২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`


তুরস্ক-ইরান জটিল সম্পর্ক

তুরস্ক-ইরান জটিল সম্পর্ক - ফাইল ছবি

ইরান-তুরস্কের সম্পর্ক সহযোগিতামূলক হলেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা প্রতিযোগিতামূলকও। মধ্যপ্রাচ্যে বর্তমান যুদ্ধের বিস্তৃতি এবং ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে রাশিয়া ও ইউক্রেনের সাথে তুরস্কের কূটনৈতিক সম্পর্ক এবং রাশিয়ার সাথে ইরানের সামরিক বন্ধন ও অস্ত্র সহযোগিতা এই দুই দেশকে বিভিন্ন রাজনৈতিক-কূটনৈতিক মঞ্চে বিভিন্ন মাত্রা দিয়েছে।

তুরস্ক ও ইরানের উভয়ই সম্পর্কগত বোঝাপড়ার একটি মৌলিক কাঠামো হিসেবে কাসর-ই শিরিনের ১৬৩৯ সালের চুক্তি উল্লেখযোগ্য। ১৬৩৯ সাল থেকে সাংস্কৃতিক এবং ভূ-রাজনৈতিক আলোচনা ও সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর দুই দেশ কোনো যুদ্ধে জড়ায়নি। কাসর-ই শিরিন চুক্তির মাধ্যমে দুই দেশের ১৫০ বছর চলমান যুদ্ধেরও ইতি হয়। কাসর-ই শিরিন বা কাসরি শিরিন চুক্তিতে লেখা ছিল, মহান আল্লাহর অনুকম্পায় এই চুক্তি রোজ কিয়ামত পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে এবং যে বা যারা এটির পরিবর্তন করবে তারা পাপিষ্ঠ হিসেবে পরিগণিত হবে। দুর্গগুলোতে কোনো শ্লীলতাহানি হবে না, বণিক ও ভ্রমণকারীরা নিরাপদে চলাচল করবে ইত্যাদি। এই চুক্তি তুর্কি সুলতান চতুর্থ মুরাদ ও পারস্যের রাজার মধ্যে সম্পাদিত হয়েছিল এবং উভয়েই সেটিকে আমানত হিসেবে বিবেচনা করে আসছে।

যদিও দুই দেশের মধ্যে সরাসরি কোনো সংঘর্ষ হয়নি, তবে আঞ্চলিক, ভূ-রাজনৈতিক ও কৌশলগত গতিশীলতার ব্যাপক পরিবর্তন ও মধ্যপ্রাচ্যে ব্যাপক পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট নিরাপত্তা উদ্বেগ তাদের মধ্যে বিবিধ ইস্যুতে প্রতিযোগিতার ভিত্তি তৈরি করে।

দুই দেশের মধ্যে প্রতিযোগিতার মঞ্চে পরিণত হয় ইরাক। সিরিয়ায় তারা বিভিন্ন সামরিক, কূটনৈতিক ও কৌশলগত অবস্থান নিয়ে অগ্রসর হয়। সিরিয়া ও ইরাকে একই রকম পরিস্থিতি এবং সমালোচনা মুসলিম বিশ্বকে অনেক নরম করে দিতে থাকে যা এখনো চলমান রয়েছে। আফগানিস্তানের তালেবান দুই দেশের মধ্যে অভিবাসন সমস্যা বাড়িয়ে দেয় এবং অনেক যুদ্ধংদেহী গোষ্ঠীর জন্ম হয়। তুরস্কের বিরুদ্ধে অভিবাসনকে ব্যবহার করে চাপ প্রয়োগ করার চেষ্টা করতে থাকে ইরান। কারাবাখে আজারবাইজানের বিজয়ে ইরান উদ্বিগ্ন হয়ে আর্মেনিয়াকে সমর্থন করে, তুরস্কের প্রচেষ্টায় জাঙ্গেজোর করিডোর সৃষ্টি হওয়ায় ভূ-রাজনৈতিক ঝুঁঁকি হিসেবে দেখে, তুরস্ক আজারবাইজানকে আর্মেনিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে সার্বিক সহায়তা দেয়। আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট প্রকাশ্যে ঘোষণা দেন, ‘আজারি ও তুর্কিরা এক জাতি’। এই সঙ্কটে আর্মেনিয়াকে এতদিন রাশিয়া সমর্থন দিলেও এবার চুপ করে থাকে, ফলে আর্মেনীয়রা পুতিনের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলে। এ অবস্থায় ইসরাইল আর্মেনিয়ায় সামরিক সহায়তা দিয়ে পুরোনো সম্পর্ক আরো মজবুত করে তোলে।

৭ অক্টোবরের হামাস-ইসরাইল যুদ্ধ শুরুর পর লেবানন থেকে ইয়েমেন পর্যন্ত অঞ্চলে অরাষ্ট্রীয় সশস্ত্র গোষ্ঠীকে ইরানের সার্বিক সমর্থন ও রাশিয়াকে সরাসরি সামরিক সহায়তা তুর্কি-ইরান সম্পর্কে প্রভাব রাখে। ফলে এই বহুমাত্রিক সম্পর্ক সহযোগিতা, প্রতিযোগিতা ও সংঘর্ষের আঞ্চলিক অক্ষগুলোতে গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হিসেবে দেখা দেয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা-বাগযুদ্ধ, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির অপ্রত্যাশিত উন্নয়ন, স্পেস টেকনোলজিতে অভূতপূর্ব সাফল্য, তুরস্কের সামরিক ইন্ডাস্ট্রির বিস্ময়কর অগ্রগতি ও একই সাথে মহাশূন্য ও পরমাণু কর্মসূচিতে অগ্রাভিযান আঙ্কারা-তেহরান সম্পর্কের পরিধি প্রশস্ত করেছে।

ইসরাইল-গাজা যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে আঞ্চলিক উত্তেজনা বৃদ্ধির মধ্যে ইরানের প্রেসিডেন্ট জনাব রাইসি তুরস্কে প্রথম রাষ্ট্রীয় সফর করেছেন ২৩ জানুয়ারি ২০২৪। তেহরান ও আঙ্কারা উভয়েই ফিলিস্তিনিদের পক্ষে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। রাইসি বলেন, ফিলিস্তিনি জনগণের প্রতিরোধের সমর্থনে ইরান ও তুরস্কের অভিন্ন অবস্থান রয়েছে। আঙ্কারায় এক বক্তৃতায় জনাব রাইসি বলেন, ‘ফিলিস্তিনি ইস্যু ও ফিলিস্তিনি জনগণের অধিকার নিয়ে আমরা প্রেসিডেন্ট এরদোগানের সাথে একমত।’ ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার পর ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু হামাস নিয়ন্ত্রিত সব এলাকাকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করার অঙ্গীকার করেছেন।

বর্তমানে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যের পরিমাণ প্রায় সাত বিলিয়ন মার্কিন ডলার। তুরস্ক ইরান থেকে জ্বালানি আমদানি করে এবং শিল্প, খাদ্য ও পোশাক রফতানি করে। ইরানে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা বাণিজ্যে বাধা সৃষ্টি করে, এই সফরে গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক ইস্যুগুলো আলোচনায় নিয়ে আসা হয় এবং উত্তরণের ব্যাপারে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। বাণিজ্য, পরিবহন, শিল্প, প্রযুক্তি, জ্বালানি ও নিরাপত্তা নিয়ে ১০টি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় যার বাণিজ্যের পরিমাণ ৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি! রাইসির সফর অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদার ও আঞ্চলিক ইস্যুতে ঐকমত্যের ওপর জোর দিয়েছে।

পিকেকে গোষ্ঠী থেকে আঙ্কারা ও তেহরান উভয়েই হুমকির সম্মুখীন। যখন তুরস্ক উত্তরে পিকেকে ক্যাম্পগুলো সামরিকভাবে দুর্বল করে তখন ইরানের কার্যকারিতা দেখা যায় না। সুলায়মানিয়ার সাথে ইরানের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক, তারা আবার পিকেকে-কে আশ্রয় দিয়েছে। ইরান-সমর্থিত হাশদ আল-শাবি আবার তুরস্ককে হুমকি দেয় এবং মাঝে মধ্যে অস্থায়ী সামরিক ঘাঁটি আক্রমণ করে, এতে তুরস্কের সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধ প্রচেষ্টা জটিল হয়ে যায়। সিরিয়ার ইউফ্রেটিস নদীর পশ্চিমাঞ্চলে ওয়াইপিজির সাথে ইরানের সহযোগিতা আছে, ওয়াইপিজিকে তুরস্ক সন্ত্রাসী সংগঠন মনে করে। প্রেসিডেন্ট রাইসির তুরস্ক সফর বর্ধিত সহযোগিতার দৃঢ় পদক্ষেপ হলেও এসব নানা চ্যালেঞ্জ এই সম্ভাবনা সীমিত করতে পারে।

গাজায় ইসরাইলের চলমান আগ্রাসনে লেবানন থেকে ইয়েমেন পর্যন্ত বিশাল অঞ্চলে সঙ্ঘাতের পুনরুত্থান হয়েছে। ইরাক ও সিরিয়া থেকে বাইডেন প্রশাসনের প্রত্যাহারের ইঙ্গিত, হুতিদের সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে তালিকাভুক্ত করা এবং সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে হামলা আঞ্চলিক নিরাপত্তাবলয় ভেঙে দিয়েছে। মার্কিন মধ্যপ্রাচ্য নীতির এই পরিবর্তন তুরস্ক-ইরান সম্পর্কের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল ইরানের লক্ষ্যবস্তু হওয়ার সম্ভাবনা অনেকটা নিশ্চিত হয়ে উঠেছে। তুরস্ক-ইরানের প্রতিক্রিয়া ও আঞ্চলিক রাজনীতির সামরিকীকরণের ফলে বৃহত্তর সঙ্ঘাত ঘটতে পারে।

দক্ষিণ ককেশাস ও কারাবাখে, আজারবাইজান ও আর্মেনিয়া সম্পর্কে তুরস্ক ও ইরানের ভিন্ন অবস্থান আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার প্রতি হুমকি স্বরূপ। জাঙ্গেজোর করিডোর উদ্বোধন ইরানের অর্থনৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিক চাপ বাড়িয়ে তুলতে পারে, সহযোগিতা হ্রাস করতে পারে এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতা বাড়াতে পারে। উপরন্তু, রাশিয়ার সাথে ইরানের সহযোগিতা ও পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে প্রশ্ন আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতা বাড়িয়ে দেবে।

দু’দেশের চুক্তি ইসরাইলকে কিভাবে প্রভাবিত করবে সেটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। ইসরাইলের অবস্থান অনেক কারণের ওপর নির্ভর করে, যেমন, তার প্রতিবেশী, তার মিত্র, প্রতিপক্ষ ও বৈশ্বিক শক্তির সাথে সম্পর্ক। এ বন্ধন ফিলিস্তিন সমস্যা সমাধানের জন্য ইসরাইলের ওপর চাপ বাড়াতে পারে, কারণ তুরস্ক ও ইরান ফিলিস্তিন ইস্যুতে সোচ্চার সমর্থক এবং ইসরাইলের বিরুদ্ধে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক মতামত সৃষ্টিতে প্রভাব সৃষ্টি করার মতো। ফলে ইসরাইল বিরোধিতার একটি নতুন অক্ষ তৈরি হবে। কারণ তুরস্ক ও ইরান উভয়েই সিরিয়া, গাজা, লেবানন ও পারমাণবিক চুক্তির মতো বিভিন্ন বিষয়ে ইসরাইলের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত। তুরস্ক এবং ইরান এই অঞ্চলে ইসরাইলের স্বার্থ ও নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ করার জন্য তাদের নীতি ও কর্মের সমন্বয় করতে পারে।

এই চুক্তি আরব আমিরাত, বাহরাইন ও সুদানের মতো কিছু আরব রাষ্ট্রের সাথে ইসরাইলের সাম্প্রতিক স্বাভাবিকীকরণ চুক্তিগুলোকে দুর্বল করতে সক্ষম, কারণ তুরস্ক-ইরান এই সব দেশকে ইসরাইল থেকে দূরে সরিয়ে আরব ঐকমত্যে ফিরিয়ে নেয়ার ক্ষমতা রাখে এবং ইসরাইলের সাথে তাদের ঐক্য ও সহযোগিতা দুর্বল করতে আরব রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বিভাজন ও উত্তেজনাকে কাজে লাগাতে পারে। দুই পক্ষের এই সম্পর্ক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ইসরাইলের সম্পর্ককে জটিল করে তুলতে শুরু করেছে। তুরস্ক ন্যাটো সদস্য এবং ইরানের মতোই গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক শক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য যাদের কৌশলগত গুরুত্ব রয়েছে।

ইসরাইল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ঘনিষ্ঠ মৈত্রী বজায় রাখা ও এই অঞ্চলে নিজ স্বার্থ ও নিরাপত্তা রক্ষায় দ্বিধাগ্রস্ততার সম্মুখীন হতে পারে। তুরস্ক ও ইরানের সাথে সংলাপ এবং কূটনীতিতে যুক্ত হওয়ার জন্য ইসরাইল দ্বন্দ্ব ও বিচ্ছিন্নতার পরিবর্তে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আরো চাপের সম্মুখীন হতে পারে।

ইসরাইলও দু’দেশের বন্ধন নিজের স্বার্থের জন্য ব্যবহার করতে পারে, যেমন, তুরস্ক-ইরানের প্রভাবকে ভারসাম্য রক্ষায় ব্যবহার এবং এর মোকাবেলায় বিদ্যমান মিত্র ও অংশীদার, যেমন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইইউ, ভারত ও কিছু আরব রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক জোরদার করবে এবং গ্রিস, সাইপ্রাস ও প্রস্তাবিত কুর্দিস্তানের কুর্দিদের সাথে পাওয়ার চেষ্টা করবে।

শেষ পর্যন্ত, ইরান-তুর্কি সম্পর্ক সহযোগিতা বা বিরোধপূর্ণ প্রতিযোগিতার দিকে ঝুঁকবে কি না তা কেবল দু’টি দেশের পছন্দ নয়, আঞ্চলিক ঘটনাবলির গতিপ্রকৃতি এবং মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন নীতি নির্দেশনার ওপরও নির্ভর করে।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত যুগ্মসচিব ও গ্রন্থকার


আরো সংবাদ



premium cement