২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

পশ্চিমবঙ্গে প্রথমবারের মতো প্রধান বিরোধী দল বিজেপি, কোন চেহারায় দেখা দেবে?

পশ্চিমবঙ্গে প্রথমবারের মতো প্রধান বিরোধী দল বিজেপি, কোন চেহারায় দেখা দেবে? - ছবি- সংগৃহীত

ভারতের শাসক দল ভারতীয় জনতা পার্টি- বিজেপি পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূলের সাথে লড়াইয়ে হেরে গেছে। মমতা ব্যানার্জির কাছ থেকে ক্ষমতা দখলে ব্যর্থ হলেও গেরুয়া দলটি এই প্রথমবার পশ্চিমবঙ্গে প্রধান বিরোধী দল হিসেবে উঠে এসেছে। বিদায়ী বিধানসভায় তাদের মাত্র তিনজন নির্বাচিত বিধায়ক ছিল। এবার বিজেপি পশ্চিমবঙ্গে ৭৭ জন বিধায়ক পেয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা, পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় কংগ্রেস ও বামপন্থীরা সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হওয়ার ফলে ওই রাজ্যের সংসদীয় রাজনীতিতে ‘অপোজিশন স্পেস’-টাও এখন পুরোপুরি বিজেপির দখলে।

প্রশ্ন হচ্ছে, এই পরিস্থিতিতে পশ্চিমবঙ্গে কী ধরনের রাজনৈতিক লক্ষ্য ও কর্মসূচি নিয়ে বিজেপি এগোতে পারে? যেখানে এনআরসির তাস কি তারা আপাতত পেছনেই রাখবে? বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বই বা পশ্চিমবঙ্গ নিয়ে আর কতটা আগ্রহ দেখাবেন? কলকাতায় রাজ্যের ভোটের ফল প্রকাশের ঠিক পর পরই সরেজমিনে এই প্রশ্নগুলোরই উত্তর খুঁজতে চেয়েছিলাম।

একটা লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো সিপিএমসহ যে বাম দলগুলো ও কংগ্রেসকে হঠিয়ে বিজেপি পশ্চিমবঙ্গে প্রধান বিরোধী দলের স্বীকৃতি পেল, নির্বাচনে জিততে না-পারার জন্য বিজেপি কিন্তু প্রাথমিকভাবে তাদেরই দুষছে।

দলীয় নেতৃত্বর অনুমান, বামপন্থী ও কংগ্রেসিদের ভোট ঢালাওভাবে তৃণমূলের দিকে যাওয়ার জন্যই তাদের প্রত্যাশা পূরণ হয়নি।

'কিছু ভুলচুক তো আমাদের হয়েছে'
কিন্তু এখন এই পরিস্থিতিতে বিরোধী দল হিসেবে বিজেপিকেও পশ্চিমবঙ্গে দলীয় কৌশল নিয়ে হয়তো নতুন করে ভাবতে হবে। বিবিসিকে বলছিলেন সদ্য বিজেপির হয়ে জেতা বিধায়ক ও দলের মহিলা শাখার প্রধান অগ্নিমিত্রা পাল। তার কথায়, ‘সিপিএম ও কংগ্রেস এই ভোটে যে ভূমিকা পালন করল, তা একেবারে কেলেঙ্কারি। তাদের ভোটটা পুরোটাই তৃণমূলের দিকে গেল। আমরা যে সরকার গড়ব বলে ভেবেছিলাম, তাও বিপর্যয়ের মুখে পড়ল। যদিও সেটা অন্য প্রসঙ্গ। কিন্তু আমাদের যে নতুন করে ভাবতে হবে তাতে কোনো ভুল নেই। কিছু জায়গায় নিশ্চয়ই আমাদের ভুল হচ্ছে।’

অগ্নিমিত্রার ভাষায়, ‘তবে বিরোধী দল হিসেবে আমরা কিন্তু খুবই জোরালো একটা শক্তি হিসেবে আসতে পারছি। এটা ভেবে আমি খুবই খুশি।’

‘আগে যেখানে আমাদের দলের মাত্র তিনজন বিধায়ক ছিলেন, একই জায়গায় প্রায় ৮০ জন সদস্য নিয়ে বিধানসভায় যাচ্ছি। একটা খুব জোরদার প্রতিযোগিতা নিশ্চয় থাকবে। আর গঠনমূলক সমালোচনা থাকলে তবেই উন্নয়নের সুযোগ আসে। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ যাতে উপকৃত হয়, তাই আসল কথা। ‘

বিজেপির এই নেত্রী আরো বলেন, পশ্চিমবঙ্গে ৩৪ বছরের বাম শাসন আর তারপর ১০ বছর ধরে তৃণমূল। এই ৪৪ বছরে বাংলার মানুষ কিছুই পায়নি। ভেবেছিলাম সেটা এবার পাল্টাবে। কিন্তু তা হলো না। ঘুরেফিরে সেই না-পাওয়ার জায়গাতেই যেন আমরা আবার না আসি। বিজেপি এটুকুই চাইবে।’

কিন্তু পশ্চিমবঙ্গেও আসামের ধাঁচে জাতীয় নাগরিকপঞ্জী বা এনআরসি করা, বা কথিত অবৈধ অনুপ্রবেশ রোখার যে সব কথা বিজেপি বারেবারেই বলতো সেগুলো নিয়ে এখন তারা কিভাবে এগোবে?

অগ্নিমিত্রার জবাব, ‘সেটা বলার হয়তো এখনো সময় হয়নি। এনআরসি নিয়ে কথা বলা… আমি এই মুহূর্তে জানি না, ঠিক কী হবে। দলের কাছ থেকেও আমরা এখনো কোনো নির্দেশ পাইনি। কিন্তু অবৈধ অনুপ্রবেশ বা বেকারত্ব– এগুলো নিয়ে তো অবশ্যই কথা হবে।’ একইসাথে বিজেপি নেত্রী বলেন, ‘নারী সুরক্ষা নিশ্চিত করাও মহিলা মোর্চার সভানেত্রী হিসেবে আমার কাছে অন্তত এক নম্বর অগ্রাধিকার। পাশাপাশি স্বাস্থ্য পরিষেবা উন্নত করা। এগুলো তো অবশ্যই থাকবে।’

বস্তুত বিধানসভায় প্রধান বিরোধী দল হওয়ার সুবাদে বিজেপি এখন চাইলেই এর যেকোনো ইস্যুতে মোশন বা প্রস্তাব আনতে পারবে। সভায় বিতর্ক দাবি করতে পারবে।

'যেকোনো বিষয়কে সাম্প্রদায়িক রং দেয়ার অদ্ভুত ক্ষমতা'
তবে এই নির্বাচনে বিজেপির বিরুদ্ধে লাগাতার প্রচার চালানো অ্যাক্টিভিস্ট ও ফিল্মমেকার কস্তুরী বসুর অভিজ্ঞতা বলছে, বিজেপি তাদের রাজনৈতিক ল্যাবরেটরির সবচেয়ে সফল পরীক্ষাটা কিন্তু সমাজের বুকেই চালাতে অভ্যস্ত। তিনি বলেন, ‘যে জিনিসটা বিজেপি এ রাজ্যে সবচেয়ে বেশি আর একটানা করে গেছে, তা হলো সব জিনিসকে কমিউনালাইজ করা বা সাম্প্রদায়িক রং দেয়া। ধরুন কোথাও একটা ধর্ষণ হয়েছে, যেটা একটা জেন্ডার ভায়োলেন্স বা জেন্ডার ক্রাইম। এখানে গিয়ে তারা খুঁজে বের করবে… আর যদি ঘটনাচক্রে ভিক্টিম হয় একজন হিন্দু আর অভিযুক্ত একজন মুসলিম, তাহলে তো ব্যাস হয়েই গেল। তারা ইস্যুটাকে সাম্প্রদায়িক করে ছাড়বে। ধর্ষণকারীর পরিচয় অন্যরকম (হিন্দু) হলে তা নিয়ে কিন্তু ওরকম কিছু করবে না।

কস্তুরী বসু বলেন, ‘অথবা ধরুন, স্থানীয়ভাবে কোথাও একটা কিছু দুর্নীতি হয়েছে। সাথে সাথে বিজেপি নেতা দেখবে ওখানে অভিযুক্তদের মধ্যে কোনো মুসলিম আছেন কি না। বিজেপির মূল ফোকাসটা ওই দিকে।’

তার মতে, ‘ফলে প্রতিটি দৈনন্দিন জিনিসকে এভাবে সাম্প্রদায়িক রঙে চোবানোর চেষ্টা– প্রধান বিরোধী দল হিসেবে এই জিনিসটাই তারা এখন ১০-১২ গুণ বেশি করবে পশ্চিমবঙ্গে।’

অ্যাক্টিভিস্ট ও ফিল্মমেকার কস্তুরী বসু বলেন, ‘পশ্চিমবঙ্গে এখন আর একটা হবে। তা হলো ওদের (বিজেপি) অভিভাবক আরএসএস এখন অনেক বেশি শক্তিতে ও অনেক বেশি অর্থবলে বলীয়ান হয়ে রাজ্যের নানা প্রান্তে সক্রিয় হবে।’

‘এই আরএসএসের কাজকর্ম অনেক সময় আমাদের নজর এড়িয়ে যায়। কিন্তু মনে রাখতে হবে, বিজেপি কিন্তু শুধু হিমশৈলের চূড়া, আরএসএস-ই আসল। আজ যে পশ্চিমবঙ্গে দলটা এরকম ফল করেছে, তার পেছনে পশ্চিমবঙ্গের বহু অঞ্চলে ও পকেটে আরএসএসের নীরব কাজকর্মের বিরাট অবদান আছে। এখন ধরেই নেয়া যায়, আরএসএসের ওই কর্মকাণ্ড এখন পশ্চিমবঙ্গে দ্বিগুণ গতিতে বিস্তৃত হবে’, বলছিলেন কস্তুরী বসু।

কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে যেভাবে নাগরিকত্ব আইন ও এনআরসির বিরুদ্ধে অতীতে তীব্র প্রতিবাদ হয়েছে, তাতে বিজেপি ওই ইস্যুতে পা ফেলার ক্ষেত্রে সাবধানী হবে বলেই কস্তুরী বসুর ধারণা। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এনআরসি ও সিএএ নিয়ে তারা যে কী করবে- তা এ মুহূর্তে বলা যাচ্ছে না। কারণ এগুলোর বিরুদ্ধে পশ্চিমবঙ্গে দলমত নির্বিশেষে একটা তীব্র বিরোধিতা ছিল, আছে ও থাকবে।’

‘এই রাজ্যটা তো আসলে পার্টিশনের ভুক্তভোগী। তাই পশ্চিমবঙ্গ খুব ভালো করেই জানে এনআরসি আসলে দেশভাগের অসমাপ্ত এজেন্ডাকেই শেষ করার একটা চেষ্টা’, বলছিলেন কস্তুরী বসু।

'মোদি বা অমিত শাহ হয়তো দ্বিগুণ উৎসাহে নামবেন'
হিন্দুত্ববাদী গেরুয়া দলটির প্রতিষ্ঠাতা শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের জন্মভূমি পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় আসা তাদের দীর্ঘ দিনের স্বপ্ন। একথা বিজেপি বহুবার বলেছে। এ স্বপ্ন এ যাত্রায় অধরা থাকলেও নরেন্দ্র মোদি ও অমিত শাহরা পশ্চিমবঙ্গ নিয়ে উৎসাহ হারিয়ে ফেলবেন, তা মোটেই বিশ্বাস করেন না দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়ার সিনিয়র সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহুয়া চ্যাটার্জি।

তিনি বিবিসিকে বলেন, ‘এত বছর ধরে বিজেপিকে যতটুকু দেখেছি তাতে বলাই যায়, তারা নতুন একটা জায়গাকে এত সহজে ছেড়ে দেবে না। প্রথম চেষ্টায় মেজরিটি না-পেলেই পশ্চিমবঙ্গ থেকে তাদের আগ্রহ সরে যাবে বলে কিছুতেই মনে হয় না।’

‘প্রথম কিছুদিন বিজেপি হয়তো পশ্চিমবঙ্গকে দেখাতে চাইবে যে আমরা একটা গঠনমূলক বিরোধী দল। আমরাও আপনাদের জন্য কাজ করতে চাইছি। সোজা কথায়, বিজেপি প্রথমে ভালোভাবে মানুষকে ভোলাতে চাইবে, যাতে এ রাজ্যের মানুষ ২০২৪-এর সাধারণ নির্বাচনে তাদের ভোট দেয়। কিন্তু এটা যদি কাজ না করে, তাহলে তাদের যে স্বাভাবিক পথে বিজেপি চলতে অভ্যস্ত ওই পথেই তারা আবার ফিরে যাবে। এ ব্যাপারে আমার কোনো সন্দেহ নেই’, বলছিলেন মহুয়া চ্যাটার্জি।

তিনি আরো জানান, ২০২৪ সালে ভারতের সাধারণ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে হিন্দি বলয়ের রাজ্যগুলোতে বিজেপির যে ঘাটতি হতে পারে, তা পুষিয়ে নেয়ার জন্য বিজেপির অন্যতম প্রধান টার্গেট হলো পশ্চিমবঙ্গ। ফলে অন্তত আগামী তিন বছর সাম্প্রদায়িকতার তাস লুকিয়ে রেখে বিরোধী দল বিজেপি পশ্চিমবঙ্গে অন্য চেহারায় বা অন্য মোড়কে দেখা দেবে। এই সম্ভাবনাও থাকছে।

সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement