোকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করতে হবে। তিনি নারী নির্যাতন প্রতিরোধে এলাকাভিত্তিক সামাজিক অনাচার প্রতিরোধ কমিটি গড়ে তোলা, বিভিন্ন স্তরে জবাবদিহিতা বাড়ানো এবং নির্যাতনের ঘটনা গোপন না করে তা প্রকাশ করার সুপারিশ করেন। মালেকা বানু হতাশা ব্যক্ত করে বলেন, গত চার দশকের বেশি সময় ধরে নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে আন্দোলন চালানো হচ্ছে। কিন্তু বর্তমানে আন্দোলনের জায়গা সঙ্কুচিত হয়ে যাচ্ছে। রাজনৈতিক ও প্রশাসনিকভাবে সালিসির সাথে যুক্ত বিভিন্ন সংগঠনও চাপের মুখে পড়ছে। রাজনীতিতে ধর্মের অপব্যবহার, সমাজে নারী উন্নয়নবিরোধী শক্তির প্রশ্রয় পাওয়াসহ বিভিন্ন কারণে নারীর ঝুঁকি বাড়ছে।
বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টÑব্লাস্টের অবৈতনিক নির্বাহী পরিচালক আইনজীবী সারা হোসেন নারী নির্যাতন প্রতিরোধে কঠোর আইন বা কঠোর শাস্তির বিধানের চেয়ে কৌশল ও কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার ওপর বিশেষ জোর দেন। তিনি বলেন, একদিকে আইনের প্রয়োগ হচ্ছে না, অন্যদিকে কোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে জোরালোভাবে দাঁড়ানোও সম্ভব হচ্ছে না। তিনি ক্ষুদ্র জাতিসত্তার চার নারীর (ধর্ষণের শিকার দু’জন এবং দু’জনকে অপহরণ করা হয়েছে) কথা উল্লেখ করে বলেন, এই নারীদের পাশে কয়জন দাঁড়াতে পেরেছেন?
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের সরকারি (পিপি) অ্যাডভোকেট আলী আসগর স্বপন আক্ষেপ করে বলেন, ২০০০ সালে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন প্রণয়ন করা হয়। এ আইনের বিধিমালা এখন পর্যন্ত তৈরি হয়নি। ফলে আইনসংশ্লিষ্টরা একেকজন একেকভাবে আইনটিকে ব্যবহার করছেন। আইন সংশ্লিষ্টরা কোনো গাফিলতি করলে শাস্তির বিধান আছে, হাইকোর্টের রায় আছে, কিন্তু কেউ শাস্তি পেয়েছে, আজ পর্যন্ত এ ধরনের কোনো নজির নেই। তাই জবাবদিহি বাড়াতে হবে।
মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ন্যাশনাল ট্রমা কাউন্সেলিং সেন্টারের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট ইশরাত শারমীন রহমান বলেন, নারীর মানসিক নির্যাতনের বিষয়টি এখন পর্যন্ত উপেক্ষিত। পরিবারের সহায়তার অভাবে নির্যাতনের শিকার নারীরা প্রতিকার পাচ্ছে না। অনেক সময় সন্তান, সংসারের কথা চিন্তা করে নারীরাও আইনি সহায়তা নিতে চাচ্ছেন না।
বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির প্রকল্প সমন্বয়কারী মিতালী জাহান বলেন, নারী নির্যাতন প্রতিরোধে বিশ্বের যেকোনো দেশের তুলনায় আমাদের অনেক ভালো আইন আছে। এখন আইনগুলোর প্রয়োগের ওপর বেশি জোর দেয়াটা জরুরি।
নারী নির্যাতন প্রতিরোধে সরকারের স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা আছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ কতটা হচ্ছে, আইনগুলো কিভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে, তা নিয়মিতভাবে তদারক করা প্রয়োজন। নারী নির্যাতন মামলার সাথে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করছে কি না, তা তদারক করা ও জবাবদিহিতার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিষয়টিকে একপক্ষীয়ভাবে দেখলে চলবে না। এই প্রতিবেদকের সাথে আলাপচারিতায় মিতালী জাহান মিতালী বলেন, কাজের সূত্রে দেখেছি, থানাগুলোতে প্রয়োজনীয় উপকরণের যথেষ্ট অভাব রয়েছে। অনেক সময় জিডি, এফআইআর করার জন্য কাগজ-কলম পর্যন্ত পাওয়া না। এ ক্ষেত্রে প্রতিটি আইন প্রণয়নের সাথে এগুলোর বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় জনবল ও বাজেট বরাদ্দ করা প্রয়োজন। তা না হলে সঠিকভাবে আইন কার্যকর করা সম্ভব হবে না। ব্র্যাক ইন্টারন্যাশনালের শিশুর প্রারম্ভিক বিকাশ এবং মেয়েদের শিক্ষা বিভাগের প্রধান রাফিয়াত রশিদ মিথিলা বলেন, পরিবার থেকেই শিশুকে শেখাতে হবে নারীকে নির্যাতন করা যায় না। শিক্ষা কারিকুলামে ‘সেক্স এডুকেশন’ কে গুরুত্ব না দিলে শিশুরা বিকৃত উপায়ে তা শেখার চেষ্টা করবে। গণমাধ্যমে নারীবিদ্বেষী বক্তব্য যাতে প্রচার না পায়, তাও নজরদারির আওতায় আনতে হবে।
নারী নির্যাতন প্রতিরোধকল্পে মাল্টিসেক্টরাল প্রোগ্রাম মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় বাংলাদেশ সরকারের কার্যক্রমÑ নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে ন্যাশনাল হেল্পলাইন সেন্টার : হেল্পলাইন নম্বর-(১০৯২১)
বাংলাদেশ সরকার ও ডেনমার্ক সরকারের যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীন নারী নির্যাতন প্রতিরোধকল্পে মাল্টিসেক্টরাল প্রোগ্রামের আওতায় নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে ন্যাশনাল হেল্পলাইন সেন্টার প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। মহিলাবিষয়ক অধিদফতর, ৩৭/৩ ইস্কাটন গার্ডেন রোড, ঢাকা-১০০০ এর অষ্টম তলায় এই সেন্টারটি অবস্থিত। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) এই প্রকল্পের অনুকূলে ১০৯২১ নম্বরটি হেল্পলাইন হিসেবে প্রদান করে। সব মোবাইল এবং অন্যান্য টেলিফোন থেকে এই নম্বরে ফোন করা যায়। এই সেন্টারটি অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি এবং হালনাগাদ অপারেটিং সিস্টেম দ্বারা সমৃদ্ধ। এই সেন্টারে ২৪ ঘণ্টা কল করা যাবে। আশা করা যায়, এই সেন্টারের মাধ্যমে নির্যাতনের শিকার মহিলা ও শিশু তাদের পরিবার এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য প্রয়োজনীয় তথ্য-পরামর্শসহ দেশে বিরাজমান সেবা এবং সহায়তা সম্পর্কে জানতে পারবে।
সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বেসরকারি সংস্থাগুলোর সাথে সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমে নারী ও শিশু নির্যাতনে সহিংসতা হ্রাস করা এবং সেবা কার্যক্রম জোরদারকরণ করা এ প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য। সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য হচ্ছেÑ ১. নারী নির্যাতন প্রতিরোধকল্পে সমন্বিত গুণগতমানসম্পন্ন, দক্ষ ও টেকসই সেবা প্রদান; ২. নারী নির্যাতন প্রতিরোধে জনসচেতনতা সৃষ্টি এবং সরকারি সেবা প্রতিষ্ঠানে কার্যক্রম বৃদ্ধির জন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে সচেতন করা ; ৩. সমন্বিত বা আন্তঃমন্ত্রণালয় উদ্যোগের মাধ্যমে নারী নির্যাতন সম্পর্কিত কার্যক্রম গ্রহণে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতা বৃদ্ধিকরণ এবং ৪. নারী নির্যাতন প্রতিরোধে আইন ও প্রক্রিয়াগত সংস্কার অর্জন এবং নারী নির্যাতন প্রতিরোধে জাতীয় কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করা। ব্যবস্থাপনা ও কার্যক্রমÑ দশটি মন্ত্রণালয়ের অংশগ্রহণে বহুমুখী ব্যবস্থাপনা কাঠামোতে সম্পূর্ণ অনন্য আঙ্গিকে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হচ্ছে। প্রত্যেকটি মন্ত্রণালয়ের কর্মকাণ্ডে নিজস্ব দায়িত্ব ও ভূমিকা রয়েছে। পরিণতি হিসেবে প্রতিটি মন্ত্রণালয় প্রকল্প কম্পোনেন্টের অংশীদার পাইলট পর্বে ওয়ান-স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার এবং প্রথম পর্বে ডিএনএ ল্যাবরেটরি প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে স্থাপিত হয়েছে। প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্বে মহিলাবিষয়ক অধিদফতরে নির্যাতনের শিকার নারী ও শিশুদের জন্য কাউন্সেলিং সহায়তাকে অধিকতর জোরদার এবং ফলপ্রসূ করার লক্ষ্যে মহিলাবিষয়ক অধিদফতরে ন্যাশনাল ট্রমা কাউন্সেলিং সেন্টার স্থাপন করা হয়েছে। রংপুর এবং ফরিদপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে দেশের সপ্তম ও অষ্টম ওসিসি স্থাপনের কাজ শেষ হয়েছে। প্রকল্পের তৃতীয়পর্বে চলমান কার্যক্রমগুলো অধিকতর উন্নত ও গতিশীল করাসহ দেশের নির্যাতনের শিকার নারীদের সেবা প্রাপ্তির সুবিধার্থে পর্যায়ক্রমে জেলা পর্যায়ে ৪০টি এবং উপজেলা পর্যায়ে ২০টি ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেল প্রতিষ্ঠা করা হবে। এই পর্বে নারী নির্যাতন প্রতিরোধে একটি জাতীয় কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করা হবে এবং এ লক্ষ্যে উপজেলা, জেলা এবং বিভাগীয় পর্যায়ে মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হবে। এ ছাড়া নারী নির্যাতন প্রতিরোধে ব্যাপক গণসচেতনতা সৃষ্টির অভিযান গড়ে তোলা হবে।